প্রতিযোগিতা নিয়ে উৎসবের মেজাজ জেলা জুড়ে |
গঙ্গাবক্ষে ৮১ কিমি সাঁতারে ফের প্রথম চন্দন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • বহরমপুর |
ভাগীরথী বুকে ৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ সাঁতার প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দু’জনই বহরমপুরের। ওই দু’জনের মধ্যে আরও মিল রয়েছে। এক জনের বাবা রাজমিস্ত্রি। অন্য জনের মা সন্ধ্যা হালদার রাঁধুনির কাজ করে সংসার চালান। বহরমপুর শহরের রাজমিস্ত্রি যশোদাদুলাল সরকারের ছেলে চন্দন এ বার নিয়ে দু’বার ৮১ কিলোমিটার সাঁতারে প্রথম হলেন। সন্ধ্যাদেবী তাঁর ক্যানসার রোগে আক্রান্ত স্বামী সুকুমার হালদারকে দিন কুড়ি আগে চিরদিনের মতো হারিয়েছেন। দেবকুমার ৮১ কিলোমিটার সাঁতারে পর পর দু’বছর দ্বিতীয় হলেন। তৃতীয় হয়েছেন বাংলাদেশের মুনমুন আহমেদ। |
সাঁতারে প্রথম চন্দন সরকার। |
বহরমপুর সুহৃদ সংঘের চন্দন এ বার নিয়ে ৭ বার প্রতিযোগিতায় নেমে দু’বার প্রথম, দু’বার দ্বিতীয় এবং আর এক বার তৃতীয় হয়েছেন। জঙ্গিপুরের আহিরণঘাট থেকে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজঘাট পর্যন্ত ৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ জলপথ পেরোতে সময় নিয়েছেন ১১ ঘণ্টা ৪ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড। বহরমপুর সুইমিং ক্লাবের দেবকুমার হালদার সময় নেন ১১ ঘণ্টা ১৭ মিনিট ৮ সেকেন্ড। বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের মুনমুন আহমেদের সময় লাগে ১১ ঘণ্টা ২৩ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড। ‘মুর্শিদাবাদ সুইমিং অ্যাসোসিয়েশান’ আয়োজিত ৬৮ তম বর্ষের ওই সাঁতার প্রতিযোগিতায় গুজরাত, মহারাষ্ট্র, অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, বাংলাদেশ ও এ রাজ্যের মিলিয়ে মোট ২৮ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে ৫ জন মহিলা।
২৫ বছরের যুবক অবিবাহিত চন্দন পেশায় একটি বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তাকর্মী। তিনি বলেন, “রাজমিস্ত্রির ছেলে। ফলে আর্থিক অনটনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার আর লেখাপড়া করা হয়নি। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বেসরকারি সিকিউরিটি কর্মীর কাজ করতে বাধ্য হই। তার উপরে সাঁতারের নেশাও রয়েছে।” তবে তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম সরকারি চাকরি জুটবে। গত বার সাঁতারের অনুষ্ঠানে জেলাশাক আমদের তাঁরা অফিসে দেখা করতে বলেছিলেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি আজও।” |
১৯ কিলোমিটার সাঁতরে এসেছেন অন্ধ কানাইলাল চক্রবর্তী। |
দেবকুমারের কাহিনিও প্রায় একই রকম। তাঁদের নিজেদের ভিটেটুকুই নেই। বহরমপুরের গঙ্গার পাড়ে সরকারি খাসজমি দখল করে গড়ে ওঠা গাঁধী কলোনির কুঁড়েঘরে থাকেন। দেবকুমার বলেন, “মা রাঁধুনির কাজ করেন। দাদা নদীতে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করেন। তাই দিয়ে মোট ৬ জনের সংসার চলে। কোনও মতে দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠেছি। এর পর হয়তো লেখাপড়া চালানো যাবে না। গত বারও ৮১ কিলোমিটার সাঁতারে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। তখন ওই সাঁতারের অনুষ্ঠানে জেলাশাসক তাঁর অফিসে গিয়ে আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন। কিন্তু আজও কোনও চাকরি জোটেনি।”
তবে তাঁদেরই শুধু নয় ৮১ কিলোমিটারের সব সাঁতারুদের কলকাতায় নিয়ে গিয়ে রাজ্য ক্রীড়া দফতরের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠান করে সেখানে তাঁদের সম্মানিত করা ও আর্থিক ভাবে পুরস্কৃত করা হবে বলে রবিবার ভোরে আহিরণ ঘাটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র ওই প্রতিশ্রুতি দেন।
সেই সঙ্গে তিনি ‘মুর্শিদাবাদ সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন’-এর ভাঙাচোরা সুইমিং পুল পুনর্নিমাণ করারও প্রতিশ্রুতি দেন। মুর্শিদাবাদ সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন-এর বহরমপুর শহরের কার্যালয় প্রাঙ্গণে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ওই সুইমিং পুলের শিলান্যাস করেন। তার প্রায় তিন দশক পর ২০০২ সালে নির্মীয়মাণ ওই সুইমিং পুলের উদ্বাধন করার আয়োজন হয়েছিল। উদ্বোধনের দিন ভোরে ওই সুইমিং পুল ভেঙে পড়ে যায়। সুইমিং পুল সেই থেকে ওই অবস্থাতেই রয়েছে। মদন মিত্র বলেন, “সুইমিং পুলের ওই সব ঘটনার কথা আমার জানা নেই। তবে ওই বিষয়ে রিপোর্ট পাঠালে পুনরায় সুইমিং পুল নির্মাণ করা হবে।” |
২৫ লক্ষ টাকা বাজেটের বাৎসরিক এই সাঁতার উৎসব ঘিরে জেলা জুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। ২০ ফুট থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার ২১টি তোরণ বহরমপুর, জিয়াগঞ্জ ও রঘুনাথগঞ্জ শহরে তৈরি হয়। তিনটি প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মোট প্রতিযোগীর সংখ্যা ৭৮। ওই ৭৮ জনের জন্য ছিল ৮৪টি নৌকা ও দু’টি লঞ্চের ব্যবস্থা। সেখানে ছিলেন ‘সুইমিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’র কমর্কতা ও চিকিৎসকেরা। এ দিন সন্ধ্যায় কৃষ্ণনাথ কলেজের কুমার হস্টেল মাঠে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মদন মিত্র ও সুব্রত সাহা-সহ ছিলেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা।
|