|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
জরুরি সংস্কার |
বিচারপতি নিয়োগের দায়িত্ব বিচারপতিদের হাতেই থাকা উচিত কি না, সেই প্রশ্নটি পুরানো। দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম ও সরকারি তহবিল তছরুপের দায়ে কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র সেনের ইমপিচমেন্টকে কেন্দ্র করিয়া তাহা আবার নূতন করিয়া উঠিয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকার একটি ‘জাতীয় বিচারবিভাগীয় কমিশন’ গড়িবার কথাও ভাবিতেছে বলিয়া জানা গিয়াছে। এই প্রস্তাবিত কমিশনটি গঠিত হইলে শীর্ষ আদালত এবং উচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ এই কমিশনের মাধ্যমেই নিযুক্ত হইবেন। এই সূত্রে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা ভাবিয়া দেখা দরকার। সৌমিত্র সেনের প্রশ্নে রাজ্যসভায় যে বিতর্ক ও আলোচনা চলিয়াছে, লোকসভাতেও যে সেই সর্বদলীয় ধিক্কারের পুনরাবৃত্তি ঘটিবে, এমন অনুমান স্বাভাবিক। কিন্তু এক অর্থে তাহা গৌণ প্রশ্ন। মুখ্য প্রশ্নটি বিচারব্যবস্থার আচরণ লইয়া। বিচারপতিরা নিজেরা যথাযথ আচরণ করিতেছেন না, এমন অভিযোগ সাম্প্রতিক কালে বারংবার উঠিয়াছে। অনেক ক্ষেত্রেই সেই অভিযোগ সরাসরি দুর্নীতির নহে, এমনকী প্রত্যক্ষ কোনও অন্যায় বা অনাচারেরও নহে, কিন্তু বিচারযন্ত্রের যন্ত্রীদের কাজে ও আচরণে যে নিখাদ নিরপেক্ষতা ও আত্মমর্যাদার পরিচয় থাকা জরুরি, তাহা হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। কেন? রাজ্যসভায় সৌমিত্র সেন-বিষয়ক বিতর্কে একাধিক সাংসদ বলিয়াছেন, সমস্যার একটি মূল সম্ভবত রহিয়াছে বিচারপতি নিয়োগের প্রচলিত পদ্ধতিতে। বিচারপতিরাই এই দেশে বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। তাহার ফলেই কি এক ধরনের আচরণ-শৈথিল্য প্রশ্রয় পাইয়াছে? প্রশ্নটি গুরুতর।
ভারতে অতীতে শাসনবিভাগ বিচারপতি নিয়োগের অধিকারী ছিল। সত্তরের দশকে তাহার পরিণাম ভাল হয় নাই, শাসনবিভাগের প্রতি ‘দায়বদ্ধ’ অর্থাৎ কার্যত বশংবদ বিচারব্যবস্থা তৈয়ারির উদ্যোগ ইন্দিরা গাঁধীর আমলে ভারতীয় গণতন্ত্রের অবক্ষয়কে তীব্রতর করিয়াছিল। সেই ব্যাধি নিরাময়ের উদ্দেশ্যেই বিচারপতি নিয়োগের দায়িত্ব বিচারপতিদের উপর ন্যস্ত হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলিতেছে, কেবলমাত্র শাসনবিভাগ বা কেবলমাত্র বিচারবিভাগ, কোনও একটিমাত্র বিভাগের হাতে সব দায়িত্ব না দিয়া মধ্যপন্থা অবলম্বনই শ্রেয়। রাজ্যসভার বিরোধী নেতা অরুণ জেটলি এবং সি পি আই এমের সীতারাম ইয়েচুরি সহ অধিকাংশ সাংসদই একটি জাতীয় বিচারবিভাগীয় কমিশন মারফত বিভিন্ন আদালতে বিচারক নিয়োগের পক্ষপাতী। এবং সেই কমিশনে শাসনবিভাগের প্রতিনিধিত্বও থাকা দরকার। লক্ষণীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টই কেন্দ্রীয় স্তরের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন, সেনেট তাহা অনুমোদন করে। ব্রিটেনে আগে প্রধানমন্ত্রী ও চ্যান্সেলরের পরামর্শক্রমে রানি এই নিয়োগ করিতেন, বর্তমানে বিচারবিভাগীয় কমিশনের সামনে প্রার্থী বিচারকরা আপন যোগ্যতার প্রমাণ দিতে প্রতিযোগিতায় নামেন।
ভারতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট নাগরিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া বিধেয়। এই বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিদের লইয়া গঠিত একটি কমিশন বিচারপতি নিয়োগের কাজটি সম্পন্ন করিলে সম্ভবত বিচারব্যবস্থার সংস্কার সাধিত হইতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত কমিশন হইতেই স্পষ্ট যে সেই ভাবনাটি শুরু হইয়াছে। প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মতো বিচারবিভাগের শীর্ষস্থানীয় আধিকারিকদের দুর্নীতিরোধক লোকপাল বিলের আওতায় আনার যে-দাবিতে অণ্ণা হজারে ও তাঁহার সমর্থকরা মুখর, জাতীয় বিচারবিভাগীয় কমিশন তাহা অংশত পূরণ করিবে। ইহা শাসন বিভাগ ‘বনাম’ বিচার বিভাগের লড়াই নহে। বিচারপতিদেরই উচিত বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ রাখিতে এবং শাসনবিভাগের সহিত ক্ষমতাবণ্টনে ভারসাম্য রক্ষা করিতে জাতীয় কমিশনের প্রস্তাবে সম্মত হওয়া। শাসনবিভাগ, বিচারবিভাগ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব সংবলিত জাতীয় কমিশন যদি সততার অধিকারী সজ্জন ও দুর্নীতিমুক্ত আইনজীবীদের বিচারপতি পদের জন্য সুপারিশ করে, তবে অবিচারের ধারাও অনেকাংশে হ্রাস পাইবার সম্ভাবনা। |
|
|
|
|
|