|
|
|
|
|
|
জীবনের রহস্য খুঁজতে চাও কি |
মুখস্থ কোরো না। জৈবনিক বিষয়গুলি নিয়ে যদি উৎসাহ থাকে, যদি মনে করো খানিক সাধারণ বুদ্ধি
আর নিষ্ঠা তোমার আছে, তবেই জীবনবিজ্ঞান কিংবা বায়োটেকনলজি পড়াটা ভাল লাগবে। কৌস্তুভ পাণ্ডা |
না-হয় মানলাম জীবন বিজ্ঞানটা ভীষণ একঘেয়ে লাগে, কারণ তোমার মনে হয় এই বিষয়টা অনেকটা মুখস্থ বিদ্যার ওপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু বইয়ের বাইরে গিয়ে এক বার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কোনও দিনও কি প্রশ্ন করেছ যে তোমার এই বেঁচে থাকার পেছনে, বা তোমার আনন্দ, দুঃখ, উত্তেজনা, ভালবাসা, ঘৃণার পেছনে কী বিজ্ঞান বা রসায়ন কাজ করছে? কী করেই বা এই বিজ্ঞানকে আমরা নিজেদের হাতের মুঠোয় আনতে পারি, যাতে সমগ্র জীবন রহস্য আমাদের বোঝার এবং ব্যবহারের আওতায় চলে আসে? শুনলে মনে হতে পারে এটা একটা কাল্পনিক প্রকল্প। কিন্তু আজ আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছি যে এটা সম্ভব কত দিনে বা কতটা সম্ভব, তা শুধু সময় বলবে। শুধু সম্ভব নয়, আমরা চাইলে আমাদের জীবনের বিভিন্ন জৈবিক ত্রুটি এবং রোগের উপশম করতে পারব এবং ইচ্ছে মতো চালনাও করতে পারব। শুধু আমাদের নয়, আমাদের ঘিরে যে পশু, পাখি, গাছ বা জীবন-বৈচিত্র রয়েছে তাদেরও। এটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। অবশ্য কোনও ক্ষতিকারক উদ্দেশ্যে নিশ্চয় নয়, এই জীবন-বৈচিত্রের সার্বিক মঙ্গলের জন্য, তা রোগের উপশম হোক বা আমাদের আরও ভাল ভাবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যেই হোক।
কিন্তু এ কাজের জন্য আমাদের দরকার কিছু প্রতিভাবান এবং দূরদর্শী ছাত্র, যারা এই জীবন-রহস্যকে শুধু প্রশ্ন করতেই ভালবাসে না, তারা এই জীবন-রহস্যের সমাধান খোঁজার জন্য আগ্রহী। তুমি কি তাদের মধ্যে এক জন? আবার ভেবে দেখো। পরীক্ষায় জীবনবিজ্ঞানে কত নম্বর পেয়েছ ভুলে যাও, কারণ এই প্রশ্নের উত্তর যদি সুখকর না-ও হয়, তুমি দেখবে, তোমার পুঁথিগত বিদ্যার খুব কম প্রয়োজন পড়বে এই রোমাঞ্চকর বিষয়ের চর্চায়। শুধু তাই-ই নয়, সে দিন হয়তো লজ্জাও পাবে যে এত আকর্ষণীয় একটা বিষয়কে তুমি একটা মুখস্থের বিষয় বলে ভেবে এসেছ এত দিন। যেটা অবশ্য দরকার, সেটা হল নিষ্ঠা আর সাধারণ বুদ্ধি। ক্রমে দরকার হবে প্রযুক্তির ব্যবহার। হয়তো নতুন কোনও প্রযুক্তির আবিষ্কার। ‘আবিষ্কার’ শুনে ঘাবড়ে যেও না, কারণ তুমি নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার সঙ্গে যখন এই সত্যের খোঁজে নামবে, দেখবে, তোমার অজান্তেই আবিষ্কার তোমার দরজায় এসে পৌঁছেছে সেই দিনের আনন্দকে না-হয় না-ই বিশ্লেষণ করলাম পুরো মজাটাই চলে যাবে। তোমার এই চর্চার বিষয়ের একটা নাম থাকবে তা হল জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনলজি। এই বিষয়কে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে গতিশীল এবং প্রয়োজনীয় বিষয়ের মধ্যে ধরা হয়। কারণ এই বিষয়ের ভিতর দিয়েই পৃথিবী দেখতে পাবে আরও ভাল ভাবে বাঁচার রাস্তা। আর বায়োটেকনলজিস্ট হয়ে তুমি দেখবে সেই পথ। |
|
তোমার যদি উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান থাকে এবং জীববিজ্ঞান তার মধ্যে একটি বিষয় হয়, তা হলে তুমি ইন্টিগ্রেটেড এম এসসি পড়তে পারো বায়োটেকনলজি’তে। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এই কোর্সটি পড়ানো হয় এবং তার মান বেশ ভাল। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে অঙ্কটা ছেড়ো না, কারণ সব ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঙ্কের ওপর খুব জোর দিয়ে থাকে। আর তুমি এম বি বি এস করে থাকো বা যে-কোনও বিজ্ঞান বিষয়ে বি এসসি করে থাকো, তা হলেও বায়োটেকনলজি’তে এম এসসি বা ইন্টিগ্রেটেড এম-টেক করতে পারো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই এম এসসি কোর্স এবং আই আই টি-গুলিতে ইন্টিগ্রেটেড এম-টেক কোর্স পড়ানো হয়। কিন্তু ভুল করেও ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা প্রাইভেট কলেজগুলিতে না দেখেশুনে ঢুকে পোড়ো না। কারণ আমাদের দেশে এখন পড়াশোনা নিয়ে যে অনৈতিক ব্যবসা চলছে, তাতে ছাত্রস্বার্থের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। এবং তাই এই রকম কোর্সে ঢুকলে পরে তোমার বিষয়টা শেখা তো কিছুই হবে না, বরং তোমার জীবনের ক’টা মূল্যবান বছর নষ্ট হতে পারে। এই দিকে একটু নজর রেখো। আজকের দিনে
খালি ডিগ্রি পেলেই হবে না, সেটা উচ্চ মানের হওয়ার দরকার, যদি তুমি ভবিষ্যতে কিছু করতে চাও।
এ বার আসি কেন বললাম যে জীবনরহস্যের সন্ধানে নেমে, কিছুটা দূর এগিয়ে দেখতে পাবে যে পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন খুব কম পড়ছে। আসলে, জীবন বিজ্ঞান বা তার প্রয়োগের বিষয়টাকে একটা তথ্যের বোঝা হিসেবে দেখার জন্য পুরোটা তোমাদের দোষ দেওয়া যায় না। আসল দোষটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। আস্তে আস্তে পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থাটা এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে যেখানে কত তথ্য জানো, তার থেকেও বেশি দরকারি হবে তুমি তোমার কাজের জন্য তথ্য কোথা থেকে জোগাড় করবে সেই জ্ঞানের। যত দিন গড়াবে, তত তথ্যের সঞ্চার হবে এবং পৃথিবীর যে-কোনও বিষয়েরই সিলেবাস সেই সব দরকারি তথ্য এক সঙ্গে ধরে রাখতে পারবে না। এই কথাটা খেয়াল রেখেই পৃথিবীর উন্নতশীল দেশগুলি আস্তে আস্তে বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ার প্রথা চালু করছে। একে পরিভাষায় ‘ওপেন নলেজ রিসোর্স’-এর ব্যবহার বলা হচ্ছে। তোমরাও জানো, আজকের জগতে কম্পিউটারের সামনে বসে ‘গুগ্ল’ বা অন্য কোনও ‘সার্চ ইঞ্জিন’ দিয়ে যে-কোনও তথ্য পেতে পারো।
তাই ভবিষ্যতে তথ্যের ভার যত বাড়বে, তত পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন ক্রমশ কমে যাবে।
তোমরা হয়তো সেদিন দেখে যেতে পারবে, যে দিন আমাদের দেশে সব স্কুলেও এ রকম বই খুলে পরীক্ষা হবে। সেটা বই থেকে টোকার পরীক্ষা নয়, বরং কোন বইতে কোন প্রশ্নের উত্তর আছে, তা জানার পরীক্ষা।
যদি কোনও দিনও গবেষণা করো, তা হলে তোমাকে পুরোপুরি একটি নতুন তথ্যের সন্ধান দিতে হবে, যা আগে কারও জানা ছিল না। তোমার নতুন তথ্য দিয়ে নতুন বই লেখা হবে যা হবে তোমার ‘থিসিস’। সেখানে কোনও অনুকরণ করার সুযোগ নেই, নেই বই পড়ে বাজিমাত করার সুযোগ। তাই মুখস্থবিদ্যা কোনও দিন তোমাকে একটা পর্যায়ের ওপরে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই যে-কোনও বিষয়ে ভাল করতে বা সেটাকে নিয়ে উচ্চশিক্ষায় পাড়ি দিতে বুঝে পড়া এবং পড়ে আনন্দ পাওয়াটা ভীষণ দরকার। আর বায়োটেকনলজি’তে এম এসসি পড়ার পর, এই গবেষণা আজ তুমি যে-কোনও বিষয়ে করতে পারো, কারণ সব বিষয় এখন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। তাই এটাকে বলা হচ্ছে ইন্টারডিসিপ্লিনারি সায়েন্সের যুগ।
জৈব প্রযুক্তি বা বায়োটেকনলজি পড়তে গেলে তোমাকে প্রথমে বিষয়টাকে ভালবাসতে হবে। তোমার প্রথম প্রশ্ন হতে পারে বিষয়টা না জেনে বা পড়ে কী করে তাকে ভালবাসব? ঠিক, তাই বিষয়টার দিকে তোমার আদৌ যাওয়া উচিত কি না জানতে হলে নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখো যে, তুমি জীবন-রহস্য খোঁজাটাকে তোমার জীবিকা অর্জনের উপায় করতে চাও কি না। তুমি পৃথিবীর অসংখ্য দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ ও তাদের উপশম খুঁজতে ইচ্ছুক কি না। তুমি সেই দিন পৃথিবীকে দেখাতে চাও কি না, যে দিন আমাদের সব যানবাহন এবং যন্ত্র জৈব জ্বালানিতে চলবে, পেট্রল, ডিজেল বা কয়লার প্রয়োজন পড়বে না। তুমি সেই আশায় বিশ্বাসী কি না যে এক দিন আমরা আমাদের শরীর কী ভাবে একটা কোষ থেকে আস্তে আস্তে একটা সম্পূর্ণ জীবের রূপ ধারণ করে তা জানতে পারব, যে সব বিভিন্ন জীবন-প্রক্রিয়া দিয়ে আমাদের নিজেদের আর আমাদের চারপাশের জীবজগৎ-কে আরও সুখকর আর ব্যাধিমুক্ত করতে পারব। এ রকম আরও অনেক প্রশ্ন যদি তোমার মনে জড়ো হয়, আর সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াস তোমাকে অনুপ্রাণিত করে, তা হলেই তোমার বায়োটেকনলজি পড়া উচিত। |
|
শেষ করার আগে আর একটি কথা না বলে পারছি না। আমাদের বাঙালিদের ইঞ্জিনিয়ার আর ডাক্তার হওয়া ছাড়া আর কোনও গতি নেই, এই মনোবৃত্তিটা বর্জন করতে হবেএটা তোমাদের থেকেও বেশি তোমাদের মা-বাবাদের উদ্দেশ্যে বলছি। বরঞ্চ তোমরা যারা পড়াশোনায় ভাল করছ, তাদের আমাদের সমাজের দরকার এই জন্য যে ঘোর বিপজ্জনক যে সব জীবাণুকুল সর্বক্ষণ মানুষের সঙ্গে লড়াই করছে, হাজার অসুস্থতার কারণ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে তোমরাই ভরসা। এক সঙ্গে পনেরোটির বেশি জীবাণু যদি আমাদের সংক্রমণ করে, তা হলে আজও আমাদের কাছে কোনও প্রতিকার নেই মৃত্যু অনিবার্য। আর একটা কথা না বলেই পারছি না যা-ই করো, মনুষ্যত্ব হারিয়ো না, কারণ মানুষকে সেবা করতে হলে ওটাই সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। পেশাদারিত্ব জিনিসটার পিছনে ছুটতে গিয়ে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলো না। কেবল ভারত নয়, পৃথিবীর সব দেশ এখন চায়, তোমরা যারা সংবেদনশীল এবং প্রতিভাবান, তারাই তেমন কাজে নিজেদের নিয়োগ করো, যে কাজ মানব-সমাজের সঞ্চিত জ্ঞানকে অন্তত একটু হলেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি আমাদের সরকারের মধ্যেও এ নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা দেখা গেছে। সরকার স্থির করেছে, যারা বোর্ডের পরীক্ষায় এক শতাংশের মধ্যে স্থান লাভ করেছে, তারা যদি বেসিক সায়েন্স পড়ে গবেষণার দিকে এগোয়, তা হলে তারা এই প্রকল্প যার নাম ‘ইনস্পায়ার’ প্রোগ্রাম, তার থেকে বছরে আশি হাজার টাকা করে পাবে। টাকা দেবে ভারত সরকার। টাকাটা দরকার, কিন্তু অবশ্যই সবচেয়ে বড় কথা নয়। এই সম্মান থেকে জানবে যে গোটা দেশ আর মানব সমাজ তোমার দিকে চেয়ে আছে বাঁচার উপায় খোঁজার জন্য। আর তুমি যদি ভাল করতে পারো, চাকরির চিন্তা করতে হবে না। জীবন বিজ্ঞান বা জৈব প্রযুক্তি গঠিত যে-কোনও গবেষণা, শিক্ষা বা শিল্পজগতের চাকরি পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠবে।
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনলজি বিভাগের শিক্ষক
|
|
|
|
|
|