|
|
|
|
|
|
|
ভূত-কুকুরের তরজা
বন্ধ চোরের দরজা |
শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় |
রাত অনেক হল, বিল্টুর চোখে ঘুম নেই। কাল অঙ্কের ইউনিট টেস্ট। দশমিক আর ব্র্যাকেটরা চোখের সামনে নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মনে ভিড়ে আসছে আগের ইউনিট টেস্টের নম্বরগুলো। বেশি রাত পর্যন্ত অঙ্ক কষার তীব্র ইচ্ছায় আজ বিল্টুর একক রাত্রিবাস। মা-বাবা পাশের ঘরে। এ বারে ভাল করতেই হবে, ভেবে কোলবালিশ আঁকড়ে জানলার দিকে ফেরে।
ও মা, জানলায় ওটা কী বসে? আঁতকে ওঠে বিল্টু। অঙ্কের ভূত মাথা থেকে পগার পার। চোখের সামনে ঠিক যেন বসে আছে আসল ভূত। ছোট্ট, ঠিক বিল্টুর মতো। কালো, ন্যাড়া মাথা, জ্বলজ্বল করছে কালো দুটো চোখ। তার মধ্যে বাড়ির সামনে বেশ কয়েকটা কুকুরের অবিশ্রাম চিৎকার। চিৎকার করতে চেষ্টা করে বিল্টু, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোয় না। শুধু কী যেন একটা সুড়সুড় করে পা থেকে মাথার দিকে উঠছে আর মাথার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হচ্ছে। বুঝতে পারে বিল্টু, তার এ বার ভয় করছে।
বিল্টুর অবস্থা দেখে ভূত সাহস দিয়ে নাকী গলায় বলে:
নেই কোনও ভয়
বাঁচাও আমায়।
কুকুরগুলো পাজি
ধরল গলাবাজি
করল এমন তাড়া
ভয়েই যাব মারা।
কথা বলা ভূতের গল্প বিল্টু অনেক শুনেছে দিদিমার কাছে। কিন্তু অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাতেই যে সাক্ষাৎ এমন ছোট্ট ভূতের দেখা মিলবে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। গলার স্বর ফিরে পায় বিল্টু তুমি কি সত্যি ভূত? দাঁড়াও আগে আলোটা জ্বালাই।
জ্বালিয়ো না আলো
সত্যি ভূত, আমি ভাল।
এখানে তুমি এলে কী করে?
মশারিটা একটু তোলো, সব বলছি পরে।
ছোট্ট ভূত সুড়ুৎ করে বিল্টুর মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ল। ভূতটা তখনও রীতিমত হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সব কথা সে বিল্টুকে বলল কয়েক ঘণ্টা হল আমি ভূত হয়েছি। ভাল করে এখনও সব কিছু শিখতে পারিনি। হঠাৎ বেলাগাছের মাথা থেকে পড়লাম পা হড়কে। পায়ের শিরায় ধরল টান। কুকুরগুলো তাড়া করল। আজকের রাতটা আমায় তোমার কাছে থাকতে দাও, বলে ভূতটা কেঁদে ফেলল। ভূতের কান্না বিল্টুকে ব্যথিত করল। আর ভয় নেই। সে এখন রীতিমত ভূতের বন্ধু। ভূত বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছে, এ যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
বেশ, তুমি থাকবে কোথায়?
কাছেই ছিল বিল্টুর ওয়াটার বটল।
আমি তবে এর মধ্যে ঢুকি। ঢোকামাত্র ভূতের চিৎকার ওরে বাবারে, জলে ডুবে মরে গেলাম রে।
বিল্টু তাড়াতাড়ি বোতলের ছিপি খুলে ওকে বের করল। বলল খাটের নীচে জুতোর বাক্স আছে, ওর মধ্যে ঢুকে পড়ো। ‘গুড নাইট’ বলে ভূত বাক্সে ঢুকল। খানিক পরে বিল্টুও ঘুমের দেশে।
|
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
হঠাৎ পাশের ঘরে শুরু হল খুটখাট শব্দ। ঘুম ভেঙে গেল ভূতের। ভূত তড়াক করে জুতোর বাক্স থেকে বেরিয়ে দেখল, পাশের ঘরে চোর ঢুকেছে। সে বিল্টুকে ফিসফিস করে ডাকল। বিল্টু ভয়ে জড়সড়।
চোর! ওরে বাবা, কী হবে এখন?
মনে ভাবল আর কত কী হবে, কে জানে এক রাতে।
কোনও ভয় নেই। দেখো না চোরের কী হয়। একদম চুপ।
অন্ধকার ঘর। বিল্টুকে এক কোণে লুকিয়ে দাঁড় করাল ভূত। তার পর সে অদৃশ্য। বিল্টু দেখল, মা-বাবা অজ্ঞানের মতো ঘুমোচ্ছেন।
চোরের হাতে ছোট টর্চ। চোরটা আস্তে আস্তে টেবিলের ওপর রাখা বিল্টুর বাবার দামি ব্ল্যাকবেরি মোবাইলটার দিকে হাত বাড়াল। আশ্চর্য ব্যাপার! অমনি সেটা জায়গা বদল করে চলে গেল শোকেসের মাথায়। ভূতটা নিশ্চয়ই হ্যারি পটারের মতো ডাম্বেল ডোরের কাছে ম্যাজিক শিখেছে। হতভম্ব চোর এ বার শোকেসের ড্রয়ার খোলে। বিল্টুর বাবার পার্স। যেই নিতে যায় অমনি সেটা স্থান পরিবর্তন করে উঠে পড়ে ফ্রিজের মাথায়। খুব আনন্দ পায় বিল্টু। ঠিক যেন ঘরে মুভি চলছে। ম্যানড্রেক! এ বার চোর ভয় পায় আর অবাক হয়ে ভাবে নিশ্চয়ই কোনও অলৌকিক শক্তি ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। কিন্তু চোর দমবার পাত্র নয়। দশ বছরের চুরির অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে করে অপারেশন থ্রি-তে মনোনিবেশ করে। সোনার গয়না। বিল্টুর মা-র বালিশের তলা থেকে আস্তে আস্তে চাবি বের করে। আলমারির সামনে দাঁড়ায়।
ও কী, আপনাআপনি আলমারির দরজা খুলে যাচ্ছে! অভিজ্ঞ চোর ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। মাথা ঘুরতে থাকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দেখে লকারের দরজা খোলা। সামনেই রাখা হিরের নেকলেস। পরশুদিন বিল্টুর মা ওটা ওর পিসির বিয়েতে পরেছিলেন। এখনও সেটা ব্যাঙ্কের লকারে রাখা হয়নি। চোর যেই নেকলেসটায় হাত দেয়, অমনি তার শরীর অবশ হয়ে যায়। আতঙ্কে আলমারির সামনে দড়াম করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই শব্দে বিল্টুর বাবা-মা জেগে উঠে, সেই বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হন। জনশূন্য ঘরে নেকলেস হাতে শায়িত অজ্ঞান চোর।
বিল্টুর মা-বাবাকে দেখে ভূত ভয়ে বাক্সে ঢোকে। বিল্টু পাশের ঘর থেকে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালায়। ওর মা-বাবা কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। কেবল অবাক দৃষ্টিতে, এক বার চোরের দিকে এক বার বিল্টুর দিকে তাকান।
চোখে-মুখে জল দিতেই চোর উঠে বসে। নেকলেসটা বিল্টুর মা-র হাতে দিয়ে পা জড়িয়ে তার সে কী কান্না!
ভূতের বাড়ি। এ বাড়িতে চুরি কক্ষনও নয়।
ভোরের আলো ফুটতে আর বেশি দেরি নেই। বিল্টু তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে ভূতের কাছে গেল।
কোথায় তুমি? বেরোও তাড়াতাড়ি।
বেরিয়ে এল ছোট্ট ভূত।
বিল্টুকে বলল,
বন্ধু এ বার ফিরব ঘরে
কুকুর যদি আবার ধরে?
কোনও চিন্তা নেই। তুমি চোরের সঙ্গে যাবে। চোরদের সঙ্গে কুকুরদের সম্পর্ক খুব ভাল। ওদের কুকুররা কিচ্ছু করে না।
চোরকে পুলিশে না দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হল। ভূত চাপল চোরের কাঁধে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিল্টু। সে ছাড়া আর কেউ তো ভূতকে দেখতে পাচ্ছে না।
আবার এসো বন্ধু।
আসব আবার রাতেরবেলা/দু’জন মিলে করব খেলা।
বন্ধুকে বিদায় জানাতে বিল্টুর চোখ জলে ভরে গেল। বিল্টু দেখল, মাঠের ওপর দিয়ে চোর চলেছে আর তার কাঁধে মহাআনন্দে চলেছে ভূত। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে বিল্টুকে দেখছে আর হাত নাড়ছে। এক অভিনব দৃশ্য। |
|
|
|
|
|