|
|
|
|
উল্টোডাঙায় ডাকাতি |
রিভলভার ঠেকিয়ে ওরা বলল, আমরা সব জানি |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
গৃহকর্ত্রীর কপালে ঠেকানো রিভলভারের নল। শার্ট-প্যান্ট পরা এক যুবক কড়া গলায় বলে, “ঘরে টাকা আছে, আমি জানি। বলো কোথায় আছে?” মাথা ঠান্ডা রেখে গৃহকর্ত্রী বলেছিলেন, “জানো যখন, নিজেরাই খুঁজে নাও।”
বুধবার দুপুরে বিধান নিবাসে গৃহকর্ত্রী শুভলক্ষ্মী ভট্টাচার্যের সঙ্গে এ ভাবেই কথা বলেছিল চার ডাকাতের এক জন। তার কথায় ছিল পূর্ববঙ্গের টান। বাকি তিন জনের মধ্যে দু’জনও ছিল শার্ট-প্যান্ট পরা। এক জনের পরনে ছিল লুঙ্গি ও শার্ট। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশের ধারণা, শুভলক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী সূর্যনারায়ণ ভট্টাচার্যের ফ্ল্যাটে প্রচুর টাকা রাখা আছে, এমন খবর পেয়েই ডাকাতি করতে এসেছিল চার যুবক। কিন্তু তাদের খবর ঠিক ছিল না। সূর্যনারায়ণবাবু এয়ার ইন্ডিয়ার পদস্থ কর্তা। তিনি যে কর্মসূত্রে চেন্নাইয়ে থাকেন, এমনকী তাঁর ছেলেও যে গুজরাতে থেকে পড়াশোনা করছে, সে সব তথ্য অবশ্য ঠিকঠাকই পেয়েছিল ডাকাত-দলটি।
কী ঘটেছিল বুধবার দুপুরে? |
শুভলক্ষ্মী জানান, ঘরে ঢুকেই ৯২ বছরের শান্তা ভট্টাচার্য ও বাড়ির পরিচারিকা বীণা গঙ্গোপাধ্যায়কে বেঁধে ফেলে চার ডাকাত। শান্তাদেবীকে শুইয়ে দেওয়া হয় রান্নাঘরের সামনের মেঝেতে। বীণাদেবীর কপালে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় খাবার টেবিলের পাশে। তাঁদের মুখও বেঁধে দেওয়া হয়। তাঁরা যাতে চিৎকার করতে না পারেন, সে জন্য মুখের ভিতরে কাপড় ও প্লাস্টিক ঠেসে দেওয়া হয়। দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিতে না পেরে সেখানেই মারা যান শান্তাদেবী। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেও এ কথাই বলা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ডাকাতদের কারও মুখ ঢাকা ছিল না। পুলিশ সূত্রে খবর, ডাকাতদের দু’-এক জনকে বীণাদেবী ‘আগে দেখেছেন’ বলে জানিয়েছেন। তাঁর এবং শুভলক্ষ্মীর দেওয়া বিবরণের ভিত্তিতে ওই দুষ্কৃতীদের ছবি আঁকানো হবে। শুভলক্ষ্মীকে বাঁধার পরে তাঁর মুখের ভিতরেও কাপড় গুঁজতে যায় এক যুবক। শুভলক্ষ্মী কাকুতি-মিনতি করে |
শান্তা দেবী |
|
বলেন, “আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি, চিৎকার করব না।” তখন তাঁর মুখ আলগা করে বেঁধে দেওয়া হয়। তার পর থেকেই ক্রমাগত তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ চালিয়ে গিয়েছে এক যুবক।
যুবকেরা বার বার করে একটিই প্রশ্ন করে যায় শুভলক্ষ্মীকে, “টাকার আলমারিটা কোথায়? টাকা কোথায় রাখা আছে?” শুভলক্ষ্মীও প্রতি বারই ডাকাতদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাঁর বাড়িতে বেশি টাকা নেই। তিনি ডাকাতদের বলেন, “থাকার মধ্যে আছে দু’টো আলমারি। একটা আমার। অন্যটা শাশুড়ির শোয়ার ঘরে। যা টাকা থাকার, তা ওই দু’টি আলমারিতে রয়েছে। এ ছাড়া আমার হাতব্যাগে কিছু টাকা রয়েছে।” ডাকাতদের প্রশ্ন ছিল, “ঠাকুরের সিংহাসনটা কোথায়?”
মাথায় রিভলভার ঠেকানো অবস্থাতেও ওই সময় ডাকাতদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন শুভলক্ষ্মী। তিনি তাদের বলেন, “তোমরা ভুল খবর নিয়ে এসেছ। আমাদের ফ্ল্যাটে ঠাকুরের সিংহাসন নেই। তোমরা ভুল করে অন্য ফ্ল্যাটে চলে এসেছ।” তাঁর কথায় ডাকাতরাও ধন্দে পড়ে যায়। শুভলক্ষ্মী জানান, কয়েক মুহূর্তের জন্য তারা থমকে যায়। তার পরে দলের পাণ্ডা গোছের যুবকটি (যে শুভলক্ষ্মীর কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিল) পাল্টা প্রশ্ন করে, “তোর বর চেন্নাইয়ে থাকে না! তোর ছেলেও তো বাইরে থাকে। আমরা সব জানি।”
এ বার হতভম্ব হওয়ার পালা শুভলক্ষ্মীর। এ দিন তিনি বলেন, “বুঝতে পারি, আমাদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য নিয়েই ডাকাতেরা এসেছে। কথাবার্তার ফাঁকে এক ডাকাত বলে, এ বাড়িতে যে টাকা আছে, সেটা সে মাস দুয়েক আগেই দেখেছে। এতেই আমার রং-মিস্ত্রিদের উপর সন্দেহ হয়। গত সাত মাস ধরে এই আবাসনে রঙের কাজ হচ্ছে।” পুলিশেরও অনুমান, গত কয়েক মাসে রং মিস্ত্রিদের সঙ্গে মিশে ডাকাতেরা আবাসনে বেশ কয়েক বার ঘুরে গিয়েছিল। শুভলক্ষ্মী জানিয়েছে, মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে তাঁদের ফ্ল্যাটের ভিতরে রঙের কাজ শেষ হয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, আবাসনে নির্বিঘ্নে ঢোকার জন্যই রং-মিস্ত্রির পোশাক ব্যবহার করেছিল ডাকাতেরা।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, মাস খানেক আগে বিধান নিবাসে রং মিস্ত্রিদের নিয়ে একটি গোলমাল হয়েছিল। পুলি লাগিয়ে একটি আসনের উপরে বসে মিস্ত্রিরা আবাসনের দেওয়ালের উপর-নীচে ওঠানামা করে রঙের কাজ করতেন। এত দিন ধরে রঙের কাজ চলায় বিরক্ত ছিলেন আবাসিকেরা। তা ছাড়া মিস্ত্রিরা কাজ করতে গিয়ে কখনও কারওর জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলতেন, কখনও বাইরের পাইপ ফাটিয়ে ফেলতেন। মাসখানেক আগে ওই পুলি ভেঙে একটি রঙের ড্রাম পড়ে যায় এক আবাসিকের মাথায়। এই ঘটনায় মিস্ত্রিদের ধরে মারধর করার অভিযোগ ওঠে কয়েক জন বাসিন্দার বিরুদ্ধে। সেই মারধরের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে সূর্যনারায়ণবাবুর নামও।
সূর্যনারায়ণ বলেন, “হতে পারে সেই কারণে আমার উপরে রাগ হয়েছিল ওদের। তবে, আমার বাড়িতে অনেক টাকা থাকে, এই তথ্য একেবারেই ঠিক নয়। কেউ ভুল করে সেই তথ্যটা দুষ্কৃতীদের দিয়েছিল।” বুধবার ডাকাতির পরে রং মাখা জামাকাপড় ছেড়ে সূর্যনারায়ণবাবুর পোশাক পরে চলে যায় ডাকাতেরা। ডাকাতদের কাউকে অবশ্য এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, একাধিক রং মিস্ত্রি এবং ঠিকা শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ দিন যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দময়ন্তী সেন বলেন, “মুন্না মাহাতো নামে যে ব্যক্তিকে রং ও মেরামতির ঠিকা দেওয়া হয়েছিল, তিনি কলকাতার বাইরে। তাঁর সঙ্গেও তদন্তকারীদের কথা হয়েছে।” এ দিন সকালে টালা থানা ঘুরে আর জি কর হাসপাতালে যান সূর্যনারায়ণবাবু। তাঁর সঙ্গে অফিসের সহকর্মী ও বন্ধুরা ছিলেন। ময়নাতদন্তের পরে মায়ের দেহ নিয়ে তিনি বিধান নিবাসে আসেন। তত ক্ষণে গাঁধীনগর থেকে চলে এসেছেন তাঁর ছেলে সৃঞ্জয়। সূর্যনারায়ণবাবুর দিদি মুকু দয়াল ছিলেন লন্ডনে। তিনিও বিকেলে পৌঁছে যান। সন্ধ্যায় নিমতলা শ্মশানে শান্তাদেবীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। |
|
|
|
|
|