প্রবন্ধ ২...
আর্থিক মন্দা ফুরিয়েছে অর্থনীতির সংকট ফুরোয়নি
ছর তিনেক হল, গোটা দুনিয়ার অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে লেম্যান ব্রাদার্স নামের বৃহৎ মার্কিন সংস্থাটি দেউলিয়া হয়ে গেল। সরকারি সাহায্য, পৃষ্ঠপোষকতায় যে সংস্থা দিব্যি ফুলেফেঁপে উঠছিল, তা হঠাৎ করে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া যে কত বড় ঘটনা, গোটা দুনিয়া সেটা টের পেল এক মারাত্মক আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে। ২০০৮ সালের আগের পাঁচ বছরের কথা মনে রাখলে এই ঘটনার আকস্মিকতা আরও স্পষ্ট হবে। ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতেই জোয়ার এসেছিল। কার্যত সব দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারই ঊর্ধ্বগামী হয়েছিল। যে দেশগুলি এখন উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃত, তাদের উত্থানও এই পর্বেই। ২০০৮ সালের মন্দার ধাক্কা সব দেশের গায়েই লাগল।
ভারতের কথাই ভাবুন। আমাদের জাতীয় আয় বেশ দ্রুত হারে বাড়ছিল। ২০০৫-০৬-এ বৃদ্ধির হার ছিল ৯.৪ শতাংশ, ২০০৬-০৭-এ ৯.৬ শতাংশ, ২০০৭-০৮-এ ৯.৩ শতাংশ। কিন্তু ২০০৮-০৯-এ তা নেমে গেল ৬.৮ শতাংশে। কেউ বলতেই পারেন, যে দেশে দীর্ঘকালীন মেয়াদে জাতীয় আয় কখনও বার্ষিক সাত শতাংশের বেশি হারে বাড়েনি, সে দেশে ৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধির হারকে কম বলবেন কী করে? কিন্তু কথাটা অন্য। আমরা বেশি দ্রুত হারের সমৃদ্ধির পথে এগোতে নিয়েছিলাম, কিন্তু তা বন্ধ হয়ে গেল। বার্ষিক ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধির পথে ফিরে যেতে এখন বেশ সময় লাগবে।
২০০৮ সালের মন্দা তীব্রতম হয় ২০০৯ সালের গোড়ায়। তখন গোটা দুনিয়ার আর্থিক অবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত। তার পর, মন্দার প্রকোপ ক্রমে কমতে থাকে। ২০১০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে পৌঁছে মনে হতে থাকে, সংকট বুঝি ফুরলো। কিন্তু, বছর ঘুরতেই আবারও উদ্বেগের কালো মেঘ। ২০০৮ সালের মন্দার আগে যে সমস্যাটি বিশ্ব-অর্থনীতিকে ভোগাচ্ছিল, সেটি ফিরে এল। তার নাম মূল্যবৃদ্ধি। এক দিকে পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, অন্য দিকে গোটা দুনিয়াতেই খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্বভাবতই সব দেশের অর্থনীতির কর্তাদের মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ভারত বা চিনের মতো দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার আরও তীব্র। সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সামনে চ্যালেঞ্জ কী করে মূল্যবৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। সমস্যা হল, এখন অবধি বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যা করতে পেরেছে, তাতে মূল্যবৃদ্ধির সাপের গায়ে আঁচড়টিও পড়েনি, কিন্তু লাঠি প্রায় যায় যায়।
উন্নত দুনিয়ায় ভিন্নতর সমস্যা। ইউরোপে গ্রিস, আয়ার্ল্যান্ড, পর্তুগালের মতো বেশ কয়েকটি দেশের সরকার দেনার দায়ে জর্জরিত। বর্তমানে গ্রিসকে দেউলিয়া অবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য যখন যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে, তখন জানা যাচ্ছে স্পেন ও ইতালির অবস্থাও মোটেই সুবিধেজনক নয়। এই দেশগুলির সমস্যার ফলে বিপদের সম্মুখীন ইউরো ইউরোপের সাতাশটি দেশের যৌথ মুদ্রা। অবস্থা সামাল দিতে জার্মানি আর ফ্রান্স যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। মুশকিল দুটো। এক, এই দুটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করেন, তাঁদের করের টাকায় কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন দেশকে রক্ষা করার কোনও মানেই হয় না। দুই, বিপাকে পড়া দেশগুলির অবস্থা এমনই করুণ যে তাদের উদ্ধার করা অতি কঠিন কাজ। এই দেশগুলির অবস্থা এমনই যে তাদের জাতীয় আয় বার্ষিক দুই শতাংশ হারে বাড়ার মতো অবস্থাতেও নেই। বেকারত্বের হারও বেড়ে চলেছে।
আমেরিকার অর্থব্যবস্থাতেও অনিশ্চয়তা বেড়ে চলেছে। ২০১০-এ যে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তা যেন ফের মিলিয়ে গিয়েছে। সেখানে অনেক সমস্যা। অঢেল খরচ করা হয়েছে ‘কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং’-এর নামে। কিন্তু ফল কিছুই হয়নি বলা চলে। নূতন কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে না। বেকারত্বের হার ৯.৩ শতাংশ। ভোগব্যয়ও তলানিতে। সরকারি ঋণের বোঝা জাতীয় আয়ের সমান সমান। কংগ্রেস অনুমতি না দিলে নতুন করে আর ঋণ করার উপায় নেই। হয়তো সরকার অনুমোদন পাবে, কিন্তু তা হলেই ঋণের বোঝা যে আরও বাড়বে। বাজেট ঘাটতি কমাতেই হবে, কিন্তু উপায় নেই বললেই হয়। মোট কথা, আমেরিকার অর্থব্যবস্থা আরও একটি বিপর্যয়ের অপেক্ষায়।
সরকারি ঋণ ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন অর্থব্যবস্থাকে গ্রাস করতে চলেছে। কোথায় ও কী ভাবে এই সমস্যার সমাধান, তা বলা মুশকিল। এই সমস্যার সমাধান খুঁজে না পেলে আর্থিক ক্ষেত্রে ফের ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। যেটাকে পরিভাষায় ‘ডবল ডিপ রিসেশন’ বলা হয়, তা-ই ছেয়ে যাবে বিশ্বের অর্থব্যবস্থায়। এই মুহূর্তে করণীয় একটাই কঠোর আর্থিক নীতির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলিকে সরকারি খরচ কমিয়ে আনতেই হবে।
সমস্যা হল, এ কথা বলা সহজ, করা কঠিন। জনসাধারণকে কচ্ছ্রসাধন করতে বললেই তারা করবে কেন? তারা কেন চাকরি হারিয়ে, সমস্ত রকম সরকারি দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে, চুপচাপ ঘরে বসে থাকবে? সমস্ত গ্রিসের শান্তিপ্রিয় মজা-মজলিশে অভ্যস্ত জনগণ আজ তাই রাস্তায় নেমে পড়েছে প্রতিবাদে। এর সঙ্গে আছে মূল্যবৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার। সমাধানের আলো ক্ষীণ, পথ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দুনিয়ার জনসংখ্যা বেড়ে সাতশো কোটি ছাড়িয়ে গেল, কিন্তু খাদ্য উৎপাদনে অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে। এক মহা খাদ্য সংকটের দিকে আমরা দ্রুত এগিয়ে চলেছি। বিশ্বের অর্থব্যবস্থায় কি তবে আশার আলো নেই?
সামনে অনিশ্চয়তা প্রচুর। বিশেষ করে উন্নত অর্থব্যবস্থার দেশগুলোর অবস্থা মোটেই আশাদায়ক নয়। সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অন্য অনেক অনিশ্চয়তা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই সামলানো যেতে পারে, যদি দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা, সংঘবদ্ধ ইউরোপ এবং উদীয়মান অর্থব্যবস্থার কিছু দেশ নিয়ে যে গ্রুপ অব টোয়েন্টি-র গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছিল, তার বিশেষ ভূমিকা আছে। এই জি-২০ কিন্তু এখনও নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ ভুলে দলবদ্ধ ভাবে কাজ করতে শেখেনি। এটাই দুর্ভাগ্যের কথা।

লেখক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, জে কে অর্গানাইজেশন, নয়া দিল্লি
Previous Story Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.