মোটরবাইক রাখা নিয়ে বচসা
ছাত্রদের মারে কর্মীর মৃত্যু রবীন্দ্রভারতীতে
নির্দিষ্ট জায়গার পরিবর্তে কর্মচারী সমিতির অফিসের কাছে মোটরবাইক রেখেছিলেন দুই ছাত্র। আপত্তি জানান এক কর্মী। তার জেরে বচসা, ধস্তাধস্তি। তাতেই গুরুতর আঘাত পেয়ে মৃত্যু হল ৫৯ বছরের ওই কর্মীর।
শুক্রবার বেলা সওয়া ১২টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বি টি রোড ক্যাম্পাসে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত কর্মীর নাম বাসুদেব নন্দী। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সমিতির সভাপতি। আগামী জানুয়ারি মাসে তাঁর অবসর নেওয়ার কথা ছিল।
এ দিন এই ঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর উত্তাল হয়ে ওঠে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে বিশাল পুলিশ বাহিনী ও র্যাফ নামানো হয়। ‘অনিচ্ছাকৃত ভাবে বাসুদেববাবুর মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে’ শৌভিক বিশ্বাস, সম্মোহন দে, শুভজিৎ দাস, বিশ্বজিৎ হালদার ও নীলাঞ্জন দাস নামে দৃশ্যকলা বিভাগের পাঁচ ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ওই বিভাগেরই শিক্ষক সুরজিৎ চন্দকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবীন্দ্রভারতীর বি টি রোড ক্যাম্পাস অর্থাৎ মরকত কুঞ্জে দৃশ্যকলা বিভাগের পাশেই রয়েছে কর্মচারী সমিতির অফিস। বেলা সওয়া ১২টা নাগাদ দৃশ্যকলা বিভাগের দুই ছাত্র মোটরবাইকে চেপে সেখানে আসেন। কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন বাসুদেববাবু। দুই ছাত্র সমিতির অফিসের কাছে মোটরবাইক রেখে চলে যাচ্ছেন দেখে তিনি আপত্তি জানান। এই নিয়ে দু’পক্ষে বচসা হয়। ওই ছাত্রেরা দৃশ্যকলা বিভাগের ক্লাসে চলে যান। একটু পরেই দলে ভারি হয়ে ফিরে এসে তাঁরা বাসুদেববাবুর উপরে চড়াও হন। ধস্তাধস্তি চলে। ছাত্রেরা বাসুদেববাবুকে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে থাকেন। মাটিতে পড়ে যান তিনি। স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

বাসুদেব নন্দী
এই ঘটনার পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক’টি ফটক বন্ধ করে দেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র ও কর্মীরা। ক্যাম্পাসে তখন প্রবল উত্তেজনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অফিসার ঋত্বিক বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে যে অভিযোগ করেছেন, তাতে লেখা হয়েছে, ছাত্রদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে আহত হন বাসুদেববাবু। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার বাসুদেববাবুকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন, তাঁর দেহে প্রাণ নেই।
বাসুদেববাবু মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরেই অভিযুক্ত ছাত্রদের ধাওয়া করেন বাসুদেববাবুর
সহকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক জন পড়ুয়া। তাড়া খেয়ে ওই ছাত্রেরা দৃশ্যকলা বিভাগে ঢুকে পড়েন। তাঁদের পিছু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মীও সেখানে হাজির হন। তাঁদের অভিযোগ, সুরজিৎ চন্দ নামে দৃশ্যকলা বিভাগের এক শিক্ষক ভিতরে ঢুকতে বাধা দেন কর্মীদের। সুরজিৎবাবুর সহ শিক্ষকেরা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পুলিশ অবশ্য পরে ঘটনায় প্ররোচনার অভিযোগে সুরজিৎবাবুকেও গ্রেফতার করে।
কর্মীদের একাংশ দাবি তোলেন, অভিযুক্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের কোমরে দড়ি বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলতে হবে। এই নিয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন ছাত্র ও কর্মীরা। অবশেষে কাপড় জড়িয়ে আড়াল করে পুলিশ অভিযুক্তদের বার করে নিয়ে যায়।
ঘটনার কথা চাউর হতেই স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক মালা সাহা, কাউন্সিলর শান্তনু সেন-সহ তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাজির হন। পুলিশের গাড়ি ঘিরে তাঁরাও বিক্ষোভ শুরু করেন। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের সঙ্গে বচসা শুরু হয়ে যায় তৃণমূল সমর্থকদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের অভিযোগ, বহিরাগতরা তাঁদের মারধর করেছে। বিকেল ৫টার পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এমনিতেই রাজনীতির চড়া সুর সর্ব ক্ষণ বহাল থাকে। তাই বাসুদেববাবুর মৃত্যু ঘিরেও এক সময় শুরু হয় রাজনীতি।যে ছাত্ররা বাসুদেববাবুকে ঘুঁষি মেরেছেন, তাঁরা এসএইআই সমর্থক বলে দাবি করেছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)। টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, “বাসুদেববাবু তৃণমূল সমর্থক। এসএফআইয়ের সমর্থকেরা ওঁকে খুন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।” অভিযোগ অস্বীকার করে এসএফআই-এর দাবি, অভিযুক্তেরা তাদের সমর্থক নয়। এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন। তাঁর মতে, টিএমসিপি-ই রাজ্য জুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সমিতির কার্যনির্বাহী সভাপতি কৃষ্ণচন্দ্র দাস বলেন “বাসুদেববাবু কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। মিথ্যে রাজনৈতিক রং লাগানো হচ্ছে ওঁর গায়ে।”
বাসুদেব নন্দীর শোকার্ত মেয়ে মানসী নন্দী (বাঁ দিকে) এবং স্ত্রী রাধা নন্দী। শুক্রবার আর জি কর হাসপাতালে
বিকালে রবীন্দ্রভারতী চত্বরে গিয়ে এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন শিক্ষমন্ত্রী ব্রাত্য বসু। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি একপ্রস্ত আলোচনা করেন। সেই বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও বিভিন্ন বিভাগের প্রধান, কর্মী ও ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও তৃণমূল নেতৃত্ব ছিলেন। পরে ব্রাত্যবাবু বলেন, “অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। গোটা সমাজে হিংস্রতার যে ব্যাধি ছড়িয়েছে, এ ঘটনাকে তার থেকে আলাদা করে দেখছি না। এই ঘটনায় রাজনৈতিক রং না দেখে বিচার করতে হবে।” মৃতের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোরও আশ্বাস দেন তিনি। ময়নাতদন্তের পরে বাসুদেববাবুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সিঁথিতে তাঁর বাড়িতে।
সেখানে গিয়ে মরদেহে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান শিক্ষামন্ত্রী। কলকাতা পুলিশের স্পেশাল কমিশনার শিবাজী ঘোষ বলেন, “গোলমাল হয়েছে মোটরবাইক রাখা নিয়ে।
এই ঘটনায় এক জনের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ পেয়ে পাঁচ ছাত্র ও এক শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিকেলে জানিয়ে দেন, এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হবে না। আজ, শনিবারও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকবে। এ দিন দুপুরে সিঁথির বাড়িতে যখন দুঃসংবাদ এসে পৌঁছয়, তখন সেখানে ছিলেন বাসুদেববাবুর স্ত্রী রাধাদেবী ও মেয়ে মানসী। মানসীও রবীন্দ্রভারতীর অস্থায়ী কর্মী। বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন ফোন করে জানান, বাবা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। শুনেই চলে যাই নার্সিংহোমে। তত ক্ষণে সব শেষ।”

ছবি: বিতান ভট্টাচার্য
First Page Calcutta Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.