|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি ১... |
|
ইতি অপর্ণা |
গতকাল মুক্তি পাওয়া ছবিটিতেই কি লুকিয়ে আছে তাঁর নিজের জীবন? সঞ্জয় সেন, কল্যাণ রায় থেকে
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দন থেকে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর। অনেকের সম্পর্কে,
অনেক কিছুর সম্পর্কে ইন্দ্রনীল রায়-কে তাঁর অনুভূতির কথা জানালেন অপর্ণা সেন |
চোদ্দো তলার ওপর সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্ট। বাইরে তখন ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। এরই মাঝে এল মুড়ি আর চা। কথা বলতে শুরু করলেন অপর্ণা সেন।
পত্রিকা: হঠাৎ আপনার মাথায় পাকা চুল দেখা যাচ্ছে? এটা কি নতুন স্টাইল স্টেটমেন্ট?
অপর্ণা: কেন ভাল লাগছে না? আমার বন্ধুরা তো খুব কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছে। যদি দেখতাম, খুব বিশ্রী ভাবে চুল পাকছে তা হলে নিশ্চয়ই রং করতাম। সেটা যখন হচ্ছে না তখন ভাবলাম ঠিকই আছে।
পত্রিকা: আচ্ছা ‘ইতি মৃণালিনী’ নিয়ে লোকের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সত্যি বলুন তো, মৃণালিনী কি আপনি?
অপর্ণা: হ্যা। মৃণালিনী অবশ্যই আমি। মৃণালিনী চরিত্রটাই দাঁড়াত না, যদি না আমি আমার ভেতরকার রিসোর্সগুলো ট্যাপ করতাম। ব্যাকগ্রাউন্ডের হয়তো তফাত আছে, কিন্তু আমার মানসিকতা আর মৃণালিনীর মানসিকতা অনেকটাই এক। মৃণালিনী যে পরিবেশে বড় হয়েছে সেটা ছিল আবদ্ধ। যা থেকে সে বেরিয়ে আসতে চায়। আমার বড় হওয়ার পরিবেশ কিন্তু অনেক মুক্ত ছিল। আমার ব্যাকগ্রাউন্ডটা শক্তপোক্ত ছিল। মৃণালিনীও প্রেসিডেন্সি কলেজেই পড়েছে। কফি হাউস একসময় আমাদের ঘরবাড়ি ছিল। কফি হাউসে আমরা শ্যুট করতে পারিনি। কারণ সত্তর দশকের সেই কফি হাউসের সঙ্গে আজকের কফি হাউস একদম মেলে না। তাই কলেজপাড়ারই ফেভারিট কেবিন রেস্তোরাঁয় শ্যুট করেছি। যেটা একদম আগের মতো আছে। সেই সময়ের কথায় ফিরলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা নিয়ে আড্ডা এগুলো আমাদের রোজকার জীবন ছিল। কিন্তু সেই আমি কোনও নকশাল ছেলের প্রেমে পড়লাম না কোনও দিন...
পত্রিকা: সচেতন ভাবে প্রেমে পড়েননি?
অপর্ণা: না, তা নয়। তখন আমি সঞ্জয়ের সঙ্গে এনগেজ্ড। সেই সময়ে আমি রাজনীতিতে আগ্রহীও ছিলাম না। মৃণালিনীও তাই।
পত্রিকা: কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতা তো ছিল?
অপর্ণা: খুব একটা নয়। সেটা পরে হয়েছিল।
পত্রিকা: তার মানে আপনি কলেজে পড়ার সময় থেকেই সঞ্জয়ের সঙ্গে এনগেজ্ড ছিলেন?
অপর্ণা: হ্যা। এনগেজ্ড মানে ওই আর কী। কোনও আংটি বদল হয়নি। সঞ্জয় আমার থেকে কিছুটা বড় ছিল। ওর একটা গাড়ি ছিল। যেটা নিয়ে আমরা ঘুরতাম। সবাই জানলেও অন্য ছেলেরা কিন্তু পিছনে লাগতে ছাড়েনি। সে তো সব মেয়েদেরই হয় কলেজে। একদিনের কথা মনে পড়ে। এক বার ট্রামে দু’টো লোক আমায় খুব জ্বালাচ্ছিল, সেটা দেখে অন্তত ছ’জন ছেলে এসে বলে গেল, “কোনও সমস্যা হলে আমায় বোলো”। আমি সবাইকেই ‘আচ্ছা’বললাম। (হাসি)। মৃণালিনীর সঙ্গে অমিলের জায়গাও প্রচুর। মৃণালিনীর যে রকম বিবাহের বাইরে একটি সন্তান হয়েছিল সে রকম আমার হয়নি। মৃণালিনী তার থেকে বয়সে অনেক ছোট এক পরিচালকের প্রেমে পড়ে। আমার সেই রকম কিছু হয়নি। তাই আমার পুরো ইতিহাসটা যদি মৃণালিনীর মধ্যে দেখতে যান তা হলে তা পাবেন না। কিন্তু ছবিটা দেখলেই বুঝতে পারবেন, এটা আমি। ঘটনার মিল নেই, কিন্তু মনের মিল আছে।
পত্রিকা: তা আত্মজীবনী না লিখে সিনেমা বানালেন কেন?
অপর্ণা: আমার আত্মজীবনী লেখার একটা অফার আছে। আমি মাত্র চার পাতা লিখেছি এ পর্যন্ত। (হাসি)। আই গট সো বোরড। আমি জানি, আমার জীবনটা অনেকের তুলনায় বৈচিত্রময়, কিন্তু কী লিখব বলুন তো নিজের সম্বন্ধে...?
পত্রিকা: একদিন না একদিন তো লিখবেনই। কী নাম হওয়া উচিত আপনার আত্মজীবনীর?
অপর্ণা: চব্বিশ ফ্রেম পার সেকেন্ড হচ্ছে নরমাল স্পিড। কিন্তু এত দিন পরে পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, সিক্সটিন ফ্রেম্স পার সেকেন্ডের মতো তাড়াতাড়িতে সব হয়ে গেল। সিক্সটিন ফ্রেম্স পার সেকেন্ড হতে পারে নাম... আত্মজীবনীর।
পত্রিকা: লোকে বলছে ‘ইতি মৃণালিনী’ আপনার তৈরি সব চেয়ে বেশি বাণিজ্যমনস্ক ছবি...
অপর্ণা: হ্যাঁ, তা ঠিক। তার কারণ, কমার্শিয়াল সিনেমার অনেক উপাদান এসে পড়েছে। আমার সিনেমায় এখানে এই প্রথম আধুনিক গান ব্যবহার করলাম। আমার সিনেমা মানেই ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত বা ফোক। কিন্তু আধুনিক গান ব্যবহার করলাম। কারণ মৃণালিনী বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা। টু কিপ সাম সিনার্জি উইথ মৃণালিনী’জ জনার অফ ওয়ার্ক। তার পর মৃণালিনীর সাফল্যের পর সেই সত্তরের দশকের টিপিক্যাল ওয়াইল্ড সাইড যেটা আমাদের সবার মধ্যেই ছিল সেগুলোও দেখিয়েছি। স্মোকিং জয়েন্টস, লেট নাইট পার্টি সব আছে ছবিতে। |
|
ছবি: রাসবিহারী দাস |
পত্রিকা: আপনি কি সেই সময়টাকে মিস করেন?
অপর্ণা: নট রিয়্যালি। আমি অতীতের মধ্যে থাকি না। আই অ্যাম ভেরি মাচ আ ওম্যান অফ দ্য টাইমস।
পত্রিকা: ছবিতে একটা দৃশ্য আছে, যেখানে মৃণালিনীর বদলে প্রযোজক অন্য আর এক নায়িকাকে ছবিতে নিচ্ছেন। কারণ সেই প্রযোজকের মৃণালিনীর ওপর আস্থা নেই। এমনটা কি আপনার জীবনেও ঘটেছে?
অপর্ণা: হ্যাঁ, ঘটেছিল। সেই প্রযোজকের আমার বক্স অফিস ভ্যালুর ওপর কোনও আস্থা ছিল না। আমার জায়গায় অন্য এক নায়িকাকে নিয়েছিলেন ছবিতে। এই ঘটনাটা ঘটে একেবারে আমার কেরিয়ারের গোড়ায়। পরে আমি যখন কিছুটা সফল হলাম, তখন সেই প্রযোজক আমার কাছে এসেছিলেন। আমি ওঁকে বলেছিলাম, যখন ডেট দিতে পারতাম তখন আপনি আমাকে চাইলেন না। এখন আপনাকে আমি ডেট দিতে পারব না। এই সিকোয়েন্সটা ছবিতে রেখেছি।
পত্রিকা: আপনার জায়গায় সেই ছবিতে কাকে নেওয়া হয়েছিল?
অপর্ণা: (হাসি) তা মনে নেই। আর মনে থাকলেও বলতাম না।
পত্রিকা: যখন আপনি সম্পাদক ছিলেন, সেই সময় আপনার অধীনে কর্মরত কোনও সাংবাদিক যদি এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর বের করে না আনতে পারতেন তা হলে বকতেন না তাঁকে?
অপর্ণা: তা বকতামই। ডাব্ল স্ট্যান্ডার্স!
পত্রিকা: সেই নায়িকা কি এখনও জীবিত?
অপর্ণা: হ্যাঁ, ছবিটার নাম ছিল বোধহয় ‘হঠাৎ দেখা’। এইটুকুই বললাম। কিন্তু অন্য কেউ আমার কাজটা করেছিল বলে আমার মনে কোনও ক্ষোভ নেই আজ।
পত্রিকা: এই ছবিতে মৃণালিনীর জীবনের বিভিন্ন পুরুষকে দেখা যাবে, তাই না? ছবিতে সাহেব ভট্টাচার্য আছেন, রজত কপূর আছেন, কৌশিক সেন আছেন, আছেন প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে কল্যাণদা কে?
অপর্ণা: কল্যাণদা (রায়) নেই। (ভেবে) কল্যাণ নেই। আমি জানতাম, এই ছবিটাকে ঘিরে এই রকম একটা ভয়্যারিস্টিক কৌতূহল থাকবে। সে দিক থেকে দর্শক কিন্তু হতাশ হবে। তারা বড় জোর মিলের আন্দাজ করতে পারবে। আমার জীবনটা খোলা খাতার মতো। তা সত্ত্বেও যদি তাঁরা মিল খুঁজতে চান তো খুঁজুন। তা নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই।
পত্রিকা: আপনার জীবনে একাধিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সব সম্পর্কের সমাপ্তিও যে খুব সুখের হয়েছে তা নয়। আজ এই পর্বে এসে প্রেম বা সম্পর্ক নিয়ে কী মনে হয়?
অপর্ণা: হ্যাঁ, সব সম্পর্কের শেষ যে মধুর হয়েছে তা নয়। তবে কী জানেন, আমার মতে মানুষে মানুষে একটাই স্থায়ী সম্পর্ক হয়। বন্ধুত্ব। সেটাই আমরা প্রেম, বাৎসল্য, সখ্য ইত্যাদি নানা নামে ডাকি।
পত্রিকা: আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক?
অপর্ণা: দেখুন, স্বামী-স্ত্রীর রোম্যান্টিক প্রেম তো বেশি দিন থাকে না। সেটা থাকবেও না। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী যদি বন্ধু হয়, তা হলে সেই প্রেম কিন্তু থেকে যায়। জীবন থেকে এটাই শিখেছি।
পত্রিকা: আচ্ছা অপর্ণা সেনকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, প্রেমে ব্যর্থ হলে কী ভাবে মনে জোর আনা যায়? এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ?
অপর্ণা: আমি কি মনস্তাত্ত্বিক? বলতে পারি, যে মানুষটি আপনার হৃদয় ভেঙেছে তার খারাপ দিকগুলো মনে আনার চেষ্টা করুন।
পত্রিকা: অপর্ণা সেনের পরে আর কোন নায়িকার নাম করা যায়, যিনি একাধারে সুন্দরী, সেক্সি এবং বুদ্ধিমতী?
অপর্ণা: সেটা আমি কী করে বলব? (হেসে) আসলে অপর্ণা সেনের সব চেয়ে বড় সুবিধে ছিল তার ব্যাকগ্রাউন্ড। (ভেবে) তবে জানেন, মুনমুনের মধ্যেও কিন্তু সেই ব্যাপারটা ছিল। পরমা সুন্দরী। দারুণ বুদ্ধিমত্তা। দুর্দান্ত ফটোগ্রাফার। ভাল কথা বলত। ভাল ছবি আঁকত।... ও ছবি বানাল না কেন কে জানে.... বানালে ভাল ছবিই বানাত। ও বেশি সুন্দরী হওয়াতেই বোধহয় ওর মুশকিল হল।
পত্রিকা: শর্মিলা ঠাকুর আর আপনি ‘অন্তহীন’-এ কাজ করলেন। আপনাদের মাত্র এক দিনের শু্যটিং ছিল একসঙ্গে। কিন্তু শুনেছিলাম, সবাই সে দিন সেটে তটস্থ ছিলেন। সেটা কেন?
অপর্ণা: আমার কোনও আইডিয়া নেই। রিঙ্কু কিন্তু আমার ভাল বন্ধু। বাবা মারা যাওয়ার পরে সে দিন ফোন করেছিল।
পত্রিকা: দু’জন নায়িকা বন্ধু হতে পারে নাকি?
অপর্ণা: কেন পারবে না? আমার তো অনেক মেয়ে বন্ধু আছে।
পত্রিকা: মেয়ে বন্ধু থাকতে পারে, কিন্তু অভিনেত্রী বন্ধু?
অপর্ণা: আমার থেকে অনেক ছোট হলেও এখনকার মেয়েদের মধ্যে রূপা (গঙ্গোপাধ্যায়), গার্গী (রায়চৌধুরী), অনন্যা (চট্টোপাধ্যায়), এরা সবাই আমার বন্ধু। হাসি মানে সুমিত্রাও (মুখোপাধ্যায়) আমার বন্ধু ছিল। আমাকে রিনাদি বলে ডাকত। বলত, তুমি আমার সমবয়সী কী আমার সামান্য ছোটও হতে পার, তাও তোমাকে শ্রদ্ধা করি বলে রিনাদি বলে ডাকি। কে আমাকে রিনাদি বলল, কেন বলল না...এ সব নিয়ে আমার কোনও দিন মাথাব্যথা ছিল না। তবে সত্যি যদি কোনও অভিনেত্রী আমার বন্ধু হয়ে থাকে, সেটা শাবানা আজমি।
|
|
‘ইতি মৃণালিনী’তে কঙ্কণা আর সাহেব |
পত্রিকা: শাবানা আজমিকে কোনও দিন বলেননি পরিচালক হতে?
অপর্ণা: ‘গুলেল’ যখন বানানোর কথা হয়েছিল, শাবানা আমায় অ্যাসিস্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, এটা একটা সাময়িক ইচ্ছে। ওর আসল আগ্রহ হল রাজনীতি আর সমাজসংস্কারে।
পত্রিকা: সেটা তো আপনারও আগ্রহের জায়গা...
অপর্ণা: রাজনীতির থেকেও আমার আসল আগ্রহ ইস্যুতে। যেমন লালগড় বা নন্দীগ্রামের সময় হয়েছিল। নন্দীগ্রাম যখন ঘটল, আমার ভেতর... ইট ওয়াজ অ্যাজ ইফ সামথিং স্ন্যাপ্ড। আমার নন্দনে যাওয়ার কথা ছিল কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের ফিল্ম মার্কেট উদ্বোধন করতে। প্রথমে ‘হ্যাঁ’ও বলেছিলাম। কিন্তু নন্দীগ্রামের ঘটনার পর আমি যেন চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম, সাদা পাঞ্জাবি পরা যে মানুষগুলো আসবে... তার ওপর রক্তের দাগ। ওদের জামায় আমি যেন সত্যি সত্যি চাপ চাপ রক্ত দেখতে পাচ্ছিলাম (হঠাৎ চুপ )...
পত্রিকা: তার পর?
অপর্ণা: তার পর... কী অদ্ভুত ব্যাপার জানেন... সেই সময় কিছু অভিনেতা আমাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, অতই যদি নন্দীগ্রাম নিয়ে দুঃখ হয় তা হলে নন্দীগ্রাম নিয়ে ছবি করুন। আমি নাম বলব না, কিন্তু এ রকম বলেছিলেন কেউ কেউ। আজকে সেই অভিনেতাদের দেখি মমতার চার পাশে ঘোরাঘুরি করতে।
পত্রিকা: সেই জন্যই কি ব্রিগেডে তৃণমূলের সভায় অত অভিনেতাকে দেখা গেলেও, আপনাকে দেখা যায়নি?
অপর্ণা: দেখুন আমার মনে হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত দু’মাসে বিরাট রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছেন। তার জন্য আমি ওঁর গুণগ্রাহী। কিন্তু আমার রাজনীতিটা ইস্যু ভিত্তিক। আমি কোনও একটি পার্টির মুখাপেক্ষী হয়ে রাজনীতি করতে চাই না। তার কারণ পরে যদি কোনও দিন মনে হয়, তৃণমূলের সমালোচনা করা দরকার, আমি যেন সেটা করতে পারি।
পত্রিকা: যখন নন্দীগ্রামের ঘটনা ঘটেছিল, আপনার বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল?
অপর্ণা: হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম আমি সৌমিত্রকে।
পত্রিকা: কী কথা হয়েছিল?
অপর্ণা: সব কথা মনে নেই। উনি ‘দেখছি, কী করা যায়’ এ রকম কিছু বলেছিলেন। দেখুন সৌমিত্র আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আপনাকে এটা বুঝতে হবে যে, প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই একাধিক মাত্রা থাকে। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় বহু দিনের। আগে সৌমিত্রকাকা বলতাম। উনিই আমার প্রথম নায়ক। আমাদের বাড়ি এসে মা-বাবার সঙ্গে আড্ডা মারতেন। পরিচয়টা বহু দিনের হলেও নন্দীগ্রামের ঘটনায় আমরা একেবারে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করেছি।
পত্রিকা: আজকাল যখন দেখেন এক সময়ের মার্কামারা বামপন্থীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করছেন, কেমন লাগে?
অপর্ণা: হাসি পায়। কিন্তু হাসির মধ্যেও এক ধরনের বিরক্তি জড়িয়ে থাকে। মানুষ নিজের আখের গোছাতে কত কিছু করতে পারে। কৌশিক (সেন) কিন্তু ব্যতিক্রম। দলীয় রাজনীতির মধ্যে নিজেকে জড়ায়নি। ও আমার থেকে ছোট হলেও ওর চিন্তাভাবনাকে আমি সম্মান করি। অনেক সময়ে ওকে ফোন করেজিজ্ঞেসও করেছি, এ ব্যাপারে তোর কী মনে হয় রে? আমার মনে হয়, ও খুব ঠান্ডা মাথার ছেলে। দুমদাম কিছু করে বসে না। ঠান্ডা মাথায় ডিসিশন নেয়, সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায় না।
আমি কিন্তু ব্রাত্য, শুভাপ্রসন্ন, বিভাসদাদেরও সম্মান করি। ওঁদের মধ্যে আমি কোনও দ্বিচারিতা দেখি না। কিন্তু টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির অনেকে আছেন, যাঁরা বামফ্রন্ট হলে বামফ্রন্ট, আজ তৃণমূল হলে তৃণমূল। এটা আমার ভাল লাগে না। বড্ড সাহসের অভাব মনে হয়। আমি কোনও দিনই সরকারি টাকায় ছবি বানাইনি। এনএফডিসি ছাড়া। এবং এনএফডিসি-র টাকায় ছবি বানানোর সময়েও আমায় কাউকে তেল দিতে হয়নি।
পত্রিকা: কিন্তু একটা কথা বলুন...
অপর্ণা: তার আগে একটা ঘটনা শুনুন... কল্যাণের (রায়) একটা জমি ছিল... হঠাৎ করে আগের সরকার বলল, ওই জমিটা দিয়ে দিতে হবে কারণ ওখানে রাস্তা হবে...
পত্রিকা: কোথায় ছিল জমিটা?
অপর্ণা: এই তো কসবার কাছে... রাজডাঙা। আমরা যখন শুনলাম এই কথা, আমি শুধু বলেছিলাম, ওই জমিটার ট্যাক্স দেওয়া হচ্ছে, মিউটেশন হয়ে গেছে, ওই জমিটা কি না নিলেই নয়? নিজেদের জমি তো সবাই বাঁচাবার চেষ্টা করবে, আমরাও তাই করছিলাম। এতে আর অন্যায় কই?
পত্রিকা: তার পর কী হল?
অপর্ণা: জমিটা ওঁদের দরকার হয়নি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তার পর ওঁরা একটা নামের তালিকা বের করে বলেছিলেন যে, এই মানুষগুলো অকৃতজ্ঞ; ওঁদের কাছ থেকে অনুগ্রহ নিয়েও ওঁদের প্রতি অনুগত নয়। তার মধ্যে বিভাসদা (চট্টোপাধ্যায়), মহাশ্বেতা মাসিদের নামও ছিল। তখন আমি কোনও একটা টিভি চ্যানেলের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম যে, তা হলে অনুগ্রহ দেখিয়ে যে সব মানুষের আনুগত্য
ওঁরা কিনতে পেরেছেন, তাদেরও একটা নামের তালিকা প্রকাশ
করা উচিত!
পত্রিকা: সেই জন্যই কি নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের সংগ্রামের সঙ্গে আপনি একাত্মবোধ করেছিলেন? সেখানেও তো ঝামেলাটা জমি নিয়েই...
অপর্ণা: না না, সেটার সঙ্গে এটার কোনও সম্পর্ক নেই। আমার শুধু মনে হয়, কই সোনালি অ্যাপার্টমেন্ট কী টিভোলি কোর্ট জাতীয় বহুতলের ওপর দিয়ে কোনও রাস্তা বানানোর কথা
তো কখনও হয় না। এ সব দেখেশুনে মনে হয় যে, ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে বোধহয় এ দেশের বৈধ নাগরিক হওয়া সম্ভব নয়!
পত্রিকা: আপনি তো নন্দন কমিটিতে আছেন। কী কী পরিবর্তন চান নন্দনে?
অপর্ণা: এটার জন্য আমায় একটু বাবুর (সন্দীপ রায়) সঙ্গে কথা বলতে হবে। প্রাথমিক ভাবে কিছু কসমেটিক চেঞ্জও দরকার। বাথরুমগুলো ভাল করতে হবে। প্রোজেকশনটা ভাল করতে হবে। নন্দন ২-টাকে ঠিকঠাক একটা প্রেক্ষাগৃহ বানাতে চাই। দেখুন, নন্দন হচ্ছে এ রাজ্যের একমাত্র আর্ট-থিয়েটার কমপ্লেক্স। আমি চাইব সেটা সুন্দর হোক, একটা ভাল ক্যাফেটেরিয়া থাকুক। সব নিয়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ।
পত্রিকা: এগুলো আপনি বলবেন মিটিংয়ে?
অপর্ণা: অবশ্যই। কী হয় বলুন তো, কথা বলতে বলতে আরও অনেক নতুন আইডিয়া বেরিয়ে আসে। মমতা তো সব সময় বলেন, আপনারা আমায় বলুন কী করা উচিত। উনি স্বীকার করেন, কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ দরকার। আমার মমতাকে বুদ্ধবাবুর মতো উদ্ধত মনে হয় না। ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, বুদ্ধবাবুকে আমার ভীষণ উদ্ধত মনে হত। এটা কিন্তু আমি মমতাকে প্রশংসা করার জন্য বলছি না। ওই যে হ্যাংমান নিয়ে একটা ছবি ছিল... কী যেন নাম ছিল সেই লোকটার?
পত্রিকা: নাটা মল্লিক...
অপর্ণা: হ্যাঁ, সেই নাটা মল্লিকের ওপর ছবিটার স্ক্রিনিং উনি হঠাৎ বন্ধ করে দিলেন। নন্দন যেন ওঁর নিজের সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
পত্রিকা: কাল যদি কোনও কমিটিতে বসে মনে হয়, ‘এখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থাকা উচিত ছিল’, বলবেন সে কথা?
অপর্ণা: অবশ্যই বলব। হোয়াই নট?
পত্রিকা: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি ছবি তৈরির উপযুক্ত বিষয়?
অপর্ণা: সেটা নিয়ে আমি এখনও কিছু ভাবিনি।
পত্রিকা: বুঝলাম...
অপর্ণা: কিন্তু এটা কী! আপনি তো আমায় রাজনীতির দিকে ঠেলে নিয়ে গেলেন। ‘ইতি মৃণালিনী’ কোথায় গেল...
পত্রিকা: আসছি, আসছি ‘ইতি মৃণালিনী’তে। শুনলাম এতে আপনি ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’-এর নিজের ইংরেজি অনুবাদ ব্যবহার করেছেন?
অপর্ণা: হ্যাঁ, করেছি। এক সময়ে মুকুলকে (শর্মা) ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’টা বোঝাবার জন্য অনুবাদটা করেছিলাম। সেটাই ছবিতে ব্যবহার করেছি। আসলে কী জানেন, আমার সব চেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে জীবনে সব কিছুই আমি দারুণ এনজয় করতে করতে করি। কাপড় কাচাটা কেবল
সহ্য করতে পারি না। তা ছাড়া
টেবিল সাজানো, বাড়ি সাজানো, লেখালেখি, দাবা খেলা, সব কিছুই ভাল লাগে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এনজয় করি।
পত্রিকা: আপনি তো অভিনয় থেকে পরিচালনায় এসেছিলেন। আজকাল তো ঋ
তুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালকেরা পরিচালনা থেকে অভিনয়ে যাচ্ছেন। এটাকে কী ভাবে দেখেন?
অপর্ণা: ভালই তো। এগুলো তো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। অ্যালায়েড আর্টস। আসলে কী জানেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা অভিনেতা থাকে... পরিচালকেরাও তার বাইরে নয়...
পত্রিকা: তা কোনও দিন সত্যজিৎ রায়কে বলেননি অভিনয় করার জন্য?
অপর্ণা: সাহসই ছিল না। মানিককাকাকে এক বার গান গাইতে বলেছিলাম একটা পার্টিতে, কী ধমক খেয়েছিলাম, বাপ রে বাপ! আমি বলেছিলাম, তুমি তো ভূতের রাজার গান গেয়েছ, একটা গান গাও না। তাতে উনি বলেছিলেন, “ওইটুকু গান আমাদের বাড়িতে সবাই গাইতে পারে।” এমন ধমক খেয়েছিলাম আর বলার সাহস হয়নি। আজকে উনি বেঁচে থাকলে বয়স অনেক হত, কিন্তু বলে দেখতে পারতাম। কিন্তু এটাও জানি উনি করতেন না। মৃণালকাকা (সেন) যাও বা করতেন, মানিককাকা করতেন না।
পত্রিকা: আচ্ছা, এত দিন মিডিয়ার সঙ্গে তো জড়িত আপনি। কোনও দিন মনে হয়নি মিডিয়ার ওপর ছবি বানাই?
অপর্ণা: না, এখনও তো সেই রকম কিছু মনে হয়নি। একটা মিডিয়া নিয়ে ছবি দেখেছিলাম, ‘পেজ থ্রি’। ওটাতে কয়েকটা ভাল নাটকীয় মুহূর্ত ছিল, কিন্তু ছবিটা ভাল ছিল না। বানানোটা ঠিক হয়নি।
পত্রিকা: কী বলছেন! ওই ছবিতে কঙ্কণা ছিলেন, জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটা। আপনার ভাল লাগেনি?
অপর্ণা: না, আমার ভাল লাগেনি। সেটা আমি কঙ্কণাকে বলেছিলাম। মধুরকেও (ভাণ্ডারকর) বলতে পারি।
পত্রিকা: এই সোজা কথা সোজা ভাবে বলার জন্যই কিন্তু অপর্ণা সেন বিখ্যাত...
অপর্ণা: থ্যাঙ্ক ইউ। মৃণালিনীও অনেকটা এ রকমই (হাসি)। |
|
|
|
|
|