|
|
|
|
নামের ভুলও বদলে গেল রসিকতায় |
‘আমরা-ওরা’ পেরিয়ে প্রথম সর্বদলেই সৌজন্যের বার্তা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
সহাস্যে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তিনি ‘দুঃখিত’। বিরোধী দলনেতার নামটা বারবার ভুল বলে ফেলেন। এর পর আর ভুল হবে না।
আর বিরোধী দলনেতা হাসতে হাসতে সংবাদমাধ্যমকে বললেন, “আপনারা ভেবেছিলেন সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে প্রচুর মতপার্থক্য হবে। তর্কাতর্কি হবে। গরম-গরম খবর পাবেন। এ দিন কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি!”
রাজ্যে শাসনক্ষমতায় পট পরিবর্তনের পর চুম্বকে প্রথম সর্বদল বৈঠকের ‘বার্তা’ এটাই। যে ‘বার্তা’ বলছে, অতীতের ‘আমরা-ওরা’র গণ্ডি পেরিয়ে পরস্পরের প্রতি ‘রাজনৈতিক সৌজন্য এবং সৌহার্দ্য’ দেখিয়েই সরকার এবং বিরোধীরা রাজ্যের স্বার্থবাহী নানা বিষয়ে কাজ করতে প্রস্তুত। যেখানে সরকার পক্ষ কাজ করতে চায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দিয়ে নয়। অন্তত এখনও পর্যন্ত।
যে কারণে বুধবার সর্বদল বৈঠকের পর বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রকে নিজের দফতরে ডেকে নিয়ে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা একান্তে বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বৈঠকের পর মহাকরণের ভিআইপি লিফট পর্যন্ত বিরোধী নেতা এবং তাঁর সহকর্মীদের এগিয়ে দিতে গেলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। যাতে স্বভাবতই পার্থবাবুর হাত ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন অভিভূত সূর্যবাবু। আর পার্থবাবু পরে প্রশ্নের জবাবে বললেন, “আমরা বিরোধীপক্ষে থাকার সময় এই মর্যাদা পাইনি। তা-ই বিরোধীদের মর্যাদা দিচ্ছি। কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।” |
|
সহ-মত দুরত্ব ঘুচিয়ে পাশাপাশি। সর্বদলের শেষে সূর্যকান্ত মিশ্র ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। - অশোক মজুমদার |
কখন এমন সরকার-বিরোধী ‘সৌজন্য এবং সৌহার্দ্য’ দেখল রাজ্য? যখন রাজ্য জুড়ে ‘সন্ত্রাসে’র প্রতিবাদে প্রতিদিন নিয়ম করে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন বামেরা। মহাকরণে সর্বদল বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার আগেও বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত নিহত ৩০ জন বাম নেতা-কর্মীর নামের তালিকা দিয়ে। হুগলির খানাকুলে সন্ত্রস্ত এলাকা ঘুরে এসে সূর্যবাবু চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এমন বেশ কিছু প্রাণনাশী অপরাধমূলক ঘটনা মা-মাটি-মানুষের সরকারের জন্মলগ্ন থেকে ঘটেই চলেছে, যা শুধু উদ্বেগজনক বললে যথেষ্ট হয় না’। সেই সূর্যবাবুই কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকের পরে বলেছেন, আলোচনা ‘খারাপ’ লাগেনি।
সে দিক দিয়ে বাস্তবিক পক্ষেই নয়া জমানার সর্বদল বৈঠক রাজ্যের পক্ষে যথেষ্ট ‘ইতিবাচক’ ইঙ্গিতবাহী। যার দিকে লক্ষ্য রেখে বিরোধী শিবিরের এক প্রথম সারির নেতা বলেছেন, “গুজরাতের স্বার্থে বিজেপি-র নরেন্দ্র মোদী এবং কংগ্রেসের আহমেদ পটেলের এককাট্টা হওয়ার কথা বহু শুনেছি। এ রাজ্যে এ দিন যে ধারা তৈরি হল, তা অক্ষুণ্ণ থাকলে আমরাও গোটা দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারি।”
মহাকরণে সর্বদল বৈঠকে ডেকে বিরোধীদের দফায় দফায় এমন ‘মর্যাদা’ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিন রাজনীতির ময়দানে বেশ কিছু ‘রান’ কুড়িয়েছেন বলে মনে করছে বিরোধী শিবিরেরই একাংশ। যে দু’টি বিষয় নিয়ে বৈঠক হল (পশ্চিমবঙ্গের নাম বদল এবং জেলা ভাগ), তাতে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার ছিল না। হয়ওনি। কিন্তু মমতা যা চেয়েছিলেন, নিঃসন্দেহে সেই ‘বার্তা’ দিতে পেরেছেন। সরকার পক্ষের ‘গণতান্ত্রিক চেতনা’ ও ‘রাজনৈতিক সৌজন্যে’র প্রশংসাই করে গিয়েছেন বিরোধীরা।
বৈঠকের পর সূর্যবাবু নিজেও জানিয়েছেন, শাসক ও বিরোধী পক্ষের নিয়মিত আদানপ্রদান রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশের স্বার্থে ভাল। তাঁরা ‘গঠনমূলক বিরোধিতা’র পথে হাঁটবেন বলে ভোটের ফলপ্রকাশের পরেই জানিয়েছিলেন বাম নেতৃত্ব। এ দিনের আলোচনাও তাঁদের সেই অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই একান্ত বৈঠক নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি বিরোধী দলনেতা। তবে বিরোধী শিবির সূত্রের খবর, দার্জিলিঙের ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় নিয়ে খোলাখুলি মত বিনিময় হয়েছে দু’জনের। বিরোধী শিবিরের উদ্বেগের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীও ‘সহমত’ পোষণ করেছেন।
বৈঠকের শেষে মহাকরণে সূর্যবাবু স্পষ্টই বলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন, সরকার যে দু’টি বিষয়ে বৈঠক ডেকেছে, সে দু’টি বিষয়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়েছে। বৈঠকে তাঁরা তার বিরোধিতা করবেন। কিন্তু বৈঠক-শেষে সূর্যবাবু, রবীন দেব, প্রবোধ সিংহদের পাশে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “রাজ্যের নাম বদল বা জেলা ভাগ কোনও বিষয়েই সরকার আগে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। সর্বদল বৈঠক ডেকে সকলের মতামত শুনতে চেয়েছে। এ দিন সেটাই করেছি।” আর সূর্যবাবু নির্দ্বিধায় কবুল করেন, “আমাদের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু বৈঠকে যোগ দিয়ে বুঝলাম, সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটা ভাল। সরকার এ সব বিষয়ে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। আমরা এর প্রশংসা করি। এ কথা আগেও বলেছি।” ঘটনাচক্রে, সেই সময়েই তৈরি হয় কিছু লঘু মুহূর্ত। যা আপাতদৃষ্টিতে ‘লঘু’ হলেও রাজ্যের রাজনীতির প্রেক্ষিতে যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
বৈঠকের বিবরণ দেওয়ার সময় মমতা বিরোধী নেতার নাম ভুল করে বলে ফেলেন ‘সূর্যকুমার মিশ্র’ (এর আগে বিধানসভাতেও মমতা একই ভুল করেছিলেন। তখন অবশ্য সূর্যবাবু সাফ বলেছিলেন, এর ফলে তিনি ‘অপমানিত বোধ’ করছেন। এ দিন অবশ্য তিনি তেমন কিছু বলেননি)। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য নিজেকে সংশোধন করে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “না না! সূর্যনারায়ণ।” তখন দেখা যায়, অনুচ্চ চেহারার মুখ্যমন্ত্রীর ডান পাশে দাঁড়ানো দীর্ঘকায় বিরোধী নেতা নিচু হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কানে কানে কিছু বলছেন। মুখ্যমন্ত্রীর বাঁ-পাশে দাঁড়ানো পার্থবাবুও মুখ্যমন্ত্রীকে কিছু বলেন। যুগপৎ যা শুনে মুখ্যমন্ত্রী নিঃসঙ্কোচে বলেন, “দুঃখিত, সূর্যকান্তবাবু। আমার খালি ভুল হয়ে যায়। আর ভুল হবে না।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যের নাম ও জেলা ভাগের বিষয়ে আগামী ১৯ তারিখ বিধানসভায় দ্বিতীয় বৈঠকটি হবে। পাশাপাশি তিনি জানান, পূর্ব মেদিনীপুরের নাম পরিবর্তন নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। আগে একটি প্রস্তাব এসেছিল (তাম্রলিপ্ত)। কিন্তু তা সরকারি প্রস্তাব ছিল না। ফলে পূর্ব মেদিনীপুরের নাম আপাতত অপরিবর্তিতই থাকছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য, স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিচার করে এবং কারও আবেগকে আঘাত না-করেই নাম পরিবর্তনের বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে পরবর্তী বৈঠকে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র দু’জনে মিলে এর মধ্যে গবেষক, ভাষাবিদ, ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে মতামত সংগ্রহ করে ওই বৈঠকে তা পেশ করবেন।” সর্বদল বৈঠকে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজ্যের নামের বিষয়ে পার্থবাবু এবং বিরোধী দলনেতাকে যৌথ দায়িত্ব দেন, সূর্যবাবু প্রথমে রাজি হতে চাননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিশেষজ্ঞদেরই এই কাজে নিয়োগ করা হোক। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে অনুরোধ করেন, বিশেষজ্ঞদের মত তাঁরা নিতেই পারেন। কিন্তু রাজ্যের নামের মতো একটি বিষয়ে তিনি বিরোধী দলনেতা ও বিধানসভার সহকারী নেতাকে একই সঙ্গে চাইছেন। সূর্যবাবু মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ মেনে নেন। |
|
|
|
|
|