রাজ্যের এক সরকারি হাসপাতালে লাল পিঁপড়ের কামড়ে এক সদ্যোজাতের মৃত্যুর অভিযোগ উঠল। আর এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরেও ময়নাতদন্ত না-করেই মৃতদেহ তুলে দেওয়া হল পরিজনের হাতে! সমাহিত হয়েও গেল শিশুটি!
রবিবার, মালদহ সদর হাসপাতালের ঘটনা। পরিবারের তরফে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং ইংরেজবাজার থানায় ‘পিঁপড়ের কামড়ে’ শিশুমৃত্যুর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে হাসপাতালে বিক্ষোভও হয়। তদন্তের আশ্বাসে বিক্ষোভ এক সময়ে উঠে গেলেও এলাকায় টানটান উত্তেজনা ছিল দিনভর। কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
মালদহের মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক স্বপনকুমার ঝরিয়াত বলেন, “বাচ্চাটি পিঁপড়ের কামড়ে মারা গিয়েছে, না কি অন্য কোনও কারণে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” জেলার পুলিশ সুপার ভুবন মণ্ডল জানান, “পুলিশও তদন্ত শুরু করেছে।” মালদহ সদর হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রী আড়ি বলেন, “শিশুটির গায়ে লাল লাল দাগ ছিল। স্বাস্থ্য দফতর তদন্ত করছে।” রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা শুভময় দত্তচৌধুরীর মন্তব্য, “বিশদে খোঁজ নিচ্ছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” আর মালদহেরই যে বাসিন্দা এখন রাজ্যের নারী-শিশু উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী, সেই সাবিত্রী মিত্রের প্রতিক্রিয়া, “কেন এমন হল, তার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া উচিত।”
সবাই তদন্তের কথা বললেও ময়না-তদন্ত ছাড়াই কিন্তু শিশুটির দেহ তুলে দেওয়া হয় পরিজনের হাতে। মৃতদেহটি সমাহিত করাও হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর আসল কারণ চাপা দিতেই ময়না-তদন্ত ছাড়া মৃতদেহ বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেওয়া হল কি না, সে প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে। আর ময়না-তদন্ত হল না কেন, সেই প্রশ্নে শুরু হয়ে গিয়েছে পুলিশ ও হাসপাতালের চাপান-উতোর।
মালদহ শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের হঠাৎ কলোনির বাসিন্দা দীপা সাহা প্রসবযন্ত্রণা নিয়ে মালদহ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২৬ অগস্ট রাতে। ওই রাতেই অস্ত্রোপচার করে তাঁর একটি মেয়ে হয়। হাসপাতাল-সূত্রের খবর: জন্মের পরেই শিশুটি জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ায় তাকে শিশুবিভাগে (নবজাতক) ইনকিউবেটারে অতিবেগুনি রশ্মি (আল্ট্রা ভায়োলেট রে) বিকিরণকারী যন্ত্রের নীচে রাখা হয়েছিল। এবং সেখানেই শনিবার রাত দশটা নাগাদ তাঁর মেয়েকে লাল পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছিল বলে দীপাদেবীর অভিযোগ। তাঁর দাবি, ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্সদের তিনি বার বার বলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা গুরুত্ব দেননি। এমনকী, বাচ্চাটিকে তাঁর কাছেও দেওয়া হয়নি।
দীপাদেবী বলেন, “আমার মেয়েকে লাল পিঁপড়ে ছেঁকে ধরেছিল। ও ছটফট করছিল। কত বার নার্সদের বললাম, মেয়ের গা থেকে পিঁপড়ে সরিয়ে দিন। না-হলে মেয়েকে আমার কাছে দিন। ওঁরা শুনলেনই না। উল্টে বললেন, মেয়ের গায়ে পিঁপড়ে নেই। লাল লাল দাগ রয়েছে। তুমি ভুল দেখছ। তা ছাড়া তোমার সদ্য অপারেশন হয়েছে, মেয়েকে তোমার কাছে দেওয়া যাবে না। শেষে ভোরবেলায় আমার মেয়েটা মরে গেল।” দীপাদেবীর স্বামী সঞ্জীব সাহার আক্ষেপ, “স্ত্রী-র কাছে ঘটনা জেনে রাতেই যেখানে যেখানে পেরেছি, বলেছি। তাতেও মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না।” এ দিন দুপুরে পুরনো মালদহের বেহুলা নদীর ধারে বাচ্চাটির দেহ পুঁতে দেন আত্মীয়েরা।
রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে রোগীদের উপরে কীট-পতঙ্গের ‘হামলা’ অবশ্য নতুন কিছু নয়। বছর চার-পাঁচ আগে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে এক রোগিণীর চোখ ‘খুবলে নিয়েছিল’ পিঁপড়ের দল। বছর দুয়েক আগে এনআরএসের নিওনেটাল ইউনিটে ছোট আরশোলার উপদ্রবে এক সদ্যোজাতের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীর পায়ের আঙুল খুবলে নিয়েছিল ইঁদুর। আবার মাস দুয়েক আগে সেই শম্ভুনাথেই ছারপোকার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন রোগিণীরা। মালদহ হাসপাতালের শিশুবিভাগে অতিবেগুনি রশ্মির নীচে রাখা শিশুকে পিঁপড়ে
ছেঁকে ধরতে পারে কি না, সে প্রশ্ন উঠলেও তার গায়ে ‘চাকা চাকা দাগে’র কারণ নিয়ে ধন্ধে পড়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তারাই। যে কারণে তাঁদের তদন্তের নির্দেশ।
এ দিন সকাল ন’টা নাগাদ শিশুটির মৃত্যুসংবাদ জানাজানি হতেই আত্মীয়-পরিজন এবং এলাকাবাসী মালদহ হাসপাতালে গিয়ে সুপারকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলর কাকলি চৌধুরী বলেন, “সুপার আশ্বাস দিয়েছেন, তদন্ত করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেবেন। কিন্তু আমরা বার বার বলা সত্ত্বেও হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ বাচ্চাটার ময়না-তদন্ত করাননি।” কাকলিদেবীর স্বামী তথা ইংরেজবাজারের কংগ্রেস বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী বলেন, “বাচ্চাটির বাড়ির লোক শনিবার রাতে আমাকে ফোন করে ঘটনাটি জানান। আমি সঙ্গে সঙ্গে মালদহ হাসপাতালের শিশুবিভাগে কর্তব্যরত নার্সদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। নার্সরা কথা বলতে চাননি। তখন সুপারকে জানাই। ভেবেছিলাম, উনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবেন। এ দিন শুনলাম, বাচ্চাটা মারা গিয়েছে।”
কিন্তু বাচ্চাটির গায়ে চাকা চাকা দাগ থাকা সত্ত্বেও ময়না-তদন্ত কেন হল না? পুলিশই বা ব্যবস্থা নিল না কেন?
সুপার বলেন, “এখনই তা বলা যাচ্ছে না।” অন্য দিকে এসপি-র বক্তব্য, “মূল অভিযোগ হয়েছে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে। পরে একই অভিযোগ থানায় জানানো হয়েছে। চিকিৎসকেরা না-বললে আমরা কেন ময়না-তদন্ত করাতে যাব?” যদিও মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের মন্তব্য, “তেমন বুঝলে পুলিশই তো ময়না-তদন্ত করাতে পারত! আমার কাছে যে অভিযোগ হয়েছে, সেটা তো তারাও পেয়েছে!”
তবে জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “আদালত নির্দেশ দিলে মৃতদেহ মাটির নীচ থেকে তুলে ময়না-তদন্ত করা যেতে পারে। মৃত্যুর কারণ জানতে হলে ময়না-তদন্ত ছাড়া উপায় নেই।” |