মহানন্দা নদী সংস্কারে ঢিলেমি কেন |
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার এবং বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র শিলিগুড়ি শহর, যার বুক চিরে বয়ে চলেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নদী মহানন্দা। এক সময় এই শহরের আর্থ-সামাজিক শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত ছিল ওই নদী। কর্মসূত্রে বসবাস করতে গিয়ে বহু প্রবীণ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের অতীতের উজ্জ্বল স্মৃতিচারণে শুনতে পেয়েছি এমন বহু ঘটনার কথা। অবশ্য মইষাল বন্ধুর প্রাণের মহানন্দার বর্তমান চিত্রের সঙ্গে তা মেলাতে গেলে সবটাই যেন কাল্পনিক মনে হয়। কারণ, সেই চিরাচরিত মেঠো প্রবাদ ‘নদীকে বইতে দাও তার মতো করে’ এ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত তথাকথিত উন্নয়নের বিজয়রথে পিষ্ট হয়েছে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আছড়ে পড়া তীব্র জনস্রোতে শিলিগুড়ি শহরের কলেবর বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলে প্রয়োজনের খাতিরে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত পঞ্চায়েতের অধীন কিছু এলাকা, যা বর্তমানে অ্যাডেড এরিয়া বলে পরিচিত, শিলিগুড়ি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এতে বর্তমানে বৃহত্তর শিলিগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অতি দ্রুতগতিতে। |
তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শহরের সীমান্ত সংলগ্ন অবস্থান, পার্বত্য দার্জিলিঙের রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলগুলি তাদের জনসমর্থনের ভিত্তি মজবুত করতে প্রতিনিয়ত বহু মানুষকে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দিয়েই চলেছে। এ সকল নানা কারণে এক দিকে যেমন জমির দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্য দিকে তেমনই বসতজমি (শহর সংলগ্ন) প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় কিছু মানুষ রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় দাদাদের বদান্যতায় খুবই কম মূল্যে কিংবা বিনামূল্যে নদীর ধার বা চর বেদখল করে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে এ ভাবেই শিলিগুড়ি শহর ও শহর সংলগ্ন মহানন্দা, ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি নদীর ধার ও চরে লোকবসতি বেড়েই চলেছে। তার ওপর অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানার দাপাদাপির এই শহরকে পরিকল্পিত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের দীর্ঘ দিনের চরম অনীহা। এর ফলে দূষিত হচ্ছে শিলিগুড়ির বুক চিরে বয়ে যাওয়া মহানন্দা। নদীর জল দূষণের ফলে সৌন্দর্য হারিয়েছে পার্শ্ববর্তী এলাকা।
বহু জায়গায় মহানন্দার চর দখল করে গড়ে উঠেছে নৌকাঘাট, গঙ্গানগর, শীতলাপাড়া, নতুন পাড়া, কুলিবস্তি, নন্দীগ্রাম ইত্যাদি বহু পাড়া, কলোনি, বস্তি। এমনকী শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদ (এস জে ডি এ) মহানন্দা চরের প্রায় ২২ একর জমি তুলে দিয়েছে একটি বেসরকারি পেপার মিল’কে। এই কোম্পানি রীতিমতো নদীর গতিপথ রোধ করে গড়ে তুলেছে পাকা কনস্ট্রাকশন। আজ পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক যে মহানন্দার বুকে জনবসতি গড়ে ওঠায় জলবহন ক্ষমতা প্রায় লুপ্ত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নদীর বুক এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল শিলিগুড়ির লেভেলের চেয়েও উঁচুতে উঠেছে। আর তাতেই যত্রতত্র গড়ে উঠেছে মোষের খাটাল (সঙ্গের ছবিতে দ্রষ্টব্য)। যদিও নদীর ধার বা চরের সব জমিই যে ভেস্টেড, তাও নয়। এখানে একটা বড় মাপের দালালচক্র কাজ করছে। ইতিমধ্যে ‘ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি’, ‘স্টেট গঙ্গা রিভার কনজারভেশন অথরিটি’, ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’-এর আওতায় নদীদূষণ রোধে গোমতী, দামোদরের সঙ্গে মহানন্দাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান গঠন করাও হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৫-এ ‘এস জে ডি এ’ এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে। গত জুন ২০০৯ পর্যন্ত মঞ্জুরিকৃত ৪০.৩৮ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ১৮ কোটি টাকা তারা খরচ করতে সক্ষম হয়। খরচের সিকিভাগও নদীর ধারের বাঁধ, সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নদীর গার্ড, রাস্তা, পলি ওঠানো, সর্বোপরি বেআইনি দখল মুক্ত করে উন্নয়নমূলক কাজে খরচ হয়নি, বরং মহানন্দা সংস্কারের নামে এক শ্রেণির প্রোমোটার রাজ এখানে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। উত্তরবঙ্গ নদীদূষণ পর্ষদের তরফেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাহায্যে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। তাই মহানন্দাকে পুনর্জীবন দিতে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করাতে হবে নাব্যতা ফেরাতে। ভাঙন রোধ থেকে পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলিকেও মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানের আওতাভুক্ত করতে হবে।
ঝন্টু বড়াইক। হ্যামিল্টনগঞ্জ, জলপাইগুড়ি
|