প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-সহ সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগের জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা ‘বদলার রাজনীতিতে বিশ্বাস’ করেন না বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ করছে, সিপিএমের এই অভিযোগ নস্যাৎ করার পাশাপাশিই রবিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের সমাবেশ-মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কোনও ‘অন্যায়’ই তিনি বরদাস্ত করবেন না। দলের ছাত্র-কর্মীদের মমতা বলেছেন, “কেউ কোথাও যদি জুলুম করে, সে যদি তৃণমূলের কর্মীও হয়, তাকেও ছাড়বেন না। আমি চাই, মানুষ বিচার পাক।”
তিন মাসের রাজত্বে তাঁর দল বা সরকার কোথাও ‘বদলা’ নিতে যায়নি বলে জানিয়ে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, সিপিএমের ৩৪ বছরের রাজত্বে রাজ্যে অনেক ‘কেলেঙ্কারি’ হলেও ক্ষমতায় এসে তা নিয়ে তাঁরা ‘বদলার রাজনীতি’ করেননি। মমতার কথায়, “ইচ্ছে করলেই পারতাম। করলে ওদের কেউ বাদ থাকত না! রাজ্যে আরও জেল বানাতে হত!”
মমতা এর আগে শিল্পপতিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, তৃণমূলের নাম করে কেউ কোথাও টাকা চাইলে যেন না-দেওয়া হয়। এ বার ছাত্র সমাবেশে নিজেদের দলের কর্মীদের ‘জুলুম’ বন্ধ করার ‘বার্তা’ থেকে পরিষ্কার, দল বা সংগঠনের কোনও স্তরেই সাধারণ মানুষ বা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ‘অন্যায়’ কড়া হাতে দমন করতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা। |
বস্তুত, বিধানসভা ভোটের আগেই মমতার ঘোষণা ছিল, তাঁরা শুধু ‘বদল’ই চান। ‘বদলা’ নয়। ক্ষমতায় আসার পরেও সেই অবস্থানই বজায় রেখেছেন মমতা। রাজনৈতিক হিংসায় বামফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের মৃত্যু নিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের চিঠি পেয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজিকে ওই সব অভিযোগের তদন্ত করানোরও নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু কঙ্কাল-কাণ্ডে নাম জড়িয়ে সিপিএমের বিধায়ক তথা বাম জমানার মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ গ্রেফতার হওয়ার পরে সিপিএম নেতৃত্ব রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র অভিযোগ তুলেছেন। খোদ বুদ্ধবাবুও গত ১২ অগস্ট রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে বামফ্রন্টের বিক্ষোভ সমাবেশে মমতার সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’রই অভিযোগে সরব হয়েছিলেন। তার প্রায় পক্ষকাল পরে ছাত্র সমাবেশের মঞ্চকে সিপিএমের অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন মমতা। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌগত রায়দের মতো প্রবীণ নেতাদের ‘সাক্ষী’ রেখে মমতা এ দিন বলেন, “আমরা বলেছিলাম, বদল চাই। বদলা নয়। বদলার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। তিন মাস আমাদের সরকার কাজ করছে। কোথাও কাউকে বদলা নিতে দিইনি।”
সিপিএম অবশ্য এখনও ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র অভিযোগে অনড়। সেই সূত্রেই রাজ্যে একের পর এক কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনায় নতুন তত্ত্ব খাড়া করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। আলিমুদ্দিনে এ দিন প্রশ্নের জবাবে বিমানবাবু বলেন, “যে প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে, তার ফলে এ দিকে-ও দিকে বামপন্থী বা সিপিএমের নাম বলা হচ্ছে। কথা হচ্ছে, যে লোকটি টিপসই দেন, তিনি এত লোকের নাম বলেন কী করে? অভিযোগে যাঁরা নাম দিচ্ছেন, তাঁরা টিপসই দিচ্ছেন আর ৫২ বা ৩৭ বা ৩০ জন সিপিএম নেতা-কর্মীর নাম গড়গড় করে বলে দিচ্ছেন! কী করে হয়!” কয়েক দিন আগে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা যখন বলেছিলেন, রাজ্যের মানুষ কঙ্কাল উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাবেন, তার প্রতিক্রিয়ায় বিমানবাবুর ব্যাখ্যা ছিল, বহু গ্রামাঞ্চলে গুটিবসন্তে মৃত্যু হলে সাধারণত কবর দিয়ে দেওয়া হত। সুতরাং, খোঁড়াখুঁড়ি করলে সেই সব দেহাবশেষ মিলতে পারে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক লাগাতার কঙ্কাল-কাণ্ডে বিভিন্ন অভিযোগকারীদের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলে নতুন তত্ত্ব সামনে আনলেন।
বিমানবাবুর এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলেছেন, “বাংলার কৃষকেরা সকলে লেখাপড়া না-জানলেও আকাশ দেখে বলে দিতে পারতেন, বৃষ্টি কবে আসবে। ওঁরা (সিপিএম) এই সত্য ভুলে গিয়েছেন। লেখাপড়া জানেন না বা সই করতে জানেন না বলে দোষীদের নাম মনে করতে পারবেন না, এমন আজগুবি তত্ত্বের উত্তরাধিকার মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিরই হতে পারে! বিমানবাবু তাদেরই কর্ণধার। এক বার গুটিবসন্ত, এক বার টিপসইয়ের তত্ত্ব দিয়ে তাঁরা নিজেদের আরও ছোট করছেন, দোষীদেরও আড়াল করছেন!”
ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করার সময় মমতা অবশ্য বিমানবাবুর নতুন ব্যাখ্যার কথা জানতেন না। কঙ্কাল-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে বিরোধীদের আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নেতাজি ইন্ডোরে বলেন, “আমরা বাংলাকে কঙ্কালের মিউজিয়াম বানাতে চাই না!” এই সূত্রেই বিমানবাবুর আগেকার ব্যাখ্যার প্রসঙ্গ টেনে মমতার কটাক্ষ, “এ রকম গুটি বসন্তের গল্প যাঁদের মাথা থেকে বেরোচ্ছে, কী বুদ্ধি তাঁদের মাথায়! এঁদের মাথাগুলি বাঁধিয়ে মিউজিয়ামে রেখে দেওয়া উচিত!” তাঁরা যে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র পথে হাঁটছেন না, তা বোঝাতে এ দিন সুশান্তবাবুর নাম না-করেই মমতা বলেন, “এক জনের বিরুদ্ধে সিআইডি তদন্ত করছে। তিনি নিজেই আদালতে আগাম জামিন নিতে গিয়েছিলেন। ঠাকুর ঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি! আদালতে গিয়ে নিজের ফাঁদেই জাঁতাকলে পড়েছেন!”
মমতা এ দিনও বিরোধী বামেদের মুখ বন্ধ রাখার ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “৩৫ বছরে যারা বাংলাকে পিছিয়ে দিয়েছে, তাদের কোনও অধিকার নেই নতুন সরকারের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার! আমাদের যদি কৈফিয়ত দিতে হয়, তা হলে বাংলার মানুষের কাছে দেব। বিরোধীদের বলছি, আপনারা ৫-১০ বছর চুপ করে বসে থাকুন!” বরং বামফ্রন্ট সরকারের
আমলে যে ‘দলতন্ত্র’ রাজ্যের সর্বস্তরে জাঁকিয়ে বসেছিল, তা যে তিনি ‘ভেঙেছেন’ এবং ভবিষ্যতে ‘আরও ভাঙবেন’ তা ফের দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “আমি চাই, উন্নয়নে বাংলা একটা মডেল বা আদর্শ হোক সারা দেশের কাছে।” |