তেত্রিশ বছর পরে জলে ভাসল গোঘাটের বিস্তীর্ণ এলাকা। দলকার জলা সংস্কারের অভাবকেই যার মূল কারণ বলে ঠাওরাচ্ছেন মানুষ।
দলকার জলা আসলে গোঘাট ১ ব্লকের নকুণ্ডা, শেওড়া, বালি এবং গোঘাট পঞ্চায়েতের কিছুটা অংশ-সহ পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার সুলতানপুর পঞ্চায়েতের ১০ হাজার হেক্টর নিচু জমি। বাঁকুড়ার দিক থেকে কংসাবতীর জল আমোদর এবং তারাজুলি খাল দিয়ে এসে নকুণ্ডার কাছে মজে গিয়েছে। প্রতি বর্ষার পরে এমনিতেই পাঁচ-ছ’মাস ডুবে থাকে সমস্ত মাঠ। পরবর্তী মাসগুলিতে আবার একেবারে শুখা চেহারা। স্বাধীনতার পর থেকে সংশ্লিষ্ট মোট ৪৪টি মৌজার প্রায় আশি হাজার মানুষের আশা, কবে জলা সংস্কার হবে। বংশানুক্রমে মানুষের দাবি, খালগুলি সংস্কার করে জলাধার তৈরি করা হোক। কিন্তু এ পর্যন্ত তেমন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। বার তিনেক উদ্যোগ শুরু হলেও আখেরে তা নিষ্ফল হয়েছে। বছর কুড়ি আগে গোঘাটের তৎকালীন বিধায়ক ফরওয়ার্ড ব্লকের শিবপ্রসাদ মালিকের উদ্যোগে সেচ দফতর এক বার জরিপের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু আর্থিক অনুমোদন না মেলায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৫ সাল নাগাদ জল বিভাজিকা প্রকল্পে ১ কোটি টাকা অনুমোদন করে রাজ্য সরকার। সেই টাকায় সংস্কারের কাজ না হয়ে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত-পিছু বিলি করে দেওয়া হয়। সেই টাকা কোন খাতে খরচ হয়েছিল, তার কোনও নথি পাওয়া যায় না। শেষ বার, ২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হুগলি জেলা প্রশাসনের তরফে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে জলা সংস্কারের উদ্বোধন হয় ঘটা করে। অনুমোদন মেলে ৫ কোটি টাকার। সে কাজও মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। |
নকুণ্ডা পঞ্চায়েতের গোয়ালপোতা গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক মিরাজ খান, কুলিয়া গ্রামের দীনবন্ধু মণ্ডল, কোটা গ্রামের ময়না দাস, শ্যাওড়া পঞ্চায়েতের বেলেকুসুমা, মুক্তারপুরের রাখহরি পোড়েল, স্বপন পাঁজার প্রমুখের বক্তব্য, “বংশানুক্রমে আমাদের দাবি ছিল, খালগুলি সংস্কার করে কয়েকটি জলাধার তৈরি করা হোক। তা হলে বর্ষা ও গ্রীষ্মে মাঠে সোনা ফলানো যাবে। এখন তো বর্ষায় চাষই হয় না। গ্রীষ্মে যে ক’জন চাষি মিনি বসিয়েছিলেন, তাঁরাও ভাল জল পাননি। আপাতত বিভিন্ন রকম ডালশস্য চাষই ভরসা। মাঠে জল মরে গেলে মুসুর, খেসারি প্রভৃতি বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বিনা সেচেই তা থেকে ফলন মেলে।” এলাকায় ডাল শস্য প্রসেসিং ইউনিট না থাকায় কলাইয়ের ভাল দাম মেলে না বলেও অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।
গোঘাট ১ ব্লকের সংশ্লিষ্ট ৪টি পঞ্চায়েতের ২৮টি গ্রামের হাজার পঞ্চাশ মানুষের ৯০ শতাংশই দিনমজুর। বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া জেলায় ধান কাটা, আলুবীজ লাগানো প্রভৃতি কাজ করেন। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে দলকার জলা সংস্কার নিয়ে গোঘাট ১ বিডিও জয়ন্ত মণ্ডলের বক্তব্য, “রাজনৈতিক উত্তেজনার জন্য কাজ বিশেষ এগোয়নি। তা ছাড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের সুলতানপুর পঞ্চায়েত এলাকায় জল আটকেই থাকছে। তা ছাড়া, বিস্তীর্ণ ওই এলাকার কাজ বর্ষার আগে মাস পাঁচেকের মধ্যে শেষ করা যাচ্ছে না। একটা বর্ষাতেই সংস্কারের অংশগুলি ফের বুজে যাচ্ছে। তিনি জানান, প্রকল্প বাবদ ৫ কোটি টাকার মধ্যে ২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।”
কিন্তু দলকার জলা বছরের বেশির ভাগ সময়ে জলমগ্ন হয়ে থাকলেও এ বারের মতো দশা হয়নি বহু দিন। এ বার গোঘাটের দু’টি ব্লকের ৫টি পঞ্চায়েত এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঘাটালের দিক থেকে আসা শিলাবতী নদীর জলর চাপ থাকায় গোঘাটের এই পঞ্চায়েতগুলিতে ৫-৬ ফুট জল জমেছে। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, নদীবাঁধ ভেঙে এই পরিস্থিতি হয়নি। দলকার জলা সংস্কারের অভাবেই এই প্লাবন। জলা সংস্কারে কোনও পদক্ষেপই করা হয়নি। |
কোটা গ্রামের অশীতিপর শীতল অধিকারী বলেন, “১৯৭৮ সালে একবার এ রকম পরিস্থিতি হয়েছিল। এখনকার মতো সব গ্রামগুলি দ্বীপের মতো জেগে ছিল। এ বার তো জল ক্রমশ বাড়ছে। ঘরে যা আছে, তাতে দু’চার দিন চলবে। সরকার অবিলম্বে ত্রাণ পাঠাক।” নকুণ্ডা এবং শেওড়া পঞ্চায়েতের মাঠে শুক্রবার প্রায় ছ’ফুট জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে। গ্রামগুলি কিছুটা উঁচু হওয়ায় বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু বাড়ির উঠোনে জল উঠলেও পরিস্থিতি সে দিক থেকে এখনও ততটা খারাপ নয়। এ দিন আরামাগের মহকুমাশাসক অরিন্দম নিয়োগী স্পিড বোট নিয়ে গোঘাটের কিছু গ্রামে আসেন। কিছু পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে আনার নির্দেশ দেন তিনি। বিডিও জয়ন্তবাবু বলেন, “সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ৭০ জনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাতে জল বাড়ার আশঙ্কায় তাঁরা গ্রামে থাকতে চাননি।” বিকেল থেকে গ্রামগুলিতে ত্রাণ যাচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের প্রতিনিধিরাও স্পিড বোড নিয়ে ঘুরছেন।
গোটা আরামবাগ মহকুমায় প্রায় ৮ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানিয়েছেন মহকুমাশাসক। ৫০০ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে। রাতে আরও জল বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা। তিনটি জায়গায় বাঁধ ভাঙার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও প্রশাসন সূত্রের খবর। মুণ্ডেশ্বরী ও দামোদর ফুলেফেঁপে উঠেছে। তারাজুলি খাল, মান্দারনে জল ঢুকছে হু হু করে। শুক্রবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসে পুলিশ-প্রশাসন। ১৯৭৮ সালের পরে গোঘাট এমন ভাবে প্লাবিত হয়নি বলে প্রশাসনও মেনে নিয়েছে।
খানাকুলের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর জল ঢুকেছে। আরামবাগের সঙ্গে বাঁকুড়া-মেদিনীপুর-সহ দক্ষিণবঙ্গের অন্য জেলাগুলির সংযোগের একমাত্র উপায় সড়ক পথ। সেখানে জায়গায় জায়গায় জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মূলত খানাকুল ২-এর সব ক’টি পঞ্চায়েত এবং খানাকুল ১ ব্লকের সন্নিহিত এলাকার অবস্থা সব থেকে উদ্বেগজনক। |