|
|
|
|
ভিড়ের লম্বা লাইনে দাঁড়ানো ক্রিকেটমধ্যবিত্তের রাজ্যাভিষেক |
গৌতম ভট্টাচার্য • লন্ডন |
তিনি যে পোশাকেই যখন থাকুন, পিঠে অদৃশ্য ২ নম্বর সব সময় মারা। নম্বরটা ১ হওয়ার উপায় নেই। ক্রিকেটমুলুকের এটাই যে বরাবরের আইন।
তিনি ডন ব্র্যাডম্যানের পাশে উচ্চারিত হননি কখনও। মধ্যবিত্ত সে যত ভালই হোক, সচিন-ব্র্যাডম্যানদের অভিজাত পাড়ার পাসওয়ার্ড পাওয়া তাঁর নিষিদ্ধ।
তিনি কদাপি ক্রিকেট অঙ্কেরও একক নৃপতি নন। রেকর্ড যতই ঝলমলে দেখাক, বড় জায়গীরদার হিসেবেই সংরক্ষিত রাখা হয়েছে তাঁর এলাকা।
তিনি ক্রিকেটের মন মাতাল করে দেওয়া বর্ণনাও নন যে, পদ্যের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন। শুকনো কাঠ-কাঠ গদ্যের প্রতীক। লোকে যে তাঁকে ‘দেওয়াল’ বলে সেটা সম্ভ্রমে। উচ্ছ্বাসে নয়।
অদৃষ্ট ষোলো বছর ধরে এই ললাটলিখন পরিষ্কার ভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। ছিল আর নেই। গত ২১ জুলাইয়ের লর্ডস থেকে আজকের ২১ অগস্টের ওভাল মাঠ। ঠিক এক মাসে অত্যাশ্চর্য ভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছে নতুন টেমপ্লেট। রাহুল শরদ দ্রাবিড় সফরকারী দলের গড়পরতা অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, যারা জমিয়ে ক্রিকেট খেলবে আর ড্রেসিংরুম থেকে রূপকথার সাক্ষী থাকবে। হ্যারি পটারের নায়কের নাম যেমন হ্যারি, এই রূপকথার নায়কের নামও তেমনি সবার জানা সচিন তেন্ডুলকর।
অথচ সিরিজ শেষের আগের দিন কেনিংটন ওভালে মহানাটকীয় পরিবর্তনের ছবি। সম্রাটের রাজ্যাভিষেক দেখতে তাঁর যে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এসেছিল, সে-ই কিনা উঠে এল ইংল্যান্ড গ্রীষ্মের সেরা রূপকথা হিসেবে। আর এই উনচল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সে, বিশ্বের প্রবীণতম ক্রিকেটার সাড়ে ছ’ঘণ্টা ব্যাট করে ফের নেমে এল ইনিংস ওপেন করতে। এ তো উপন্যাসে হয়!
ইংল্যান্ডে জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংস খেলে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর স্কোর মোটেও দ্রাবিড়োচিত দেখাচ্ছে না। দেখাচ্ছে, কট ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ বো সোয়ান ১৩। তবু ওভাল দর্শক উত্তুঙ্গ অভিনন্দনে ভাসিয়ে দিল তাঁকে। গোটা মাঠ দাঁড়িয়ে উঠে জানাল তাঁকে শেষ অভিবাদন। যেমনটা হয়তো ডনকে তাঁর শেষ টেস্ট ইনিংসে জানানো হয়েছিল। দ্রাবিড়, তিনিও প্রত্যুত্তরে ব্যাট তুললেন। এমন আবেগঘন বিদায় সংবর্ধনা কখনও কোথাও পাননি। কিন্তু এ বারের সফরটাই তো তাই। ভিড়ে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো ক্রিকেট মধ্যবিত্তের রাজ্য জয়ের সফর। |
|
গাওস্করকে টপকে যাওয়ার মুহূর্তে। ছবি এ এফ পি |
ব্যাট আর বলের লড়াই, ০-৪-কে সিরিজের শেষ দিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া এ সব তো উপলক্ষ। মূল গল্পের এক-একটা প্যারা। মূল কাহিনি নয়। সেটা বলছে যে, রাহুল দ্রাবিড় ভারতীয় সমাজজীবনের হালফিলের সবচেয়ে রোমখাড়া করে দেওয়া কাহিনি হিসেবে উঠে এলেন। যার উপপাদ্য হল: তোমার পাওয়া ন্যায্য থাকলে অ্যাকাউন্টেন্ট শেষ দিনেও পাওনা টাকা বাড়িতে দিয়ে যাবে। অতীত বিপর্যয়ে শুধু নিজেকে ভেঙে পড়তে দিও না। লড়াইটা জিইয়ে রেখো।
এমন গণবিপর্যয়ের হেরো সিরিজে ভারতের কেউ একক মহানায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, নমুনাই পাচ্ছি না। ১৯৫২-র ইংল্যান্ড সফরের বিনু মাঁকড় একমাত্র তুলনা হতে পারেন। কিন্তু ধারাবাহিক চার টেস্ট সিরিজে তিনটে সেঞ্চুরি, একটা ভুল আউটের সিদ্ধান্ত নিয়েও ৭৭ গড় নিয়ে ৪৬১ রান। বিনু মাঁকড়ও করেননি!
যে টিম ওভালের আগে সিরিজে ৩০০ করতে পারেনি। যে টিমের দ্বিতীয় সেরা ব্যাটসম্যান গোটা সফরে মোট করেছেন ২১৭ রান। সিম আর সুইং বিধ্বস্ত যে তোবড়ানো ব্যাটিং সংসারে দল সিরিজে মোট করেছে মাত্র ১৭৬১ রান, সেখানে একাই দ্রাবিড় করেছেন মোট রানের শতকরা ৩৯ ভাগ। ওভালে দ্বিতীয় ইনিংসেও তিনি ওপেন করতে যাওয়ার মতো অতিমানবিক ব্যাপার ঘটানোর আগে ভারত সিরিজে ব্যাট করেছে মোট ৪৩ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট। যার মধ্যে তেন্ডুলকর খেলেছেন ৯ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। লক্ষ্মণ ৮ ঘণ্টা ১ মিনিট। তিনিদ্রাবিড় ২৪ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। পরবর্তী ক্রিকেটপ্রজন্ম বিস্ফারিত হয়ে দেখবে এই কীর্তি যে, অপছন্দের ওপেনিংয়ে নেমে শেষ পর্যন্ত নট আউট থাকা শুধু নয়। গোটা সিরিজে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের শতকরা ৫৬ শতাংশ সময় তিনি ছায়া দিয়েছেন।
সচিন হতে পারেন ব্র্যাডম্যান বংশের মশালধারী। ওভালের প্রধান প্রবেশমুখ যাঁর নামে সেই জ্যাক হবস সদৃশ দেখাচ্ছিল রাহুলকে। গাওস্করকে মোট সেঞ্চুরিতে ছাপিয়ে গেলেন আর এ মাঠের অমর সেই ২২১-এর পাশে রাখলেন অপরাজিত ১৪৬-কে। ইংল্যান্ড সিরিজ জিততে পারে, রাহুলের রাজ্যাভিষেক থামাতে ব্যর্থ।
ইংল্যান্ডের ভেজা পিচে এক সিরিজে দু’বার তিনটে করে সেঞ্চুরি আর কেউ করেননি। ব্র্যাডম্যান বাদে। দ্রাবিড় বিশ্বের পয়লা নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার দিনে সেই ব্র্যাডম্যান সরণিতেও পা দিলেন। এ দেশে করা মোট সেঞ্চুরিতে এখন তিনি তিন নম্বরে। ব্র্যাডম্যান (১১) আর স্টিভ ওয়-র (৭) পরে। ভারতীয় ইনিংস অলআউট হওয়ার পর একটি তরুণের তুলে ধরা পোস্টারে ধরা রয়েছে এ বারের গোটা সিরিজ।
দ্রাবিড় ভার্সাস ইংল্যান্ড! একের বিরুদ্ধে এগারো!
ধৈর্য। ফিটনেস। শৃঙ্খলা। প্রতিজ্ঞা। টেকনিক।
এক-একটা জহরতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্রাবিড়ের ২০১১-র বিলাসবহুল বহুতল। আম আদমি থেকে ক্রিকেটের কেষ্ট-বিষ্টু যাকে হোক জিজ্ঞেস করুন, এক উত্তর পাবেন যে, এর মধ্যে সবচেয়ে দামি হীরে হল টেকনিক। যা রায়নাদের নেই, কখনও হওয়ার আশা নেই। তাঁর দ্রাবিড়ের চিরকাল ছিল। আজও আছে।
জীবজগতে সম্ভবত এক জন মনুষ্যই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নন। স্বয়ং দ্রাবিড়। তিনি মনে করেন এ বারের সাফল্যের পাসওয়ার্ড হল মন। বরাবরের মতোই। বিদেশে তাঁর মন হট্টগোল থেকে দূরে থাকে। ফাঁকা থাকে। গায়ের ওপর ভিড় করে মানুষ উঠে আসে না। মনঃসংযোগে সুবিধে হয়। তাই বিদেশে তাঁর গড় দেশের
চেয়ে এত উন্নত। এ হেন ব্যাখ্যায় একটাই ‘ফ্যালাসি’। হালফিল বিদেশেও তো তিনি রান পাচ্ছিলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যর্থ। ইংল্যান্ডে আগের সফরে ব্যর্থ।
দ্রাবিড় একমত। “যদি জানতাম মনটা ঠিক কোন রেসিপিতে তৈরি করলে সাফল্য অব্যর্থ, তা হলে তো সমস্যাই ছিল না। সেই পরশপাথরটাই তো খুঁজে যাই অবিরাম। যে দিন রান পেয়েছি তার আগের রাতে কী কী করেছি। কোন বই পড়েছি। কোন প্রোগ্রামটা টিভি-তে শুনছিলাম। কী খেয়েছি। সেগুলো রিপিট করি। তাতেও সব সময় মেলে না। সকালে উঠে দেখি মনের মশলাটা আগের দিনের মতো মাখা হল না তো! ব্যাট করতে যাওয়ার সময় সেই কনফিডেন্সটা পাচ্ছি না। তখন আবার নিজেকে বদলাই। ডায়েরিতে লিখে রাখি কী বদলালাম। তা থেকে কী পেলাম। ওই মশলা মাখানোটা নিরন্তর করে যেতে হয় এটা জেনেই যে, যা করতে চাইছি সেটা এতে পেতেও পারি। না-ও পেতে পারি। ক্রিকেটের মতো এক বলের খেলার এটাই সৌন্দর্য যে, কখনও আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না পাসওয়ার্ডটা জেনে গিয়েছেন। প্রত্যেকটা দিন নতুন দিন। নতুন অজানা চ্যালেঞ্জ। সেটায় যত ঝাঁপাবেন তত রোমাঞ্চ। যে দিন চাপের মুখে বিশ্রী একটা সেঞ্চুরি করবেন, মিডিয়া লিখবে বাজে। বিশেষজ্ঞরা বলবে হতশ্রী। আপনি নিজের পিঠ চাপড়াবেন, ঝোড়ো সফরে বিভ্রান্ত হতে হতেও জিতেছ এটাই তো সত্যিকারের টাফ সেঞ্চুরি। এর জন্যই তো ক্রিকেট খেলা। যে দিন ভাল খেলছ, ছন্দে আছ, সে দিন রান করার মধ্যে বীরত্ব কী আছে? বীরত্ব হল যে দিন ভাল খেলছ না, সে দিনও নিয়ন্ত্রণ এনে বড় রান করা...।”
কথা শুনতে শুনতে মনে হল ব্যাটিং ভঙ্গি দেখে একেবারেই বোঝা যায় না মানুষটা আসলে খাঁটি রোম্যান্টিক। প্রতিভায় মধ্যবিত্ত হতে পারে কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অসমসাহসী যোদ্ধা আছে যে সব সময়ই মধ্যবিত্ততা থেকে আভিজাত্যে উত্তরণের তুফানকে হারিয়ে বাজি জিততে চাইছে।
শেন ওয়ার্ন সফরের শুরু থেকেই বলে আসছেন, তাঁর কাছে ভারতের সেরা বাজি সচিন নন। দ্রাবিড়। আইপিএলে একসঙ্গে খেলার সময় থেকেই দেখছেন কী ভাবে ইংল্যান্ডের জন্য তৈরি হচ্ছেন দ্রাবিড়। টেকনিক্যাল পরিকল্পনা করছেন। মনকে শানাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সফল হওয়া তো প্রথম দুটো সেঞ্চুরিতেই হয়ে গিয়েছিল। রবিবার তিন নম্বরটার পর উচ্ছ্বাসে এমন ডুবে গেলেন কেন? মনে হয় না ওয়ার্ন এর ব্যাখ্যা করতে পারবেন বলে।
কোথাও মনে হচ্ছে, এর ব্যাখ্যা লুকিয়ে রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটসমাজের মধ্যিখানের একটা লম্বা সময় তাঁর প্রতি চরম ঔদাসীন্যে। বেঙ্গালুরু নিজেদের আইপিএল টিম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বকাপ জেতার পর কেউ মনেই রাখেনি তিনি যে ছিলেন গত বিশ্বকাপের অধিনায়ক। ধোনিরা সাদরে কুম্বলেকে ড্রেসিংরুমে ডেকেছেন। দ্রাবিড়কে কেউ ফোন করারও প্রয়োজন মনে করেনি। বরঞ্চ একটা হাবভাব ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, বুড়ো এ বার ছাড়ো। কত দিন আর বোর্ড সেক্রেটারির স্নেহধন্য হিসেবে বিরাট কোহলিদের জায়গা আটকে রাখবে!
রবিবারের নির্মম ক্রিজে আঁকড়ে থাকা... প্রতিটি সিঙ্গলসের জন্য অসীম খিদে... সাড়ে ছ’ঘণ্টা ব্যাট করেও ফের ওপেন করতে নেমে যাওয়া। কোথাও যেন তাঁকে মনে হচ্ছিল স্টপার-এর সেই কমল গুহ। বুড়ো প্লেয়ারদের
তারুণ্য ছাপিয়ে জেতার দিনে যে মানুষটার জেদ প্লেয়ারে ভর করে।
মাসের পর মাস জ্বলেছি রে আমি... আমাকে অগ্রাহ্য করে পার্টি হয়েছে। নাচানাচি হয়েছে... কেউ জানতেও চায়নি আমি কী ভাবছি... কেউ বলেওনি ফাইনালে থাকবে তো রাহুল ভাই... অপমান করে ওয়ান ডে থেকে বাদ দিয়েছে... আজ দ্যাখ আমি কী পারি। তোরা দশ জন হারবি...আমি হারের আগুনে জিতে সিদ্ধ হব।
বিতর্কিত দ্বিতীয় ইনিংসের আউটের পর ব্যাট তুলে দ্রাবিড় ফিরে যাচ্ছেন গোটা ওভাল মাঠকে সংবর্ধনায় আপ্লুত করিয়ে। তখন মনে হচ্ছিল মানুষের জীবনে তা হলে শেষ বিচার থাকেই! |
|
|
|
|
|