|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
পরিবর্তনের ফল |
বিচারে দোষী সাব্যস্ত না-হওয়া অবধি যে-কোনও অভিযুক্তকে নির্দোষ বলিয়াই গণ্য করিতে হইবে। প্রাক্তন মন্ত্রী, বর্তমান বিধায়ক এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ডাকসাইটে সি পি আই এম নেতা সুশান্ত ঘোষের সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। অভিযোগ প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত তাঁহাকেও নির্দোষ বলিয়াই গণ্য করিতে হইবে। তথাপি লক্ষণীয়, প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত তাঁহাকে সি আই ডি-র দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজতে পাঠাইয়াছে। সাক্ষীদের ভয় দেখাইয়া বিরূপ করার আশঙ্কা হইতেও তাঁহাকে এই হাজতে প্রেরণ। যে সকল আপাতগ্রাহ্য সাক্ষ্য বা প্রমাণ-এর ভিত্তিতে এবং শঙ্কার কারণে মেদিনীপুরের সি জে এম আদালত অভিযুক্তকে হাজতে পুরিল, সেগুলি কিন্তু নূতন কিছু নয়। গত সাত-আট বছর ধরিয়াই অভিযুক্ত মন্ত্রী ও তাঁহার সহযোগীদের বিরুদ্ধে, বস্তুত গোটা পশ্চিম মেদিনীপুর, এমনকী পশ্চিমবঙ্গেই শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সেই সব অভিযোগ উঠিয়াছে। যে-পুলিশ বা সি আই ডি আজ সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপের ভয়ে নেতাকে নিজেদের হেফাজতে লইতে চাহিয়াছে, তাহারা কেহই কিন্তু অভিযোগগুলিকে গুরুত্ব দেয় নাই, যত দিন না মহাকরণে শাসক বদল হয়। তবে কি শাসক পরিবর্তনই সত্যানুসন্ধানের এই তাগিদ সৃষ্টি করিল?
প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক, কেননা ছোট আঙারিয়া, সুচপুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই প্রভৃতি একের পর এক গণহত্যা ও তাহার প্রমাণ লোপের ঘটনা পুলিশ ও প্রশাসনের সামনে আনা সত্ত্বেও তাহারা তৎপর হয় নাই। বুক ফুলাইয়া অভিযুক্তরা পুলিশের চোখের সামনে ঘুরিয়া বেড়াইলেও তাহাদের গ্রেফতার করার কোনও উদ্যোগ দেখা যায় নাই, বরং অভিযুক্তরা ‘নিখোঁজ’ জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। সাক্ষীদের নিরাপত্তা দানের কোনও চেষ্টাও প্রশাসনের তরফে পরিলক্ষিত হয় নাই, ফলে সন্ত্রস্ত সাক্ষীরা ‘বিরূপ’ হইয়াছেন এবং অভিযুক্তদের বেকসুর খালাসের পথ প্রশস্ত করিয়াছে ইহাই বহুলপ্রচলিত ধারণা, যে ধারণা বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতে সঞ্জাত হয়। এ কথা মনে করার কারণ আছে যে, মহাকরণে শাসক বদল না হইলে অর্থাৎ শাসকরা রাতারাতি জনাদেশে প্রত্যাখ্যাত হইয়া ‘বিরোধী’তে পরিণত না হইলে ওই দলের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত কোনও অভিযোগই পুলিশ বা প্রশাসনের আমল পাইত না। প্রশাসন হাত গুটাইয়া থাকিয়াছে বা তাহাদের ঠুঁটো করিয়া রাখা হইয়াছে, ইহাই কিন্তু জনসাধারণের ধারণাতেও দৃঢ়মূল হইয়াছিল। যে-সব কারণে চৌত্রিশ বছরের শাসক দল ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়, এটি তাহার অন্যতম।
দুর্ভাগ্যবশত, সি পি আই এম তথা বামপন্থীরা জনসাধারণের এই বার্তার সঙ্কেত পড়িতে এখনও ব্যর্থ। আর তাই ফাটা রেকর্ডের মতো তাঁহারা ‘সুশান্ত ঘোষ চক্রান্তের শিকার’ ঘোষণাটি বাজাইয়া চলিয়াছেন। দল গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত, হাজতবাসী প্রাক্তন মন্ত্রীর পাশে বা সঙ্গে আছে, এই শপথের কথাও প্রত্যয়ের সহিত উচ্চারিত হইতেছে। ইতিপূর্বে অন্যান্য গণহত্যার নায়ক বা অভিযুক্তদের ‘দলের সম্পদ’ অভিহিত করিয়া মাল্যচন্দনে বরণ করা হইয়াছিল। ইহা এক বিশেষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়, যাহার পৌনঃপুনিক অনুশীলন বামপন্থীদের উত্তরোত্তর জনবিচ্ছিন্ন করিতে থাকে। বাম নেতৃত্ব এখন ‘আইন তাহার নিজের পথে চলিবে’ ইত্যাদি বলিতেছেন। আইনকে সত্য-সত্যই আপন পথে চলিতে দিলে, আইনি প্রক্রিয়ায় কোনও রূপ অন্তর্ঘাত না করিলে হয়তো এত দিনে গণহত্যা-মামলাগুলির নিষ্পত্তি হইয়া যাইত। বামপন্থীরা যদি ঘটনা হইতে শিক্ষা লইয়া আইনি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করেন, তবে দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনাও বাড়িবে। প্রশাসন এবং আদালতেরও অতঃপর কাজ হইবে বিচারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা। |
|
|
|
|
|