|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
প্রেসিডেন্সির হৃতগৌরব |
প্রেসিডেন্সি কলেজের (অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়) হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য বর্তমান সরকার সম্প্রতি মেন্টর গ্রুপ তৈরি ও তৎসহ কিছু অতি সদর্থক পদক্ষেপ করেছে। সমস্যা হল, সমাজ বা শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার উত্তরণ বা অবনমন দুটোই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি যাকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে। পুরনো অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন এ ক্ষেত্রে লাভজনক হতে পারে। প্রাক্তনী হিসাবে তাই এই পত্রের অবতারণা।
সময়টা নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক। প্রেসিডেন্সির গৌরব তখন অনেকটাই অস্তমিত। অর্থনীতি বিভাগের দিকপালরা প্রায় সকলেই চলে গেছেন। ভূতত্ত্ব বিভাগেও সময় খুব সুখের নয়। তবুও কলেজের প্রথিতযশা কয়েক জন শিক্ষকের দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম ও গবেষণার ফলে ইউ জি সি ভূতত্ত্ব বিভাগকে ‘সেন্টার অফ এক্সলেন্স’ ঘোষণা করে। বিপুল আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়। যার অর্থমূল্য ছিল প্রায় চার কোটির কাছাকাছি। আজকের দিনে হিসেব করলে যে কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই যে অনুদান শ্লাঘার কারণ হতে পারে। উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের প্রাচীনতম পাথরগুলির ও খনিজ পদার্থের বয়স ও উৎপত্তির কারণ নির্ণয় করা এবং তৎসংলগ্ন গবেষণাতে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ প্রদান করা। কেনা হয়েছিল দু’ কোটি টাকা মূল্যের অতি দামি মাস স্পেকট্রোমিটার যন্ত্র যা সে সময় ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিল না। প্রেসিডেন্সির মতো আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কলেজে তো নয়ই।
ইউ জি সি-র শর্ত ছিল একটাই। প্রথম পাঁচ বছর তাদের দেওয়া আর্থিক সহায়তার পর সেন্টারটি রাজ্য সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হবে। যে অধ্যাপক বা গবেষেকদের নিয়োগ করা হবে, নির্দিষ্ট পাঁচ বছর উত্তীর্ণ হলে তাঁদের দায়িত্বও রাজ্য সরকারের উপর বর্তাবে। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৮৬-’৮৭ সালে সেন্টারটি শুরু হয় ও তার মেয়াদকাল শেষ হয় ’৯১-’৯২ সাল নাগাদ। এই দীর্ঘ পাঁচ বছর শিক্ষা দফতর অধ্যাপক, গবেষক নিয়োগ করার প্রাথমিক প্রক্রিয়াটুকুও করে উঠতে পারেনি। ফলে, ইউ জি সি-র টাকাতে কেনা যন্ত্র দিনের পর দিন অব্যবহৃত অবস্থাতে পড়ে থাকে। দরিদ্র দেশে সাধারণ মানুষের করের টাকা নষ্ট করে এই বিলাসিতা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা কখনও ভেবে দেখেনি শিক্ষা দফতর। |
|
তখন আমি সদ্য পিএইচ ডি করেছি ভারত সরকারের মহাকাশ বিভাগের অধীনে একটি গবেষণাগার থেকে। যার বিষয়বস্তু ও সেন্টারের কাজের ভিতর অনেক সাযুজ্য। সেন্টারটির প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্য ভূতত্ত্ববিদ প্রয়াত অধ্যাপক অজিত সাহার আমন্ত্রণে আমি সেখানে যোগ দিই এবং কাজ শুরু করি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পারি সেন্টারটি প্রায় অনাথ। রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের কোনও গরজ নেই। গবেষণার টাকা জোগানো তো দূর অস্ত্, গবেষক বা অন্য অশিক্ষক কর্মচারীদের বেতনও ছিল অনিয়মিত। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ থেকে আমার বেতন নিয়মিতই আসত, কিন্তু মাঝে মাঝেই শুনতে পেতাম যে অর্থনীতি ও ভূতত্ত্বের নামী অধ্যাপককেও নাকি আমলাদের কাছে দৌড়তে হয় মাস-মাইনের জন্য। আমি তখন বেশ দ্বিধাগ্রস্ত। কী ভবিষ্যৎ এই সেন্টারের? এক দিন জানতে পারলাম, তৎকালীন উচ্চশিক্ষা দফতর কয়েক জন বরিষ্ঠ অধ্যাপকের সঙ্গে আলোচনার সময় প্রশ্ন তুলেছে যে প্রেসিডেন্সি কেন এত টাকা পাবে? অন্য কলেজগুলো কী দোষ করেছে? সেই আলোচনার চূড়ান্ত ফল কী হয়েছিল জানি না। কিন্তু আমি বুঝে গেলাম ইউ জি সি-র সেন্টার অফ এক্সলেন্স তৈরির চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে এখানকার আসমান-জমিন ফারাক। পরের বছরই আমি প্রেসিডেন্সি ছেড়ে ইন্ডিয়ান স্কুল অব মাইনস-এ পড়াতে চলে যাই।
কিন্তু এতগুলো টাকা যেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেই সেন্টারটি চলবে না এটা আমার কাছে বেশ কষ্টদায়ক ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তো খুবই দরিদ্র দশা। আমাদের সব গবেষণাই বিদেশের মুখাপেক্ষী। বিদেশে না গেলে আমাদের ছাত্ররা তো আধুনিক গবেষণাগারের পরিকাঠামো কী মানের হতে পারে তার কোনও ধারণাই পায় না। এমন একটা বিপুল আয়োজন নষ্ট হয়ে যাবে? কিন্তু করার কিছুই ছিল না। পরে ইউ জি সি-র বিশেষ পরিদর্শক দলও এই অব্যবস্থার জন্য বারংবার তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
উচ্চশিক্ষার সমানাধিকার কথাটি শুনতে ভালই কিন্তু খোদ মস্কোতেই ছিল দুটো বিশ্ববিদ্যালয় প্যাট্রিস লুমুম্বা ও মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি। দ্বিতীয়টির গুণগত মান, আর্থিক অনুদানের পরিমাণ বা অধ্যাপকদের সুযোগ-সুবিধা প্রথমটির তুলনায় ছিল অনেক বেশি। হেনরি কিসিংগারের সেই অতি প্রচলিত উক্তি ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি কলুষিত তার আসল কারণই হল, ঝুঁকির পরিমাণ অতি কম’। হয়তো এখন উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে আর তত প্রযোজ্য নয়, যতটা আমাদের মতো উন্নতিশীল দেশের ক্ষেত্রে। আমার বেশ মনে পড়ে, হাল না ছেড়ে শেষমেশ আমি একটা প্রতিবেদনও দিয়েছিলাম তৎকালীন উচ্চশিক্ষা অধিকর্তাকে ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। কী করলে দেরিতে হলেও সেন্টারটিকে বাঁচানো যায়। কোনও কিছুই হয়নি। অত দামি সব যন্ত্র শ্বেতহস্তীর মতো রয়ে গেল কলেজের এক কোণে। হয়তো আজও আছে।
আজ এত বছর পর পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় এই অবহেলা এবং অপমান প্রেসিডেন্সি বা তার সেই নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপকদের প্রাপ্য ছিল না। কাগজে পড়েছি, মেন্টর গ্রুপ প্রেসিডেন্সির গবেষণা ও পঠনপাঠনকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে চায়। যে জিনিসটি না-হলে সব আয়োজনই বৃথা হবে তা হল, অ্যাকাউন্টেবিলিটি। সরকার আসে সরকার যায়। চিরন্তন থেকে যায় শিক্ষক-গবেষকের আজন্মলালিত মূল্যবোধ। তার অবক্ষয় রোধ করার একমাত্র পথ সম্পূর্ণ পেশাদারি উপায়ে পুরস্কার ও তিরস্কার নীতি গ্রহণ করা। প্রশ্ন হল, কতটা কঠোর হাতে সরকার বা মেন্টর গ্রুপ তা বাস্তবায়িত করতে পারবে? বঙ্গ সন্তানদের শিরদাঁড়া খুব সোজা নেই যে আর! |
অনিন্দ্য সরকার। অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও ভূপদার্থ বিভাগ এবং প্রধান, ন্যাশনাল আইসোটেপ জিওকেমিস্ট্রি ফেসিলিটি, আই আই টি, খড়্গপুর। |
|
|
|
|
|