নামেই উচ্চশিক্ষা। আসলে মুর্শিদাবাদ জেলার মতো মফস্সল এলাকার উচ্চশিক্ষা নিয়ে অন্তত এক দশক ধরে প্রায় ছেলেখেলা চলছে। জেলার কলেজ শিক্ষকেরাই অকপটে এ কথা কবুল করছেন।
মুর্শিদাবাদের ২৩টি কলেজের মধ্যে ১৫টিতে এক দশক ধরে অনার্সের পঠনপাঠন চলছে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক ছাড়াই। জেলা ছাত্রপরিষদের সভাপতি হাসানুজ্জামান বাপ্পা বলেন, “ওই ১৫টি কলেজের অনার্সের ক্লাসের জন্য ৯৩টি শূন্য পদে এক দশক ধরে কোনও পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। ফলে ভুগছে উচ্চশিক্ষা, ভুগছেন পড়ুয়ারা। ওই শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সপ্তাহ খানেক আগে অনশনও করা হয়েছিল।”
জেলার বাকি ৮টি কলেজের অনার্সের পঠনপাঠন চলছে বটে, কিন্তু সেগুলিতেও পূর্ণ সময়ের সিক্ষকের সংখ্যা কোথাও দুই কোথাও বা তিনি। ছাত্র সংগঠনের মতো শিক্ষক সংগঠনগুলিও দল মত নির্বিশেষে একই অভিযোগ করছে।
কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন ওয়েবকুটার মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক পার্থ দাস ইসলামপুরের আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বলেন, “২০০১ সালের পর থেকে মুর্শিদাবাদ আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে পূর্ণ সময়ের কোনও শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। বাংলা, ইংরাজি, ইতিহাস ও দর্শন মিলিয়ে ৪টি বিষয়ে অনার্স রয়েছে। অনার্স ও পাশ কোর্স মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় চার হাজার। অথচ পূর্ণ সময়ের শিক্ষক রয়েছেন সাকুল্যে ৪ জন। পঠনপাঠন দূরের কথা, ৪ জন শিক্ষককে ব্যস্ত থাকতে হয় ভর্তি সমস্যা, বি পি এল এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের সরকারি অনুদান বিলি করার মতো বিভিন্ন কাজে। ফলে শিক্ষার স্বাভাবিক বিকাশ এ জেলায় থমকেই রয়েছে। এ ব্যাপারে ওয়েবকুটার পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বার দাবি জানিয়েও লাভ হয়নি।” |
সমস্যা বরং তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। ভর্তি, পঠপাঠন ও কলেজের পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে বৃহস্পতিবার বহরমপুর সার্কিট হাউসে অধ্যক্ষদের নিয়ে মুশির্দাবাদ জেলাশাসক বৈঠক করেন। বৈঠকেও কলেজের পঠনপাঠানের বেহাল পরিকাঠামোর বিষয়টিও উঠে আসে। আর তার শেকড় খুঁজতে গিয়ে প্রসাসনের কর্তারাও বুঝতে পারেন সমস্যাটা আসলে কোথায়। অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) অজয় ঘোষ বলেন, “ওই বৈঠকে জানতে পারি জেলার কলেজ গুলিতে প্রায় ৩০০ জন শিক্ষকের পদ খালি পড়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে।”
তাতে অবশ্য সুফল মেলার সম্ভবনা কম। কারণ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অলোক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টই বলেন, “শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ার সমস্যাটি দীর্ঘ দিনের। ওই ব্যাপারে সরকার ও কলেজ সার্ভিস কমিশনে জানানো ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু করনীয় নেই। শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকার ও কলেজ সার্ভিস কমিশনে অনেক বার বলা হয়েছে।” কিন্তু সুরাহা না হওয়ায় আংশিক সময়ের শিক্ষকদের দিয়ে অনার্সের পঠনপাঠন চালানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা।
জিয়াগঞ্জের রানি ধন্যাকুমারী কলেজে রয়েছে বাংলা, ইংরাজি, ইতিহাস, ভুগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজ বিদ্যা মিলিয়ে ৬টি বিষয়ে অনার্স। কলেজের অধ্যক্ষ অজয় অধিকারী বলেন, “তার মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এক জন পূর্ণ সময়ের শিক্ষক রয়েছে। তাঁকে নিয়োগ করা হয় ২০০২ সালে। ওই কলেজে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগ সেই শেষ। ফলে বাকি ৫টি বিষয়ের জন্য এক জনও পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নেই। কলা ও বানিজ্য বিভাগ মিলিয়ে কলেজে পূর্ণ সময়ের শিক্ষকের সংখ্যা ৪ জন। বাকি ১১টি পদ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শূন্য পড়ে রয়েছে। আংশিক সময়ের শিক্ষকদের সপ্তাহে ১০টির বেশি ক্লাস দেওয়ার সরকারি নিয়ম নেই। ফলে বিভাগীয় প্রধান করে তাঁদের উপরও সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব দেওয়াও অসম্ভব। ফলে অনার্স চলছে বিভাগীয় প্রধান ছাড়াই।”
পাস কোর্সের পঠনপাঠনের দশা আরও করুণ। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের গত বৃহস্পতিবারের নির্দেশিকার ফলে ওই বেহাল দশা আরও বেড়ে যাবে বলে অধ্যক্ষদের আশঙ্কা। ভর্তি সমস্যা সামাল দিতে আগামী ১০ অগস্ট (৮ অগস্ট রাজ্য সরকার ছুুটি ঘোষণা করায় দিন পরিবতর্ন করা হয়েছে) একই দিনে মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার সব কলেজে ভর্তি করানো নির্দেশ দেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। জিয়াগঞ্জ আর ডি কে কলেজের অধ্যক্ষ অজয় অধিকারী বলেন, “একটি শ্রেণিকক্ষে কোনওক্রমে ২০০ জনকে ঢোকানো যাবে। সেখানে এ বার প্রথম বর্ষের পাশ কোর্সের একটি ক্লাসেই প্রায় ৬০০ ছাত্রছাত্রী। তাদের পড়াবো কোথায়?” ওয়েবকুটার জেলা সম্পাদক পার্থবাবু বলেন, ‘‘প্রথম বর্ষের পাস কোর্সের একটি ক্লাসে প্রায় দু’ হাজার ছাত্রছাত্রী। মুর্শিদাবাদ আদর্শ মহাবিদ্যালরে প্রাঙ্গণের মাঠ ছাড়া কোনও শ্রেণিকক্ষ নেই যেখানে তাদের জায়গা দেওয়া যাবে। ফলে বিগত বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, ভর্তি করানো গেলেও ক্লাস নেওয়া অসম্ভব।” উপাচার্য অলোকবাবুর অবশ্য সে পথে হাঁটতে নারাজ। তাঁর যুক্তি, “অধিকাংশই ক্লাস করতে চায় না। পরীক্ষায় বসার জন্য সবার ভর্তির দাবি উঠলেও বিগত বছরগুলির অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও পঠনপাঠনে সমস্যা হবে না।
অর্থাৎ, দিন বদলায় কিন্তু কলেজের পরিস্থিতি? না বদলায় না! |