উল্টোডাঙার আবাসনে তাণ্ডব
হাত বেঁধে মুখে প্লাস্টিক গুঁজে ডাকাতি, মৃত্যু বৃদ্ধার
খাস কলকাতা শহরে পুলিশ আবাসন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বহুতল আবাসনের এক ফ্ল্যাটে পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে তাণ্ডব চালাল ডাকাতরা। তা-ও দিনেদুপুরে। বাড়ির অন্য মহিলাদের তো বটেই, ৯২ বছরের এক বৃদ্ধাকেও তারা বিন্দুমাত্র দয়ামায়া দেখায়নি। যার জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই বৃদ্ধা। পরে মারা যান। অথচ, আবাসনটি থেকে ১০০ নম্বরে ডায়াল করা সত্ত্বেও, কোনও সাহায্য আসেনি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ফোনটাই কেউ তোলেনি!
উল্টোডাঙার ইএম বাইপাস সংলগ্ন এই এলাকায় পুলিশের নজরদারি যে কম, সে কথা কবুল করলেন পুলিশ আবাসনের এক বাসিন্দাই। জানালেন, তাই এখানে মাঝেমধ্যেই ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু বুধবার দুপুরে পুলিশ আবাসনের পিছনের বহুতল আবাসনটিতে যা ঘটল, তা চুরি-ছিনতাইয়ের থেকে অনেক ভয়াবহ। এবং যথেষ্টই উদ্বেগের। যার জেরে এই এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তো উঠলই। আরও প্রশ্ন উঠল বহুতল আবাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও। ঘটনাটি দেখিয়ে দিল, আবাসনে ২৪ ঘণ্টা নজরদারির প্রতিশ্রুতি আসলে কত ঠুনকো!
ভরদুপুরে কলিং বেল শুনে দরজা খুলেছিলেন ৯২ বছরের বৃদ্ধা শান্তা ভট্টাচার্য। খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে চার জন। এক জনের হাতে রিভলভার। আর এক জনের হাতে ভোজালি। দরজা বন্ধ এক এক করে তারা বাঁধে শান্তাদেবী, তাঁর পুত্রবধূ শুভলক্ষ্মী এবং পরিচারিকা বীণা গঙ্গোপাধ্যায়কে।
ভেঙে পড়েছেন শান্তাদেবীর পুত্রবধূ শুভলক্ষ্মী।
শুধু জোর দিয়ে টেনে পিছমোড়া করে বাঁধাই নয়, মুখ বন্ধ রাখতে শান্তাদেবীর মুখে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল প্লাস্টিক। যার ফলে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল তাঁর। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ফ্ল্যাটমালিকরা জানিয়েছেন, সোনার গয়না, নগদ টাকা ও দু’টি মোবাইল ফোন নিয়ে গিয়েছে ডাকাতেরা। ঘটনার তদন্তে নেমেছে মানিকতলা থানা এবং কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ।
পুলিশ জানায়, ‘বিধান নিবাস’-এর ‘এন’ ব্লকের ‘এন ১ এস ডব্লিউ ৪’ নম্বরের ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন শান্তাদেবী এবং তাঁর পুত্রবধূ শুভলক্ষ্মী। ৮৭০ বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটটি শান্তাদেবীর ছেলে সূর্যনারায়ণের। তিনি একটি বিমানসংস্থার পদস্থ কর্তা। কর্মসূত্রে থাকেন চেন্নাইয়ে। শুভলক্ষ্মী সল্টলেকের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান। সূর্যশেখর ও শুভলক্ষ্মীর একমাত্র ছেলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সে গুজরাতের গাঁধীনগরে পড়াশোনা করে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ ওই ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজে। শুভলক্ষ্মী তখন বাথরুমে। পরিচারিকা বীণাদেবীও অন্য একটি বাথরুমে। তাই দরজা খোলেন শান্তাদেবীই। ছোটখাটো চেহারার শান্তাদেবীর চোখ ‘আইহোল’ পর্যন্ত পৌঁছয় না। পুলিশের ধারণা, সে কারণেই দরজার ও পাশে কারা রয়েছে, তা বুঝতে পারেননি তিনি। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্র হাতে হুড়মুড়িয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে চার দুষ্কৃতী। বীণাদেবীর কথায়, “বাথরুম থেকে বেরোতেই আমাকে জাপটে ধরে দু’জন। এক জন মুখের সামনে ভোজালি তুলে ধরে। অন্য জন সামনে ধরে রিভলভার।” বীণাদেবী জানিয়েছেন, কিছু বোঝার আগেই জোর করে তাঁর মুখে কাপড় ঠুসে দেয় দুষ্কৃতীরা। তত ক্ষণে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন শুভলক্ষ্মীও। একে-একে বীণাদেবী ও শুভলক্ষ্মীর মুখ ও হাত বাঁধে দুষ্কৃতীরা। ইতিমধ্যে শান্তাদেবীকেও একই ভাবে বেঁধে রেখেছে দুষ্কৃতারী। তার মুখে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল প্লাস্টিক। তাতে তাঁর রীতিমতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বলে বীণাদেবী জানিয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জেনেছে, প্লাস্টিক ছাড়া ওই তিন মহিলাকে বাঁধার জন্য ছোট দড়ি, শাড়ি, জামা ইত্যাদি ব্যবহার করেছিল দুষ্কৃতীরা। ওই ফ্ল্যাট থেকেই তা তারা জোগাড় করে নেয়।
বিধান নিবাসের এই ফ্ল্যাটটিতেই বৃদ্ধাকে খুন করে ডাকাতি হয়েছে।
এর পর টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ফ্ল্যাটে তাণ্ডব চালিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। যাওয়ার সময় বলে যায়, ‘আমরা পাশের ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। চেঁচামেচি করলে বিপদ হবে।’ বীণাদেবী বলেন, “আমার বাঁধন তেমন একটা শক্ত ছিল না। আমার হাত বাঁধা হয়েছিল সামনের দিকে। বৌদিদের হাত বাঁধা হয় পিছমোড়া করে। আমি কোনও মতে ঘষটাতে ঘষটাতে বৌদি (শুভলক্ষ্মী)-র কাছে যেতে পারি। কষ্ট করে তাঁর বাঁধন খুলি।” পুলিশকর্মীরা অবশ্য জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে পৌঁছে বীণাদেবীকে তাঁরা বাঁধা অবস্থাতে দেখেছিলেন। বীণাদেবীর বক্তব্যে এই অসঙ্গতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
পুলিশ জানায়, শুভলক্ষ্মী কোনও মতে বারান্দায় গিয়ে ফ্ল্যাটের নীচে অপেক্ষারত তাঁদের গাড়ির চালককে ডাকেন। গাড়িচালক মিহিরকুমার বড়ুয়ার কথায়, “আমার তখন একটু চোখ বুজে এসেছিল। বৌদির (শুভলক্ষ্মী) ডাকে হুঁশ ফেরে।” এর পর ছুটে উপরে যান মিহির। তাঁর মারফতই ঘটনাটি জানতে পারেন আবাসনের বাসিন্দারা। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দময়ন্তী সেন জানিয়েছেন, প্রথমে ইএম বাইপাস সংলগ্ন একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় শান্তাদেবীকে। সেখান থেকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
পরিচারিকা বীণা গঙ্গোপাধ্যায়
আবাসনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত এক মাস ধরে সেখানে রঙের কাজ হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশের অনুমান, রং-মিস্ত্রি সেজে ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল দুষ্কৃতীরা। বস্তুত, এ দিন ডাকাতির পরে তদন্তে এসে রং-মাখা জামাকাপড় উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র এবং একটি ভোজালিও। সূর্যবাবুদের ফ্ল্যাটে যিনি রান্নার কাজ করেন, সেই ছবি যাদব পরে বলেন, “ফ্ল্যাটে এ দিন কোনও রঙের কাজ ছিল না। কিছু দিন আগে দরজা-জানলা-গ্রিলে রং করা হয়ে গিয়েছে। তবে কখনওই মিস্ত্রিরা ফ্ল্যাটে কাজ করার আগাম খবর দিতেন না। যখন-তখন এসে বেল বাজাতেন।” পুলিশের ধারণা, মিস্ত্রিদের এই ‘অভ্যাস’ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল দুষ্কৃতীরা। সে কারণেই এ দিন দুপুরে আচমকা বেল বাজিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকতে সুবিধা হয়েছিল দুষ্কৃতীদের। বীণাদেবীও বলেন, “যারা এসেছিল, তাদের কয়েক জনকে মাঝেমধ্যেই ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখেছি।” বীণাদেবীর ওই বক্তব্যও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
আবাসনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এ বার মুন্না মাহাতো বলে এক ব্যক্তিকে রং ও মেরামতির ঠিকা দেওয়া হয়েছিল। তিনি একটি রং সংস্থার ঠিকাদার। চুক্তি অনুযায়ী, ঠিকাদার সংস্থার শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেক সময়ই তা দেওয়া হত না বলে জানা গিয়েছে। রঙের মিস্ত্রিদের অনেকেই আবাসনের ভিতরে থাকতেন। কয়েক জন অবশ্য বাইরে থেকে রোজ যাতায়াত করতেন। এ দিন পুলিশ ঠিকা শ্রমিকদের সুপারভাইজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রাতে কয়েক জন রং মিস্ত্রিকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ডাকাতি সেরে আবাসন থেকে কী ভাবে পালাল ডাকাতরা?
আবাসনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শান্তাদেবীদের বাড়ির ছাদে উঠলে সহজেই বাইরে বেরিয়ে যাওয়া যায়। কারণ, এই ছাদগুলি একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। এ ভাবেই বিধান শিশু সরণির দিকের গেট দিয়ে ঢুকে বাইপাসের ধারের গেটের দিকে সহজে চলে যাওয়া সম্ভব। তবে ঘটনাস্থলে আনা পুলিশ কুকুর অবশ্য ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে ‘প্রবেশ ফটক’-এর দিকেই যায়। তাই দুষ্কৃতীরা সবার চোখের সামনে দিয়েও যেতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। দু’টি সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
এ দিনের ঘটনার পরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আবাসনের বাসিন্দারা। আবাসন কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক কাশীনাথ পাল বলেন, “ঘটনার কথা জানতে পেরে আমি ল্যান্ডলাইন থেকে ১০০ নম্বরে ফোন করি। সেটি বেজে যায়।” এর পরে তিনি ফোন করেন আবাসনের এক বাসিন্দা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। সোমনাথবাবু অবশ্য বলেন, “কাশীনাথবাবুর ফোন পেয়েই আমি লালবাজার কন্ট্রোল রুমে ফোন করি। সেখান থেকে আবাসনের ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়।” ‘১০০ ডায়াল’ নিয়ে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে যুগ্ন কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম বলেন, “বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত খোঁজ নিতে বলেছি।”
যে আবাসন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পুলিশের আবাসন, সেখানে এ ধরনের ঘটনার জেরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে এলাকায়। বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় নামে পুলিশ আবাসনের এক বাসিন্দার অভিযোগ, “এই নির্জন এলাকায় পুলিশের নজরদারি তেমন একটা নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যেই ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটে এখানে।”
এমন এলাকায় বহুতলে যতটা কড়া নজরদারি থাকা দরকার, সেটা কি ছিল বিধান নিবাস-এ? আবাসন কমিটি জানায়, ওই আবাসনে তিন জন নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন। তিন দফায় (প্রতি ৮ ঘণ্টা অন্তর) কাজ করেন তাঁরা। আবাসনে ঢোকার সময় নিরাপত্তারক্ষীকে পরিচয় জানাতে হয়। যে ফ্ল্যাটে যেতে চান ওই ব্যক্তি, ‘ইন্টারকম’-এ সেখানে কল করেন নিরাপত্তারক্ষী। তবে তিন জন নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে যে এত বড় আবাসনের সুরক্ষা সম্ভব নয়, তা স্বীকার করে নিয়েছেন আবাসনের বাসিন্দাদের একাংশ।

নিজস্ব চিত্র
First Page Calcutta Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.