|
|
|
|
|
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে মায়ের ‘অমৃতে’
বঞ্চিত সদ্যোজাতেরা
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
|
জন্মের ঠিক পরেই শিশুর প্রথম প্রতিষেধক কী?
চিকিৎসকেরা বলছেন, কোনও ওষুধ বা ইঞ্জেকশন নয়। শিশুর একেবারে প্রথম প্রতিষেধক হল কোলোস্ট্রাম। মায়ের স্তন থেকে নিঃসৃত এক ধরনের গাঢ়, হলুদ রঙের তরল। যা শিশুকে অধিকাংশ সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু সরকারি সমীক্ষা বলছে, এ দেশের অধিকাংশ শিশুই এই ‘অমৃতপান’ থেকে বঞ্চিত।
এসএসকেএম হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অরুণ সিংহের কথায়, জন্মের পরের প্রথম একটি ঘণ্টাই হল সুবর্ণ সময়। ওই সময়ে শিশুকে কোলোস্ট্রাম খাওয়ানো খুবই জরুরি। কারণ এটিই তার জীবনের প্রথম ‘প্রতিষেধক’। কিন্তু এ দেশের মাত্র ২৬ শতাংশ শিশু জন্মের ঠিক পরে এই ‘প্রতিষেধক’টি পায়। শিশু জন্মের পরে দুই থেকে তিন দিন কোলোস্ট্রাম বা হলুদ দুধ পাওয়া যায়। তা হলে কেন প্রথম এক ঘণ্টাকেই ‘সুবর্ণ সময়’ বলা হচ্ছে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, প্রথম ঘণ্টাতেই শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া জরুরি। সেটা কোলোস্ট্রামই দিতে পারে। তা ছাড়া, প্রথম ঘণ্টা থেকে শিশুকে স্তন্য খাওয়ানো হলে মায়ের বুকের দুধের পরিমাণও ক্রমশ বাড়ে। এমনকী শিশু স্তন্য পান করার ফলে মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন ক্ষরণ বাড়ে। তার ফলে তাঁর জরায়ু ছোট হয়ে আসে, তাঁর শরীরে রক্তক্ষরণ কম হয়। সুতরাং যদি কোনও মা অসুস্থও থাকেন, তাহলেও তাঁর কোলোস্ট্রাম সংগ্রহ করে শিশুকে খাওয়ানো জরুরি। ১ থেকে ৭ অগস্ট ‘বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ’কে কেন্দ্র করে চারপাশে যখন শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর উপযোগিতা নিয়ে নানা ধরনের প্রচার চলছে, তখন এই বিষয়টি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যকর্তা, শিশু চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের।
কেন শিশুরা এখানে বঞ্চিত হচ্ছে কোলোস্ট্রাম থেকে? কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতালে জন্মের পরেই শিশুকে মায়ের থেকে আলাদা করে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর, সরকারি হাসপাতালে মা ও শিশু এক সঙ্গে থাকলেও রোগীর বিপুল চাপে আলাদা ভাবে কোলোস্ট্রাম খাওয়ানোর ব্যাপারে মাকে উদ্বুদ্ধ করা বা সহায়তা করা হয় না বললেই চলে। |
কোলোস্ট্রাম কী?
প্রসবের পরে স্তন থেকে নিঃসৃত ঘন, হলুদ, আঠালো তরল |
কেন খাওয়ানো জরুরি? |
প্রথম প্রাকৃতিক প্রতিষেধক
দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে
|
ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া থেকে সুরক্ষা
জন্ডিস প্রতিরোধে কার্যকরী
|
প্রচুর কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন |
না খাওয়ালে কী হতে পারে?
প্রতিরোধ ক্ষমতায় ঘাটতি থাকে |
|
বেসরকারি হাসপাতালগুলির যুক্তি, সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে মায়ের যে শারীরিক অবস্থা থাকে, তাতে মায়ের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই শিশুকে নার্সারিতে রাখা হয়। যদিও স্ত্রীরোগ চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীরের বক্তব্য, এটা কোনও যুক্তি নয়। সিজারিয়ান ডেলিভারিতেও এখন ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে মাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয় না। তিনি বলেন, “আমরা চাই মা সন্তানের জন্মের সময় জেগে থাকুন, সন্তানের কান্না শুনুন। শিশুকে মায়ের সঙ্গে একই ঘরে (রুম-ইন) রাখাটাই বিজ্ঞানসম্মত। সদ্যপ্রসূতিকে তো বাচ্চার সঙ্গে একা রাখা যায় না। সঙ্গে নার্স রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নার্সের সংখ্যা কম বলে তারা সদ্যোজাতকে নার্সারিতে রেখে দেয়।” এই ভাবে শিশুকে নার্সারিতে রেখে দেওয়ার বিষয়টিকেই ‘বিপজ্জনক প্রবণতা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন অরুণবাবু। তিনি বলেন, “নার্সারিতে শিশুকে প্রথমেই টিনের দুধ খাইয়ে দেওয়া হয়। দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মানোর আগেই এ ভাবে বাইরের খাবার দেওয়াটা শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর।”
সরকারি হাসপাতালে শিশুর জন্মের পরে নার্সারিতে রাখার ব্যবস্থা অবশ্য নেই। কিন্তু সেখানেও শিশুকে কোলোস্ট্রাম খাওয়ানোর ব্যাপারে কেউ উদ্যোগী হন না। বহু হাসপাতালেই সদ্যোজাতকে প্রথম এক ঘণ্টা কিছু খাওয়ানো হয় না। কোথাও কোথাও শিশু কাঁদলে সামান্য জল খাওয়ানো হয়। শিশু চিকিৎসক প্রবাল নিয়োগীর কথায়, “কোলোস্ট্রাম এতটাই অল্প পরিমাণে বেরোয় যে বেশির ভাগ মা-ও মনে করেন, এতে শিশুর পেট ভরবে না, কোনও পুষ্টিও হবে না। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।”
তা হলে কি এ ভাবেই প্রাকৃতিক প্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে সদ্যোজাতরা? রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা শুভময় দত্তচৌধুরী বলেন, “সরকারি হাসপাতালে রোগীর বিপুল চাপের জন্য সদিচ্ছা থাকলেও সকলের প্রতি মনোযোগ দেওয়া যায় না। কিন্তু বিষয়টি যখন আমাদের ভবিষ্যত নাগরিকদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত, তখন সকলকে এগিয়ে আসতেই হবে। এ নিয়ে সরকারি স্তরে আমরা প্রচার চালাব।” বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর উপযোগিতা নিয়ে সচেতনতা আগের চেয়ে খানিকটা বাড়লেও কোলোস্ট্রাম নিয়ে এখনও সচেতনতা তলানিতে। সম্প্রতি পুরীতে এক বহুজাতিক পুষ্টি সংস্থা আয়োজিত জাতীয় স্তরের সম্মেলনে এই উদ্বেগের বিষয়টি সামনে এসেছে। ওই সংস্থার প্রধান, চিকিৎসক সঞ্জীব গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “একটা সময় পর্যন্ত কোলোস্ট্রামকে খারাপ জিনিস ভেবে ফেলে দিতেন অনেকে। এখন সেটা হয়তো ভাবা হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রেই শিশুরা বঞ্চিত থাকে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা উদ্যোগী না হলে ছবিটা বদলাবে না।” শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের কথায়, “শিশু-বান্ধব হাসপাতাল বলে এখন আর কিছু থাকছে না। কোলোস্ট্রামে এত অ্যান্টিবডি রয়েছে, যা রোগ প্রতিরোধে খুব জরুরি। এটা এমন এক প্রতিষেধক যা প্রকৃতি নিজে তৈরি করে দিয়েছে।” শিশু চিকিৎসক সুব্রত চক্রবর্তীও বললেন, “জন্মের পরে প্রথম ঘণ্টায় কোলোস্ট্রাম থেকে শিশুকে বঞ্চিত করা এক ধরনের ‘অপরাধ’। আমরা এ নিয়ে লাগাতার প্রচার শুরু করেছি।” |
|
|
|
|
|