সঙ্ঘের পরে বিজেপিতে এ বার দাপট মঠতন্ত্রেরও
ছিল সঙ্ঘ। যোগ হল মঠতন্ত্রও!
বিজেপির রাজনীতিতে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার যেন অনেক সময়েই ‘রক্তকরবী’র রাজা। অর্থাৎ, তাকে চট করে চোখে পড়ে না, আসলে বিজেপির কুশীলবদের নিয়ন্ত্রণ করে সে-ই (সঙ্ঘ পরিবার)। কিন্তু রাজ্য-রাজনীতিতেও ধর্মগুরুদের এমন দাপট অযোধ্যা-কাণ্ডের সময় উত্তরপ্রদেশেও দেখেননি দলের শীর্ষ নেতারা। এটা ঠিকই, অশোক সিঙঘল থেকে আচার্য গিরিরাজ কিশোর, অথবা গুজরাতের প্রবীণ তোগাড়িয়ার রক্তচক্ষু অতীতেও সহ্য করতে হয়েছে বাজপেয়ী-আডবাণীকে। কিন্তু এ বার কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বদলের ঘটনায় দক্ষিণ ভারতের মঠতন্ত্রের এক অভূতপূর্ব নিয়ামক ভূমিকা টের পেলেন দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব।
বি এস ইয়েদুরাপ্পা রাজ্যের লিঙ্গায়েত জাতিভুক্ত নেতা। কর্নাটকের জনসংখ্যার ১৮ ভাগ লিঙ্গায়েত, রাজ্যের উত্তর ভাগে যাদের দাপট বেশি। কিন্তু গোটা রাজ্যে এই মুহূর্তে ছড়িয়ে আছে এই লিঙ্গায়েত জাতের বিশিষ্ট ধর্মগুরুদের প্রায় ২০০টি মঠ। এই ধর্মগুরুদের মধ্যে অন্যতম হলেন সিদ্দাগঙ্গা মঠের প্রধান, ১০৮ বছর বয়সের শিবকুমার স্বামীজি। এই মঠটি বেঙ্গালুরু থেকে কাছেই টুঙ্কুরে। ইয়েদুরাপ্পা এই ১০৮ বছর বয়সী ধর্মগুরুর বিশেষ ভক্ত। বয়স ১০৮ বছর হলে কী হবে, মানুষটির মস্তিষ্ক এখনও সজাগ।

ইয়েদুরাপ্পার গুরু
শিবকুমার স্বামী
এখনও তিনি রীতিমতো হেঁটে চলে বেড়ান। এ বার যখন ইয়েদুরাপ্পাকে ইস্তফা দিতে বলা হল, তিনি সোজা গুরুর শরণাপন্ন হলেন। এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কী নির্দেশ দিচ্ছেন, তার তোয়াক্কা না করে সেখানেই বসে রইলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, বিজেপির শীর্ষ পর্যবেক্ষক রাজনাথ সিংহ, অরুণ জেটলিকেও ওই ধর্মগুরুর শরণাপন্ন হতে হয়, যাতে ইয়েদুরাপ্পাকে ইস্তফা দেওয়ার পরামর্শ দেন এই ধর্মগুরু। শিবকুমার স্বামীজি বলার পরই ইস্তফা দিতে সম্মত হন ইয়েদুরাপ্পা। অর্থাৎ, রাজ্য নেতৃত্ব শুধু যে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠই দেখাচ্ছেন, তা-ই নয়, তাঁদের কাছে জাতিগোষ্ঠীর ধর্মগুরুই যেন আসল ‘হাইকম্যান্ড’!
এই ধরনের আঞ্চলিকতাকে সিপিএমের নেতারা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রীয় ঝোঁক। যেখানে আঞ্চলিক নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। দুর্বল করে দেয়। বলা হচ্ছে, কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির এখানে বড় অমিল। ইন্দিরা থেকে সনিয়া, কখনওই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দুর্বল হয়নি। দুই দলের মধ্যে আরও একটা তফাত আছে কর্নাটকের ক্ষেত্রে। দক্ষিণের এই রাজ্যে কংগ্রেস দীর্ঘদিন রাজত্ব করলেও কখনও জাতপাতের রাজনীতিকে গুরুত্ব দেয়নি, যেটা করছে বিজেপি।
কর্নাটকের রাজনীতিতে লিঙ্গায়েত জাতির এই মঠ এবং ধর্মগুরুদের ভূমিকা যথেষ্টই বেশি। কারণ, সাধারণ মানুষের উপরে এই ধর্মগুরুদের প্রভাব যথেষ্ট। এই মঠগুলি গোটা রাজ্যে হাজারেরও বেশি স্কুল-কলেজ চালায়। এমনকী, এদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও আছে। এদের কোষাগারে রয়েছে কোটি কোটি টাকা। দিল্লিতেও এদের বিরাট আশ্রম রয়েছে। নয়ডায় রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। বিজেপির শীর্ষ নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদের কথায়, “লিঙ্গায়েত জাতিগোষ্ঠী কর্নাটকের ওই মঠগুলি পরিচালনা করে ঠিকই। কিন্তু মঠগুলি রাজ্যের শিক্ষা প্রসারে যে কাজ করছে, তাতে অন্য জাতির মানুষকেও ব্যাপক ভাবে সামিল করেছে। তাই এদের জনসমর্থন বেশি।”
বস্তুত, কর্নাটকের নাগরিক সমাজে এদের প্রতি যে শ্রদ্ধা রয়েছে, সেটার সঙ্গে অনেকটাই তুলনা চলে পশ্চিমবঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের। তফাত হল, রামকৃষ্ণ মিশন কোনও রাজনীতিতে বিশেষ নেই।
বিজেপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, হাইকম্যান্ড এবং সঙ্ঘ পরিবারের পাশাপাশি বিজেপি রাজনীতিতে এ যেন এক তৃতীয় শক্তির অভ্যুত্থান। রবিশঙ্কর প্রসাদ বললেন, “উত্তর ভারতে মঠের দাপট সুবিদিত। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মঠের এই প্রভাব আমাদের অনেকটাই অজানা ছিল।”
কর্নাটকের রাজনীতিতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রভাব কিন্তু সীমিত। ব্রাহ্মণ হল শকতরা মাত্র ২ ভাগ। মূল যে জাতপাতের রাজনীতির মেরুকরণ, তাতে লিঙ্গায়েত ১৮ ভাগ এবং ভোক্কালিকা ১৪ ভাগ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া এবং বর্তমান বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ হলেন ভোক্কালিকা নেতা। লিঙ্গায়েতের দাপট যেমন উত্তর কর্নাটকে, ভোক্কালিকারা তেমনই দক্ষিণে বেশি শক্তিশালী। অতীতে কংগ্রেসের মধ্যে লিঙ্গায়েত নেতা ছিলেন বীরেন্দ্র পাটিল। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। আর এক মুখ্যমন্ত্রী নিজলিঙ্গাপ্পাও ছিলেন লিঙ্গায়েত নেতা। জনতা দলের রামকৃষ্ণ হেগড়েও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। কংগ্রেসের আর এক মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ ধর্ম সিংহ কিন্তু কর্নাটকের লোক নন। তিনি ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রাজপুত। যেমন, দীনেশ ত্রিবেদী অন্য রাজ্যের মানুষ হয়েও পশ্চিমবঙ্গের নেতা, বা সুশীলকুমার মোদী গুজরাতের হয়েও বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী। ইয়েদুরাপ্পা-বিরোধী বলে পরিচিত বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার বলেন, “অতীতে কিন্তু কর্নাটকের রাজনীতিতে কখনওই জাতপাত এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এখনও কর্নাটকের বিধানসভায় ৬৫ জন বিজেপি বিধায়কের মধ্যে ২৬ জন লিঙ্গায়েতের, ৩৯ জন নন।” এই তথ্য দিয়ে তাঁর মন্তব্য, “আগে কিন্তু লিঙ্গায়েত এবং ভোক্কালিকার মেরুকরণ এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আজ এই সমীকরণটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
বিজেপি সূত্র বলছে, বীরেন্দ্র পাটিল বা রামকৃষ্ণ হেগড়েদের জমানার অবসান হলে উঠে আসেন দেবগৌড়া, যিনি ভোক্কালিকাদের নেতা। তাঁর বিরোধিতায় নেমেই ইয়েদুরাপ্পাকে সামনে রেখে লিঙ্গায়েত ভোটকে সম্পূর্ণ করায়ত্ত করতে সমর্থ হয় বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ইয়েদুরাপ্পা আবার সুকৌশলে লিঙ্গায়েত ছাড়াও দলিত এবং তফসিলি জাতির শতকরা ২৫ ভাগ ভোটকেও করায়ত্ত করার চেষ্টা শুরু করেন। এমনকী, দেবগৌড়ার ছেলে কুমারস্বামীর সঙ্গে বোঝাপড়া করে ভোক্কালিকা সম্প্রদায়ের বিরোধিতা অনেকটা প্রশমিত করতে সক্ষম হয় বিজেপি। এখন তাই দুর্নীতির প্রশ্নে ইয়েদুরাপ্পাকে সরাতে বাধ্য হলেও তিনি যে পথ গড়ে গিয়েছেন, তা কোনও ভাবেই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার সুযোগ হারাতে চায় না বিজেপি। বরং ‘ব্র্যান্ড ইয়েদুরাপ্পা’কে সামনে রেখে বিজেপি আগামী দিনেও কংগ্রেসকে আটকে রাখতে চায়। বীরেন্দ্র পাটিলের বিদায়ের পর কংগ্রেসে লিঙ্গায়েত নেতা নেই। আর তাই অনন্ত কুমারদের কথা কানে না তুলে বিজেপি নেতৃত্ব ইয়েদুরাপ্পার পছন্দমতোই ৫৮ বছরের সদানন্দ গৌড়াকে মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। যিনি কিন্তু লিঙ্গায়েত নন, ভোক্কালিকা সম্প্রদায়ভুক্ত। তার থেকেও বড় কথা, তিনি ইয়েদুরাপ্পার অনুগামী।
কর্নাটকে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় হল বিহারের ভূমিহার সম্প্রদায়ের মতো। এই সম্প্রদায়ের অনেকেই ভূস্বামী এবং অর্থবান। ফলে সমাজে এদের প্রতিপত্তি রয়েছে। অষ্টম শতাব্দীতে বাসান্না নামে এক সন্ত এই অঞ্চলে ধর্ম এবং জাতি প্রথার সংস্কার করেছিলেন। তিনি বর্ণভেদ প্রথার নামে জাতপাতের বিরোধিতা করেন এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিছু অব্রাহ্মণ শিষ্যকে শিবলিঙ্গ দান করে পূজা করার অধিকার দেন। সে সময় ব্রাহ্মণ ছাড়া কারও শিবপূজা করার অধিকার ছিল না। বাসান্না বলেন, শিব অনার্য দেবতা। তাই সকলেরই শিবপূজার অধিকার আছে। এই অব্রাহ্মণ ভূস্বামীরা শিবপূজার অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে লিঙ্গায়েত জাতি গঠন করে। সেই লিঙ্গায়েত গোষ্ঠীরই আজ কর্নাটক রাজনীতিতে প্রবল দাপট। ইয়েদুরাপ্পা-পর্বে ফের সেটাই প্রতিষ্ঠিত হল।
Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.