হুড়ার ডাকঘর নিয়ে তদন্তে ডাক বিভাগ
‘ভুয়ো’ প্রকল্পের কথা জানিয়ে তছরুপের নালিশ
‘ভুয়ো’ প্রকল্পের কথা জানিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে হুড়া থানার কুলাবহাল ডাকঘরের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ওই ডাকঘরে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে গ্রাহকেরা যে অর্থ লগ্নি করেছিলেন, তার মধ্যে হাজার হাজার টাকার কোনও হিসাব নেই। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত পোস্টমাস্টার নির্মলচন্দ্র মাহাতো ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। এই অবস্থায় নিজেদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে ঘোর সংশয়ে রয়েছেন গ্রাহকেরা। এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, যে প্রকল্পের কথা বলে পোস্টমাস্টার টাকা তুলেছিলেন, তেমন কোনও প্রকল্প আদৌ ডাক বিভাগের নেই।
তছরুপের ঘটনার তদন্ত চেয়ে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মানুষ। অভিযোগ করা হয়েছে ডাক বিভাগেও। অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ডাক বিভাগের পুরুলিয়া ডিভিশনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট গৌতম তরফদার। তিনি বলেন, “ওই ডাকঘরের পোস্টমাস্টারের বিরুদ্ধে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের অর্থ তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত শুরু হয়েছে।” ডাক বিভাগের পাশাপাশি পৃথক তদন্ত শুরু করেছে পুলিশও। গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলাও করেছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, তছরুপের পরিমাণ লক্ষাধিক টাকা। তবে ঠিক কত টাকা তছরুপ হয়েছে, তার নির্দিষ্ট হিসাব গৌতমবাবু জানাতে পারেননি। তিনি বলেছেন, “তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত টাকার পরিমাণ বলা যাবে না।”
অভিযোগকারীদের অন্যতম, কুলাবহাল গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জিত কর বলেন, “কিছু দিন আগে এই ডাকঘরের পোস্টমাস্টার নির্মলবাবু স্থানীয় বাসিন্দাদের বলেন, জঙ্গলমহলের গ্রামীণ ডাকঘরগুলির জন্য নতুন একটি প্রকল্প এসেছে। কেবলমাত্র মহিলারাই এই প্রকল্পে অর্থ সঞ্চয়ের সুযোগ পাবেন। ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা জমা রাখলে পাঁচ বছর পরে দ্বিগুণ অর্থ ফেরত পাবেন গ্রাহকেরা।” তাঁর দাবি, পোস্টমাস্টারের কাছে এমন আশ্বাস পেয়ে এলাকার অলোকডি, হুল্লুং হাতিবাড়ি ও কুলাবহাল গ্রামের বহু মহিলা এই প্রকল্পে টাকা জমা রাখতে শুরু করেন। সঞ্জিতবাবুর মা পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা জাহ্নবী মাহাতো নিজেও পোস্টামাস্টারের মুখে প্রকল্প সম্পর্কে শুনে ৫০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “টাকা জমা নেওয়ার পরে পোস্টমাস্টার ডাক বিভাগের যে ছোটমাপের রসিদ থাকে, তা গ্রাহকদের হাতে দেওয়ায় সন্দেহের অবকাশ ছিল না।”
তবু কারও কারও সন্দেহ হওয়ায় অন্যত্র খোঁজখবর শুরু করেন। সঞ্জিতবাবুর কথায়, “আমরা যখন পোস্টমাস্টারকে বলি, অন্য ডাকঘরে কিন্তু এ রকম কোনও প্রকল্পের খবর নেই, তখন উনি মাত্র ১৪টি ডাকঘরে এই প্রকল্প এসেছে বলে আমাদের জানান।” জাহ্নবীদেবী বলেন, “মে মাসের শেষ দিকে আমি ওই প্রকল্পে টাকা লগ্নি করেছিলাম। কিন্তু আমাকে কোনও সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। পোস্টমাস্টার বলেছিলেন, সার্টিফিকেট ডাকযোগে বাড়িতে চলে আসবে। ৫০ হাজার টাকার একটা রসিদও তিনি আমাকে দিয়েছিলেন।” দিন কয়েক পরে ওই মহিলাকে নির্মলবাবু একটি পাসবইও দেন। তাতে ‘ফাইভ ওয়াই টি ডি’ এবং একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর লেখা ছিল। ডাক বিভাগের কর্তাদের কথায়, “সম্ভবত পোস্টমাস্টার পাঁচ বছরের মেয়াদি আমানত (ফাইভ ইয়ারস টার্ম ডিপোজিট) বোঝাতে চেয়েছিলেন।”
সঞ্জিতবাবু জানান, তাঁর মাকে দিয়ে একটি ফাঁকা ফর্মে সই করিয়ে নিয়েছিলেন নির্মলবাবু। একই ভাবে জাহ্নবীদেবীকেও ফাঁকা ফর্মে সই করানো হয়েছিল। এখন জানা যাচ্ছে, সেগুলি রেকারিং অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম ছিল। এ দিকে ডাক মারফত সার্টিফিকেট আসছে না দেখে জাহ্নবীদেবীর স্বামী পিরুলাল মাহাতো ওই পোস্টমাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কোনও সদুত্তর না পেয়ে তিনি পুরুলিয়া সদর ডাকঘরে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার নয়, মাত্র ৫ হাজার টাকা জমা পড়েছে! আর যে প্রকল্পে টাকা জমা রাখার কথা পোস্টমাস্টার বলেছিলেন, তেমন কোনও প্রকল্পের কথা ডাক বিভাগের কর্তারা জানেনই না। এর পরেই গত ১৩ জুলাই ডাক বিভাগের পুরুলিয়া ডিভিশনের সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন জাহ্নবীদেবী। এই ঘটনার কথাও এলাকায় ধীরে ধীরে চাউর হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, জানাজানি হওয়ার পরেও পোস্টমাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও উপায় ছিল না। ওই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে ঝাড়খণ্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ইতিমধ্যে আরও অনেক গ্রাহক খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, যে পরিমাণ টাকা তাঁরা পোস্টমাস্টারের হাতে দিয়েছিলেন, জাহ্নবীদেবীর মতো তাঁদের অ্যাকাউন্টেও তার চেয়ে অনেক কম টাকা জমা রয়েছে।
অভিযোগ পেয়ে গত ২৩ জুলাই কুলাবহাল ডাকঘরে সরেজমিন তদন্তে এসে কয়েকশো গ্রামবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়েন ডাক বিভাগের কর্তারা। কুলাবহালের বাসিন্দা তথা ওই প্রকল্পে আমানতকারী সন্ধ্যা কালিন্দী বাঁশ কেটে ঝুড়ি তৈরি করে সংসার চালান। তাঁর কথায়, “আমি ১০ হাজার টাকা জমা করেছিলাম। এখন দেখছি, আমার অ্যাকাউন্টে মাত্র এক হাজার টাকা রয়েছে।” একই অভিজ্ঞতা ওই গ্রামেরই বাসিন্দা সাবিত্রী মাহাতোর। গ্রাহকদের উদ্বেগ, “পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। এখন আমাদের অর্থ ফেরত দেবে কে?” বস্তুত, এই প্রশ্নের সদুত্তর নেই ডাক বিভাগের কর্তাদের কাছেও। ডাক-বিভাগের সুপার গৌতমবাবু বলেন, “তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব নয়।”
এলাকার বাসিন্দা তথা জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক নরেন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজন ডাক বিভাগের উপরে বিশ্বাস করে তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ সঞ্চিত রেখেছিলেন। ডাক বিভাগের কাছে আমরা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করছি। পাশাপাশি এই কেলেঙ্কারির পিছনে আরও কেউ আছে কি না, খুঁজে বের করা হোক। তার পরে বিধি মোতাবেক তাদের শাস্তি দিক ডাক বিভাগ।” সম্প্রতি কুলাবহাল গ্রামে নির্মলবাবুর বাড়িতে গেলে কেউ কোনও কথা বলতে চাননি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.