এখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মসার্ধশতবর্ষ। পূজনীয় স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজের মুখে নিম্নলিখিত ঘটনা শোনা। মহারাজ শুনেছিলেন, প্রফুল্ল ঘোষ মহাশয়ের কাছ থেকে। প্রফুল্ল ঘোষ বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি বিরাট চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। একদিন শ্রীঘোষ অর্থসংগ্রহের জন্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছে যান। আচার্য রায় শ্রীঘোষকে বসতে বলেন। সেই সময় আচার্য রায়ের আরদালি ওঁর জন্য টিফিন নিয়ে ঢুকলেন। আরদালি ওঁর জন্য একটু চিঁড়েভাজা ও তিনটি কাঁঠালি কলা কিনে এনেছেন। আচার্য রায় তো ভীষণ উত্তেজিত। তিনি রাগ করে বলছেন, তোমাকে তো একটু চিড়েভাজা ও দুটি কলা আনতে বলেছিলাম। কেন তুমি তিনটে কলা কিনেছ? কেন তুমি বাজে পয়সা নষ্ট করেছ? ইত্যাদি। |
আরদালি বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, খুচরো পয়সা ছিল না, তাই কিনেছি। কিন্তু আচার্য রায় ভীষণ বিরক্ত হন। শ্রীঘোষ ওখানে বসে অস্বস্তি অনুভব করেন। তার পরই আচার্য রায় ড্রয়ার থেকে ব্যাঙ্কের পাশ বই বের করেন এবং দেখেন যে, অ্যাকাউন্টে ৮৮০ টাকার মতো আছে। উনি ৮৭০ টাকার চেক লিখে শ্রীঘোষের হাতে তুলে দেন। ছোট ছোট ঘটনা দিয়ে মহামানবদের চেনা যায়। সেই মহাপুরুষকে প্রণাম। |
পথিক গুহ লিখিত ‘ধন্দে পড়ি তাঁকে নিয়ে’ (৭ অগস্ট) পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলতে চাই।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের mercurous nitrite তৈরির যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্বন্ধে কোনও সংশয় বা ভ্রান্তিবিভ্রম অত্যন্ত দুঃখজনক। অসফলতা বা ভুলভ্রান্তি সম্বন্ধে অনুযোগ ও স্বীকারোক্তির দায় ব্যক্তিবিশেষের কাজের উপরেও নির্ভর করে। আচার্যদেবের জীবনের কার্যকলাপ, গবেষণা, শিক্ষকতা ও তাঁর সমগ্র কর্মের মূল্যায়নই তাঁর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তিনি কোনও ভুল কাজ করলে নিজেই তা সর্বদা সংশোধন করতেন। আচার্যদেবের ‘আত্মচরিত’ পড়লে এ সত্য জানা যায়। প্রকৃত ‘আত্মচরিত’ তিনি লিখেছিলেন এবং mercurous nitrite তৈরিতে যথার্থই সফল হয়েছিলেন।
ধন্যবাদ জানাই, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স-এর তিন বিজ্ঞানীকে সুভাষ সামন্ত, শ্রীব্রত গোস্বামী ও অনিমেষ চক্রবর্তীকে সত্যানুসন্ধানের জন্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমার প্রয়াত পিতা বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক নৃপেন্দ্রনাথ ঘোষ আচার্যদেবের ছাত্র, শিষ্য ও তাঁর সঙ্গে একত্রে বাস করতেন বিজ্ঞান কলেজের শেষ দিন পর্যন্ত।
পিতার মুখেও এ সত্য (mercurous nitrite তৈরির প্রস্তুতি) আমি শুনেছি। |
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মসার্ধশতবর্ষ পালনের তাগিদটা যে রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনের মধ্যে আমল পেল না, সে প্রশ্নটা উঠেছে, কাগজে এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে। দশ-এগারো বছর আগেকার ঘটনা। এক মনীষীর কথা প্রায় ভুলে অপর মনীষীকে নিয়ে মাতামাতির কাণ্ডটা তখনও ঘটেছিল। ১৯৯৮-তে নজরুল জন্মশতবর্ষ পালনের তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ল না। কিন্তু ১৯৯৯-তে কবি জীবনানন্দের জন্মশতবর্ষ পালনের ধুম পড়ে গেল। জীবনানন্দ নিয়ে মাতামাতিটা ছিল অবশ্যই মহা গৌরবের, কেননা জীবনানন্দের সাহিত্যের সঙ্গে যেন গণপরিচয় ঘটল সেই শুভক্ষণে। তার আগে তো দু-পাঁচ পাতার কবিতা পড়ে আমরা অনেকেই জীবনানন্দের ছোঁয়া পেয়েছি। এ বার হাজির হল গদ্যপাঠ, কবির পুনর্মূল্যায়ন। এ সবই আমাদের অর্জন বলে গৃহীত। কিন্তু কবি নজরুল জন্মশতবর্ষেও কেন দূরে দূরে থাকলেন? এ প্রশ্নটা সে দিনও কেউ কেউ তুলেছিলেন, কিন্তু আমল পায়নি।
জন্মশতবর্ষ পালনের হিড়িকটা এ কালে বেশ জব্বর। যেন উৎসব লেগে যায়। কিন্তু উৎসবপালনের ত্রুটিগুলো এড়ানো যাচ্ছে না। এ এক পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা। আর এ হিড়িকটা দেখে অন্য কথাও মনে আসে। যে মনীষীরা শতবর্ষের দোরগোড়ায় এখনও পৌঁছাননি কিংবা শতবর্ষ পেরিয়েছেন অনেক কাল বা পালন-তালিকায় যাঁদের নাম এখনও ভেবে ওঠা যায়নি, তাঁদের স্মরণ করব উপলক্ষের কোন ছুতোয়? উপলক্ষ না-হলে উৎসব জমে না আর উৎসব না-জমলে স্মরণ-শ্রদ্ধার প্রসঙ্গটা খুঁচিয়ে তোলা যায় না। এই যখন আমাদের মনের ভাব তখন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, ডা. মেঘনাদ সাহা প্রমুখ মনীষীর স্মরণ-মুহূর্ত অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে কোন যুক্তিতে? জগদীশচন্দ্র তো পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানী, বেতার যন্ত্রের প্রকৃত উদ্ভাবক। তাঁর জন্মবর্ষ এবং জন্মদিনটার কথা কে মনে রাখে? ড. মেঘনাদ সাহাও তো একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং দেশসেবক বলেই খ্যাত। গ্লাস সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় তাঁর অসামান্য অবদান ভোলার নয়।
‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ নিয়ে আমাদের গর্ব। বিজ্ঞানীর জন্মশতবর্ষ পেরিয়েছে ১৯৯৩-তে। ওই উপলক্ষ ঘিরেই বা কী এমন সাড়া পড়েছিল শিক্ষিত সমাজে? মনে পড়ে না। এ সব দেখেশুনে মনে হয়, বিজ্ঞানের ফসল ঘরে তোলার আগ্রহটা আমাদের আছে, কিন্তু বিজ্ঞানীকে স্মরণে রাখার কৌতূহলটা নেই। আমরা বিজ্ঞানের পূজারি কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা আমাদের যথেষ্ট সবল নয়।
উপলক্ষ নিয়ে হইচই আছে, থাকবেও। কিন্তু সমাজ ভাবনার অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো নজরে আসা দরকার। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, বাংলাদেশের সমাজকে সজীব রাখতে হলে রামগোপাল ঘোষের মতো বক্তা, হুতোমের মতো লেখক আর ভোলা ময়রার মতো কবিয়ালদের নাকি প্রয়োজন ছিল। এ প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেছে? |