|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
প্রায়শ্চিত্ত শুরু হোক |
শোককে শপথে পরিণত করিয়া নরওয়ের জনসাধারণ দুঃস্বপ্নের রাত্রিশেষে নূতন সকালের অন্বেষণ করিতেছেন। এক মৌলবাদী উন্মাদের শিকার ৭৬ জন দেশবাসীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে সেখানে সমবেত হইয়াছিলেন দেড় লক্ষাধিক মানুষ। নরওয়ের মতো দেশের পক্ষে এত বিপুল জনসমাগম একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। নরওয়েবাসীরা অ্যান্ডার্স বেরিং ব্রেইভিক-এর উগ্রপন্থী খ্রিস্টীয় মৌলবাদকে আপাতদৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। সেই প্রত্যাখ্যানের বার্তা দিতেই রাজধানী অসলো শহরে এত মানুষ জমায়েত হন। ব্রেইভিকের ফ্রান্স-প্রবাসী পিতা পর্যন্ত এক সাক্ষাৎকারে জানাইয়াছেন, এতগুলি নিরীহ মানুষকে হত্যা করার আগে তাঁহার পুত্রের উচিত ছিল নিজেকে হত্যা করা। এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের যুক্তি হিসাবে ব্রেইভিক তাহার মতাদর্শের যে প্রচারমূল্যের কথা বলিয়াছে, তাহাও একান্ত ভাবেই সন্ত্রাসবাদীদের যুক্তি, চমকপ্রদ কুকীর্তি ঘটাইয়া যাহারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চায়।
ব্রেইভিক যে ভবিষ্যতের সর্বগ্রাসী ইসলামি আগ্রাসন হইতে ইউরোপকে রক্ষা করার সতর্কঘণ্টা বাজাইতেই ঠাণ্ডা মাথায় এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করিয়াছে, নিজস্ব কৈফিয়তে তাহা বলিয়াছে। তবে ইসলামের দ্বারা, অ-ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও জীবনচর্যার দ্বারা গ্রস্ত হওয়ার এই বিপন্নতাকে অতিরঞ্জিত করিয়া ইউরোপে বেশ কিছু কাল যাবৎই এক ধরনের প্রাকার গড়িয়া তোলার সচেতন প্রয়াস চলিয়াছে। ডেনমার্কে, ফ্রান্সে, জার্মানিতে, অস্ট্রিয়ায় বহুসংস্কৃতিবাদের অনুশীলনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হইতেছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণাও মিলিতেছে। খ্রিস্টীয় পবিত্র ভূমিকে ইসলামের দখল-মুক্ত করিতে চার শত বছর ধরিয়া উপর্যুপরি ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড-এর যে সাড়ম্বর, রাজকীয় অভিযান চলে, পোপের আশীর্বাদ লইয়াই তাহা ইউরোপীয় জনসাধারণকে শামিল করিতে সক্ষম হইয়াছিল। ইসলামের সহিত বিক্রিয়ায় ইউরোপীয় চৈতন্য এই ক্রুসেডীয় ইতিহাসের জেরে আচ্ছন্ন থাকে। ইরাক অভিযান চালানোর সময়েও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘ক্রুসেড’ শব্দটি উচ্চারণ করিয়া ফেলেন। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে দীর্ঘ কাল অভিবাসী মুসলিমদের প্রতি আচরণের মধ্যেও যে ক্রুসেড আমলের সেই বৈরিতা ও অবরুদ্ধ হওয়ার মানসিকতা সক্রিয় থাকিবে, ইহা আশ্চর্যের নয়। অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক একটি বিস্ফোরণ, যাহার প্রয়োজনীয় বারুদ-সম্ভার ইউরোপীয় সমাজে মজুতই রহিয়াছে। পশ্চিমী গণমাধ্যম যে নরওয়ের ঘটনাকে প্রথমেই ইসলামি সন্ত্রাসের অপকর্ম রূপে চিহ্নিত করিয়া ফেলিয়াছিল, তাহার মধ্যেও ইসলামের প্রতি, অ-ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও জীবনচর্যার প্রতি সন্দেহ ও অসহিষ্ণুতা প্রচ্ছন্ন ছিল। নরওয়ে নিজে কিন্তু এই সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ায় তাহার গণতন্ত্র ও বহুসংস্কৃতিবাদের অনুশীলনে দাঁড়ি টানিতে প্রস্তুত নয়। শোকমগ্ন এই স্ত্যান্ডিনেভীয় দেশটির কার্যত কোথায়ও প্রতিহিংসার দাবি নাই। গণতন্ত্রের পরিসরকে সঙ্কুচিত করার, অভিবাসনের উদারনীতিকে খর্ব করার শপথ সেখানে উচ্চারিত হয় নাই। বরং নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জেন্স স্টোলটেনবার্গ দেশের সর্বত্র ঘুরিয়া-ঘুরিয়া প্রচার করিতেছেনএই হিংসার জবাব দিতে দেশের গণতন্ত্রকে আরও উদার করা হইবে, নরওয়ের সমাজ ও রাজনীতির দরজা-জানালা আরও হাট করিয়া খুলিয়া দেওয়া হইবে, রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে জনসাধারণের সক্রিয় যোগদান আরও সর্বজনীন করিয়া তোলা হইবে। গণতন্ত্রের দিগন্তকে আরও প্রসারিত করিয়াই নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করা যায়। তাঁহার এই উচ্চারণ জনমত সমীক্ষায় ৯৪ শতাংশের অনুমোদন লাভ করিয়াছে। স্টোলটেনবার্গ পশ্চিমী গণতন্ত্রের সেই মুখ, যাহা এ যাবৎ মানুষের উদ্ভাবিত যাবতীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে গণতন্ত্রের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। নরওয়ের গণতন্ত্রও মানবসভ্যতাকে ভরসা দেয়, অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের উগ্র জাতিবৈরের প্রতিষেধক গণতন্ত্রের চরাচরেই ছড়াইয়া আছে। |
|
|
|
|
|