ঠিক সময়ে রোজা ভাঙার তাড়ায় দ্রুত ঘরে ফিরতে চেয়েছিলেন সদ্য তরুণ আশানুর গায়েন। বন্ধুদের নিষেধের তোয়াক্কা না করে তারাজুলি খালের উপচে পড়া জলে প্লাবিত রাস্তা পেরোতে যান। জলের তোড়ে বন্ধুদের চোখের সামনেই ভেসে গিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে এই ঘটনার পর থেকে তাঁর খোঁজ মেলেনি। আশানুরের বাকি তিন সঙ্গীও ভেসে গিয়েছিলেন স্রোতে। ভাগ্যক্রমে আটকে যান বাঁশঝাড়ে। গ্রামবাসীরা সকলকে উদ্ধার করেন।
গোঘাটের সুন্দরপুরে আশানুরের বাড়ি। কাছেই পশ্চিমপাড়ায় রাজমিস্ত্রির কাজে গিয়েছিলেন তাঁরা চার জন। বৃহস্পতিবার সকালে বেরিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, দুপুরের পরে কী ভাবে প্লাবিত হতে পারে এলাকা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, কাজ সেরে দুপুর আড়াইটে নাগাদ বাড়ির দিকে রওনা দেন ওই চার জন। মান্দারনে এসে দেখেন, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তার উপর দিয়ে বইছে জল। সকালে এই রাস্তা পেরিয়েই যখন গিয়েছিলেন, তখন পরিস্থিতি এমন ভয়ানক আকার নেয়নি। কিন্তু কংসাবতী ব্যারাজের ছাড়া জলে প্লাবিত হয় মান্দারন এবং তারাজুলি খাল। তারই জেরে ভেসে যায় রাস্তাঘাট। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, আরামবাগ মহকুমার বিভিন্ন অংশ বন্যাপ্রবণ হলেও গোঘাটের এই এলাকায় এমন প্লাবন তাঁরা গত তিরিশ বছরে দেখেননি। দলকার জলা সংস্কারের অভাবেই এই দশা।
চার সঙ্গীর মধ্যে ছিলেন রবিলাল খা। তিনি বলেন, “জলের তোড় দেখে আমরা কেউ রাস্তা পেরোতে চাইনি। সঙ্গে দরকারি জিনিসপত্র, মোবাইল ছিল। সব ভিজে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আশাই বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ঠিক সময়ে রোজা ভাঙতে হবে। জিনিসপত্র প্লাস্টিকে ভরে জল পেরিয়ে যেতে বলল। সঙ্গে একটা সাইকেল ছিল। আশা বলে, সকলে হাত ধরাধরি করে পেরিয়ে যাওয়া যাবে। কিচ্ছু হবে না।” আশা ও তার সঙ্গীদের সকলেরই বয়স আঠারোর আশেপাশে। নিমরাজি হয়ে রাস্তা পেরোনোর তোড়জোড় শুরু করেন সকলে। |
জলের মধ্যে কিছু দূর এগিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন, কাজটা উচিত হয়নি। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চার দিক দিয়ে তুমুল বেগে জল বইছে। পিছনে ফেরা আরও শক্ত। আশানুরের কাছে ছিল সাইকেল। হাতে হাত ধরে ছিলেন সকলে। হঠাৎই জলের তোড়ে হাতছাড়া হয়ে যায় সাইকেলটি। সেটিকে রক্ষা করতে গিয়ে হাত ছাড়িয়ে পড়ে যান ওই তরুণও। রবিলাল বলেন, “চোখের সামনে দেখলাম, ও জলে ওলটপালট খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছে। তত ক্ষণে আমরাও যে যার হাত ছেড়ে পড়ে গিয়েছিলাম জলে। কে কাকে বাঁচাবে! সকলে চিৎকার করতে থাকলাম।”
ওই আওয়াজে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তাঁরাই পরে উদ্ধার করেন তিন জনকে। কিন্তু শুক্রবার রাত পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি আশানুরের। গ্রামের মানুষ এ দিন বিকেলেও তারাজুলি খালে খুঁজেছেন আশানুরকে। তাঁদের ক্ষোভ, প্রশাসনের কাছে ডুবুরি চেয়েও লাভ হয়নি। এ দিন গ্রামে আসেন আরামবাগের মহকুমাশাসক অরিন্দম নিয়োগী। তিনি জানান, স্পিড বোট নামিয়ে তল্লাশি হয়েছে। ডুবুরিও চলে আসবে।” পুলিশ সূত্রের খবর, এমন জলের স্রোতের মধ্যে নদীতে নেমে খোঁজাখুঁজির জন্য বিশেষজ্ঞ দরকার। গ্রামের মানুষকে জলে নামতে বারণ করেছেন তাঁরা। ডুবুরি আনার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু শুক্রবার রাত পর্যন্ত কোথায় কী! ফলে, ক্ষোভ জমছে মানুষের মধ্যে। পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে বলেও অভিযোগ তাঁদের।
আশানুরের বাবা মুগলেশ গায়েন দিনমজুর। এ দিন তাঁদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল গোটা গ্রাম উপচে পড়েছে। বাড়ি বলতে অবশ্য একচিলতে মাথা গোঁজার আশ্রয়। দারিদ্র্যের চিহ্ন সর্বত্র। বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল। আজ, শনিবার আরামবাগের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আসছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। গ্রামের মানুষের বক্তব্য, ডুবুরি আজ বাদে কাল আসবে, সেই আশা তাঁদের আছে। কিন্তু গাঁয়ের ছেলে আশা কী আর ফিরবে? |