পরিবর্তনের দিনে ইংরেজ দুর্গে হানা ভারতীয় রবিন হুডের
রিবর্তনের দুনিয়া। কারেকশনপরিবর্তনের দিন!
সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে। পৌনে ন’টা নাগাদ পার্ক প্লাজা হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে যে ভদ্র, বিনীত তরুণ নিচু গলায় রিসেপশন কর্মীকে কিছু বলার চেষ্টা করছিল, তার কপালে টিপ। এত নিচু গলা যে, কর্মীটি বলতে বাধ্য হলেন, কাম এগেইন। কাম এগেইন। তরুণের মুখটা এ বার নজরে এল— শান্তাকুমারন শ্রীসন্থ। দলে অ্যাদ্দিন বাদে প্রত্যাবর্তনের জন্য টিপটা বোঝা গেল। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বন্য ঘোড়া হিসেবে যিনি পরিচিত। চার বছর আগে এ মাঠেই বিমার দেওয়া। মাইকেল ভনের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কির জন্য যাঁর ম্যাচ ফি-র অর্ধেক টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে, তাঁর গলা এত নিচু। প্রত্যাবর্তন কোথায়, এ তো পরিবর্তন!
দু’মিনিটের মধ্যে ভারতীয় দল মাঠে যাওয়ার জন্য মেড মারিয়াম ওয়ের ওপর দাঁড় করানো টিম বাসে উঠছে, রোগা-পাতলা এক সাহেব এসে কাউকে কাউকে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। মাঠে যাওয়ার সময় ছবি-অটোগ্রাফ কারও ভাল লাগে! বিরক্তিতে দু’একজন মুখও ঘুরিয়ে নিলেন। তার পর আবার পরিচিত কন্ঠস্বরটা শুনে ঘাড় ঘোরালেন। বিস্ময়বিদ্ধ এক-এক জনের মুখচোখ। কেননা কী আশ্চর্য পরিবর্তন। ইনি শেন ওয়ার্ন। চেনার উপায় নেই এক ধাক্কায় অন্তত কুড়ি কেজি কমিয়ে ফেলেছেন বলে।
খেলা শুরু হতে দেখা গেল আধুনিক যুগের পক্ষে উইকেটটাও কেমন পরিবর্তনের। ঢাকা দেওয়া ছিল বলে মনেই হচ্ছে না। সেই সত্তর দশকের ইংলিশ উইকেটের মতো! সারা দিন বল সিম ও সুইং করছে। ওয়াসিম আক্রমকে মিডিয়া লাউঞ্জে যে গভীর মুষড়ে পড়া দেখাল তার কারণ অবশ্য এই নয় যে সুইংয়ের স্বর্ণ সিংহাসন দেখে তাঁর হাত নিশপিশ করছিল। বরঞ্চ তিনি আনমনা হয়ে পড়লেন শুনে যে, ওয়ার্নের ওজন কমানোর পিছনে প্রত্যক্ষ প্রভাব হলেন লিজ হার্লি। “ইস, আমারও যদি কেউ থাকত,” তাঁকে তখন জিজ্ঞেস করাটা ঠিক ভাল দেখায় না যে, শ্রীসন্থের মাঝে মাঝে ওয়াইড অব দ্য ক্রিজও যাওয়া উচিত কি না? সঞ্জয় মঞ্জরেকর তাঁর পিছনে। একই রকম আগ্রহ তাঁরও রূপান্তরিত ওয়ার্ন সম্পর্কে, “লিজ হার্লির প্রেরণায় জিম করে কমাল? না কি হার্লির জন্য লাইপো সাকশন করাল।” মঞ্জরেকর ক্রিকেট মিডিয়ায় আগ্রহ মঞ্জরেকরেরও রূপান্তরিত ওয়ার্ন সম্পর্কে, “লিজ হার্লির প্রেরণায় জিম করে কমাল? না কি হার্লির জন্য লাইপো সাকশন করাল?” মঞ্জরেকর ক্রিকেট মিডিয়ায় প্রসিদ্ধ গজল গায়ক হিসেবেও। এ দিন অবশ্য পঙ্কজ উধাসদের ট্রেন্ট নদীতে নিক্ষেপ করে কিশোরকুমারের গাওয়া ‘চারুলতা’-র রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন। আর বলছেন এখন আমি যে গানটা তুলছি সেটা হল, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’।
ট্রেন্টব্রিজে ম্যাট প্রায়রকে আউট করার পর শ্রীসন্থ।
পরিবর্তনের মহা জমকালো এই বাজারে মাঠেও যে অনবরত ছবিগুলো ফাস্ট ফরোয়ার্ড হতে থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কী। লাঞ্চ পর্যন্ত ইংল্যান্ড দু’উইকেটে ৬৯। টস জিতে স্ট্রসদের ব্যাট করতে পাঠানোটা ঠিক হল না ভুল, বোঝা যাচ্ছে না। লাঞ্চ থেকে চা-বিরতি ব্যাটিং টিম অভাবিত ধসে পড়ল। শ্রীসন্থের পঞ্চম ডেলিভারি থেকে পরিবর্তনের আকস্মিক শুরু। ধসে চাপা পড়ার মতো ছয় উইকেট চলে গেল ৫৫ রানে। অবধারিত ডুবছে তখন ইংল্যান্ডের যুদ্ধজাহাজ। জাহির খানকে তাম্রপত্র পাওয়া প্রবীণ স্বাধীনতাযোদ্ধা করে দিচ্ছেন শ্রীসন্থ আর প্রবীণ কুমার। কেমন অবাস্তব দেখাচ্ছে ইংল্যান্ডে পাতে না দেওয়া ভারতীয় সুইং বোলারদের সোনার দিনকে। কোথায় গেল সেই ইংরেজ মুখগুলো? বোথাম! ভন! আথারটন! নাসের। প্রিঙ্গল। এমনকী এ দিনের দৈনিকে মাইকেল হোল্ডিংও! যাঁরা নাকি জাহির বাদে দুঃস্বপ্নেও ভারতের কোনও সম্ভাবনা দেখছিলেন না ট্রেন্টব্রিজে। আবার কারেকশন— ট্রেন্টব্রিজে নয়, গোটা সিরিজে।
কিন্তু দিনটা তো ক্রিকেটের নয়! পরিবতর্নের! চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ হতেই বাইশ গজে চলে এল আবার অন্য রঙ। ইংল্যান্ডের নবম উইকেট জুড়ি স্টুয়ার্ট ব্রড আর গ্রেম সোয়ান। একটু আগে শ্রীসন্থকে যে পিচে সেরা ফর্মের বোথাম মনে হচ্ছিল, সেখানে হাঁকড়ানো শুরু করে দিলেন ব্রড। যুবরাজ যে স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছ’বলে ছ’টা ছক্কা মেরেছিলেন, সেই লোকটা আর এর মধ্যে ঠিক ততটাই তফাত যতটা মোটাসোটা ওয়ার্ন আর দুবলা ওয়ার্নে। ৭০ বলে দমাদ্দম ৭৩ জুড়ে দিলেন ব্রডরা। ভারত ঠিক যে দুশ্চিন্তায় ভুগছিল যে, বিপক্ষ দু’শো ছাড়িয়ে গেলে কপালে দুর্ভোগ আছে, তা-ই হল।
সোয়ান যে ঘাতক বলটায় আউট হলেন তাতে যত না তৃপ্তি বয়ে আনা ছিল, তার চেয়ে বেশি অমঙ্গুলেবার্তা। প্রবীণ কুমারের কাঁধ থেকেই যদি এটা বার হয়, জেমস অ্যান্ডারসনের হাত থেকে কী বার হবে? যদি এটাই বার হয় শনিবার তেন্ডুলকরের জন্য!
একটা ব্যাপারে ‘যদি’ নেই। ট্রেন্টব্রিজ টেস্ট ম্যাচ পাঁচ দিন চলবে না। শুধু স্কোর শিটে জেতা-হারায় কোনও পরিবর্তন হয় কি না সেটাই দেখার। মানে পরিবর্তন দিয়ে শুরু টেস্ট, পরিবর্তনে শেষ হয় কি না!
ক্রিকেট কভার করার পক্ষে বিশ্বের সেরা প্রেসবক্স ট্রেন্টব্রিজ। উইকেটের ওপর ঠিক সোজাসুজি। আবার আদর্শ লোকেশনের জন্য বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। প্যাভিলিয়নের উল্টো দিক থেকে বল হওয়ার সময় প্রেসবক্সে চায়ের কাপ নিয়ে ওঠারও নিয়ম নেই। সিটবেল্ট বেঁধে প্লেনে বসার মতো থাকতে হবে। কিন্তু সে জন্যই সুইং কতটা ভাঙছে আরও ভাল বোঝা যায়। শুক্রবার যেমন বল নড়াচড়া করাটা চমৎকার বোঝা গেল। শুধু তো ব্যাটসম্যান নয়। স্লিপ বা কিপারেরও মহা সমস্যা হচ্ছিল। উপমহাদেশীয় ফিল্ডার হলে হওয়ারই কথা। তারা তো অভ্যস্তই নয় এমন পরিস্থিতিতে যেখানে বল এক দিকে ভাঙছে দেখে সে সেই দিকের পায়ের ওপর ওজনটা চালান করে ফেলেছে। এ বার বল হঠাৎ করে লেট মুভ করে গেল অন্য দিকে। সে বোকা বনে গেল।
শুক্রবার এমন একটা দিন যেখানে অবিরাম সুইংয়ের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা চলল। কোনওটা বড় ভাঙছে। কোনওটা ছোট। কোনওটা একেবারে শেষে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির কঠিন সমস্যা হচ্ছিল। উনষাট টেস্টের অভিজ্ঞতা দিয়েও সময় সময় সেটা ম্যানেজ হচ্ছিল না। প্রথম স্লিপে দ্রাবিড় যে ব্রেসনানের ক্যাচটা লুফলেন, তাতে ধোনির ছবিটা দেখলেই আজকের ট্রেন্টব্রিজের সুইং চিত্র বোঝা সম্ভব। কিপারের বডি ব্যালেন্স এবং মুখ দুটোই লেগস্লিপের দিকে। পুরো উল্টো দিকে।
ফিরে যাচ্ছেন মর্গ্যানও। প্রবীণ কুমার এবং যুবরাজের উচ্ছ্বাস। শুক্রবার।
মাঠে যে অনবরত দৃশ্যপট বদলাচ্ছে, ইংল্যান্ড এক বার ধুঁকছে। পরমুহূর্তেই ব্রডের চওড়া ব্যাটে পরাক্রমশালী, তাতে অধিনায়ক ধোনির কোনও তাপ-উত্তাপ দেখা গেল না। সচিনকে বরং বোলারদের সঙ্গে কথা বলা, পরামর্শ দেওয়া, তাদের পিঠ চাপড়ানোতে অনেক বেশি উদ্যোগী দেখাল। এই যে শ্রীসন্থ কামব্যাক করে ভারতকেও সিরিজে ফেরাচ্ছেন। তাঁকে পিঠটিঠ চাপড়ে দেওয়া। তিন সিমার তিনটে করে উইকেট তুললেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলা। এ সব ধোনি করেন না। আজও করলেন না। স্টাম্পের পিছনে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকাটাই টিমের জন্য তাঁর স্টাইল স্টেটমেন্ট। সব ঠিক আছে। আমি ঠিক আছি। অল ইজ ওয়েল।
ইংল্যান্ড ২২১ তুলে ফেলায়, অভিনব মুকুন্দ প্রথম বলে আউট হয়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন্সির এই অল ইজ ওয়েল মডেল ফের পরীক্ষার সামনে পড়ল। তবে আজকের মতো লোকে ধোনিকে সাধুবাদই জানাচ্ছে। মহাগুরুত্বপূর্ণ টস জেতা ছাড়াও মুছে যাওয়া সিরিজে তাঁর দলকে ফিরিয়েছেন।
কম্পিউটারে ট্র্যাশ থেকে ইনবক্সে ফেরত আসার মতো তাঁর দলের চমকপ্রদ পুনরুত্থান। সুইংয়ের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অন্তত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মেজাজ তো আনতে পেরেছেন! শেরউড অরণ্যের অন্তর্জগতের মতো এমন গা-ছমছমে সাসপেন্স দ্বিতীয় টেস্টে তৈরি হবে সেটাই তো কারও হিসেবে ছিল না।
প্রত্যাবর্তন হওয়ার আরও চার দিন (মনে হয় আড়াই দিন) সময় পড়ে থাকল। কিন্তু তার আগের অনিবার্য ধাপ তো পরিবর্তন!
খেলার শেষে দেখা গেল মানসিক যুদ্ধ দু’টিমে শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় শিবির আশাবাদী, গ্রেম সোয়ান চোট পাওয়ায় চতুর্থ বোলারের কাজটা জোনাথন ট্রটকে করতে হবে। আর তখন চাঁদু তোমাদের দেখব। ইংল্যান্ড পাল্টা বলছে, এই উইকেটে ২২১ অনেক। স্টুয়ার্ট ব্রডকে বলার চেষ্টা হল, ওয়েদার ফোরকাস্ট অনুযায়ী কাল ঝকঝকে রোদ্দুর থাকার কথা। বল সুইং কম করবে। ব্রড ঠোঁট উল্টে অবিচলিত ভাবে বললেন, “ভালই তো। আর সুইং বেশি করা যে বলগুলো ব্যাটের কানা ছুঁতে ছুঁতে লাগছিল না, সেগুলো কাল লাগবে। আমাদের পক্ষে দারুণ খবর।” ভারতের ইনিংসে হওয়া পনেরো ওভার দেখে মনে হল, সিরিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনে ভরসা সেই দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ। ভারতীয় ক্রিকেটের চিরন্তন শালগ্রামশিলা।
এখানে না পরিবর্তন। না প্রত্যাবর্তন। দু’টো শব্দই অচল।

ইংল্যান্ড

প্রথম ইনিংস
স্ট্রস ক রায়না বো প্রবীণ ৩২
কুক এলবিডব্লিউ ইশান্ত ২
ট্রট ক লক্ষ্মণ বো শ্রীসন্থ ৪
পিটারসেন ক রায়না বো শ্রীসন্থ ২৯
বেল ক ধোনি বো ইশান্ত ৩১
মর্গ্যান এলবিডব্লিউ প্রবীণ ০
প্রায়র ক দ্রাবিড় বো শ্রীসন্থ ১
ব্রেসনান ক দ্রাবিড় বো ইশান্ত ১১
ব্রড ক তেন্ডুলকর বো হরভজন ৬৪
সোয়ান ক মুকুন্দ বো প্রবীণ ২৮
অ্যান্ডারসন ন.আ. ৬
অতিরিক্ত ১৩
মোট ২২১।
পতন: ৭, ২৩, ৭৩, ৮৫, ৮৫, ৮৮, ১১৭, ১২৪, ১৯৭।
বোলিং: প্রবীণ ২২-৮-৪৫-৩, ইশান্ত ২২-৪-৬৬-৩, শ্রীসন্থ ১৯-১-৭৭-৩,
হরভজন ৪.৪-০-২২-১, যুবরাজ ১-০-১-০।

ভারত

প্রথম ইনিংস
মুকুন্দ ক পিটারসেন বো অ্যান্ডারসন ০
দ্রাবিড় ব্যাটিং ৭
লক্ষ্মণ ব্যাটিং ১৩
অতিরিক্ত
মোট ২৪-১।
পতন: ০।
বোলিং: অ্যান্ডারসন ৫-২-১০-১, ব্রড ৭-৩-৫-০, ব্রেসনান ৩-০-৭-০।

ছবি রয়টার্স
First Page Khela Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.