|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অর্থপূর্ণ কাটা-জোড়ায় তৈরি |
অশোক সেন |
রবীন্দ্রনাথের বঙ্কিমচন্দ্র/বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, সম্পা: বিজলি সরকার। বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্র, ৩৫০.০০ |
বাঙালির ইতিহাসে, আধুনিক বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পরম্পরায় দুই অগ্রগণ্য মনীষী হলেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। নিজের পরবর্তী তরুণ প্রতিভাস্বরূপ রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র, টীকা-টিপ্পনি কত বিচিত্র এবং অর্থপূর্ণ তার সম্যক পরিচয় হল এই সংকলন গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। দু’টি কবিতায় বঙ্কিমচন্দ্রের উদ্দেশে সশ্রদ্ধ অভিনন্দনে পরিপূর্ণ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছিল কয়েকটি প্রবন্ধ, নানা টুকরো বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে মন্তব্য, বিশেষ সামাজিক উপলক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের তাৎপর্য বিশ্লেষণ, বঙ্কিমের সাহিত্যকৃতি প্রসঙ্গে অজস্র আলোচনা। সূচিপত্রে দ্রষ্টব্য এগারোটি অংশে বিভক্ত বিষয় নির্দেশের পর পাঁচটি পরিশিষ্টে বিন্যস্ত গ্রন্থটির সমগ্রতা। পাঠকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বিষয়ের ভাগাভাগি কমবেশি হতে পারে। তাতে মননের আয়তন ও বৈচিত্রে খুব কোনও হ্রাসবৃদ্ধি ঘটবে না। বিশেষজ্ঞ গবেষক তথা যে-কোনও মনোযোগী পাঠকের কাছেই বিশেষ প্রশংসাযোগ্য এই সংকলন।
তথ্যকে জানা এক কথা, তাকে গোছগাছ করে জানানোতে আরেক ব্যাপার। যেমন ‘প্রসঙ্গ বন্দে মাতরম্’ অধ্যায়। আঠারো পৃষ্ঠার মধ্যে নয় পৃষ্ঠার বিষয় ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নানাবিধ মন্তব্য থেকে উদ্ধৃতি, আর আট পৃষ্ঠা প্রাসঙ্গিক তথ্য, মুদ্রণ সৌকর্যের বিধিসম্মত একটি সাদা পৃষ্ঠা। প্রথম উদ্ধৃতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরু বিক্রম’ নাটকের ‘একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন...’। আর শেষ ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়ার এক ছাত্রসভায় গানটি ভুল উচ্চারণে গীত হওয়ার দরুন রবীন্দ্রনাথের বিরক্তিতে। বিরক্তি সমেত রবীন্দ্রনাথের ভাষণটি বিবৃত করতে গিয়ে ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ জানান যে, একটি গোলমেলে বাংলা রেকর্ড থেকে গানটি শেখার কারণে ছাত্রদের ওই দুর্দশা!
১৯০০-এ ‘সাহিত্য সম্মিলন’ আয়োজিত দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ দিনে নিজের ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘...অদ্যকার বাংলা ভাষার দল যদি গদিটা দখল করিয়া বসে তবে আর-সকলকে সেটুকু স্বীকার করিয়া যাইতে হইবে; মনে রাখিতে হইবে এই মিলনোৎসবের ‘বন্দে মাতরম্’ মহামন্ত্রটি বঙ্গ সাহিত্যের দান।’ বিশিষ্ট সব বাঙালি বিদ্বজ্জনের সঙ্গে সে দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। সভাপতি ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯০১-এ রচিত ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য যে নিছক বন্দে মাতরম্ হাঁক দিয়ে ইংরেজ শাসনের ন্যায়দণ্ড অটল রাখবার আগ্রহ এক ভ্রান্তিবিলাস। ১৯০৭-এ আবার একই নামে দ্বিতীয় প্রবন্ধে লিখছেন, ‘ইংরেজ আমাদের ব্যাধির একটি লক্ষণ মাত্র। লক্ষণের দ্বারা ব্যাধির পরিচয় পাইয়া ঠিকমত প্রতিকার করিতে না পারিলে গায়ের জোরে অথবা বন্দে মাতরম্ মন্ত্র পড়িয়া সন্নিপাতের হাত এড়াইবার কোনো সহজ পথ নাই।’
‘বন্দে মাতরম্’ অধ্যায়ের বৃহত্তম সংগ্রহ হল ঘরে বাইরে উপন্যাস থেকে পঁচিশটি উদ্ধৃতি। শুরু হচ্ছে নিখিলেশের উক্তিতে, ‘...দেশকে আমি সেবা করতে রাজি আছি। কিন্তু বন্দনা করব যাঁকে তিনি ওর চেয়ে অনেক উপরে। দেশকে যদি বন্দনা করি তবে দেশের সর্বনাশ করা হবে।’ আরও অনেক কথা ও কাহিনি পেরিয়ে মেজ বউঠানের সেই কটাক্ষ ‘আজ বুঝি ওদের বন্দে মাতরমের বৈঠক বসবে। ও লো, ও দেবী চৌধুরাণী, লুঠের মাল বোঝাই হচ্ছে নাকি?’ বা দারোগার তদন্তবার্তা যে ‘অমূল্য জানতে পেরেছেন কে চুরি করেছে, এই বন্দে মাতরমের হুজুক উপলক্ষে তাকে উনি চেনেন।’ কোথায়, কেমন করে, কত চেনা-অচেনার টানাপড়েনে জঙ্গম হয়ে এল বন্দে মাতরম্-এর অর্থ-অনর্থ। উপন্যাসটি ‘সবুজ পত্র’তে ধারাবাহিক প্রকাশ কালে (১৩২২ ব.) তর্ক-বিতর্ক লাগলে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য: ‘বন্দে মাতরমের নামে দেশে যে একটা দুষ্কৃতির ঢেউ উঠিয়াছে সেটার ত একটা Psychology আছে ‘ঘরে বাইরে’ গল্পে তারই আলোচনা চলিতেছে। আমি ইচ্ছা করিয়া আগে হইতে ভাবিয়া এ কাজে প্রবৃত্ত হই নাই আপনা-আপনি কেমন করিয়া আসিয়া পড়িয়াছে। শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরিয়া অপেক্ষা করিবেন।’
দেশে-বিদেশে রাজনীতিকে জনকল্যাণের অঙ্গাঙ্গী জ্ঞান করাই ছিল রবীন্দ্রনাথের আজীবন সংকল্প। দক্ষিণপন্থী বামপন্থী কোনও রকম নেতৃত্বের ‘রিয়াল পলিটিকাল’ (ন্যায় বিগর্হিত রাজনীতি) কাজকারবারে বিন্দুমাত্র প্রাণিত হলেন না রবীন্দ্রনাথ। আলোচ্য গ্রন্থটির বন্দে মাতরম্ প্রসঙ্গেও তার পরিচয় কম নেই। শান্তিনিকেতনে নিজের সত্তর বছরের জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে বলেন, “‘বন্দে মাতরম্’ যথেষ্ট হইয়াছে। এখন ‘বন্দে মাতরম্’-এর স্থানে বন্দে ভারতম্” হউক। জাতীয় পতাকা উড়াইয়া কিংবা তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা চরকায় কাটিয়া তোমরা স্বরাজ পাইবে না, জনসাধারণের জন্য গঠনমূলক কার্য্যের দ্বারা এবং তোমাদের দেশবাসীকে কার্য্যতঃ সেবা করিয়াই তুমি উহা অর্জন করিতে সক্ষম হইবে।’
আবার, ১৯৩৭-এ জওহরলাল নেহরুর জিজ্ঞাসার উত্তরে স্পষ্টই জানান রবীন্দ্রনাথ যে, ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির প্রথম দুই স্তবকে ভারত মাতার যে সুন্দর রূপ বর্ণনা আছে তা খুবই চিত্তাকর্ষক। বাকি গানটিতে দুর্গাস্তব মাফিক ধরন-ধারণের জন্য সকল ধর্ম নির্বিশেষে গ্রাহ্য না হওয়ার কারণ আছে। তবে আলাদা করে প্রথম দু’টি স্তবকের ‘নিজস্ব এমন একটা উদ্দীপনাময় বৈশিষ্ট্য আছে যাহা, আমার মনে হয়, কোন ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মনে আঘাত করে না।’ এ ভাবে জাতীয় সংগীত, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের চিন্তাভাবনায় স্তরে স্তরান্তরে জোড়-বেজোড়ের জটিলতা গ্রন্থটিতে কোনও একটি অধ্যায়ের বৈশিষ্ট্য নয়। আগাগোড়া নানা বিষয়ে এ রকম তথ্যসংগ্রহ, সূত্রনির্দেশ এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যের সমাবেশ থেকে সংকলনটিকে বলা যায় একাধিক জ্ঞানকাণ্ডে জড়িত সাংস্কৃতিক গবেষণার খুব অনুকূল এক সহায়ক গ্রন্থ।
যেমন উনিশ শতকের শেষ দিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পঞ্চভূত বইটিতে অন্তর্ভুক্ত সেই আলোচনা, যাতে ক্ষিতি বললেন, বঙ্কিম রচনায় স্ত্রী চরিত্রের মানসিক গভীরতা যদি-বা থাকে, কার্যক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নিতান্ত গৌণ। উত্তরে দীপ্তির মন্তব্য, ‘আনন্দমঠ তো কার্যপ্রধান উপন্যাস। সত্যানন্দ জীবনানন্দ ভবানন্দ প্রভৃতি সন্তান সম্প্রদায় তাহাতে কাজ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহারা কবির বর্ণনা মাত্র, যদি কাহারো চরিত্রের মধ্যে যথার্থ কার্যকারিতা পরিস্ফুট হইয়া থাকে তাহা শান্তির। দেবী চৌধুরাণীতে কে কর্তৃত্বপদ লইয়াছে? রমণী। কিন্তু সে কি অন্তঃপুরের কর্তৃত্ব? নহে।’ (পৃ. ২০১) আবার চোখের বালি উপন্যাসে বিধবা বিনোদিনীর কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরবার প্রসঙ্গে বিধবা বিবাহের আবশ্যকতা নিয়ে বিহারীর মন্তব্য। কিন্তু কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে তুলনা টানলে বিহারী বলেন, ‘থাক্, ও উপমাটা এখানে রাখো। তোমার এখানে উনি তো চিরদিন থাকতে পারেন না। তাহার পরে, যে বন দেখিয়া আসিয়াছি সেখানে উঁহাকে যাবজ্জীবন বনবাসে পাঠানো, সেও বড়ো কঠিন দণ্ড।’ (পৃ. ২০৪)
তাই তো সাহিত্যে সমসাময়িকতার (পৃ. ২১৬) আকর্ষণ বুঝতে ‘গোলেবকাওলি’, ‘মৎস্যনারীর উপাখ্যান’, ‘বিজয় বসন্ত’ অতিক্রান্ত কোনও নবকলেবর রোমান্সের তাৎপর্য আদৌ হারাননি বঙ্কিমচন্দ্র।
পাতার পর পাতা বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বড় করে অর্থপূর্ণ কাটা-জোড়ায় তৈরি এই সংকলন। |
|
|
|
|
|