|
|
|
|
সন্দেহ আমির রেজার দিকেই |
হাজার টাকার জাল নোট ছড়াচ্ছে রাজ্যে |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
আর শুধু পাঁচশো টাকার নোট নয়। এ বার ব্যাপক হারে জাল হচ্ছে হাজার টাকার নোটও। এবং সেই জাল নোট ছড়িয়ে পড়ছে কলকাতা তথা গোটা পশ্চিমবঙ্গে।
মুম্বই বিস্ফোরণের সঙ্গে কলকাতার ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন-জঙ্গি তথা দাউদ ইব্রাহিম ঘনিষ্ঠ আমির রেজা খানের যোগসূত্র খুঁজতে নেমেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী। সেই তদন্তে উঠে এল, কী ভাবে আমিরের দলবল জাল নোটের, বিশেষ করে হাজার টাকার জাল নোটের ব্যবসা শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “আগে ওরা পাঁচশো টাকার নোট জাল করত। এখন হাজার টাকার নোটও জাল করা শুরু করেছে। এতটাই নিপুণ ভাবে ওরা জাল নোট ছাপাচ্ছে যে, আসলের সঙ্গে ফারাক করা মুশকিল।” আমিরের দলবলের বেশ কয়েক জনের কাছ থেকে সম্প্রতি এই ধরনের নোট উদ্ধার হয়েছে। পূর্ব কলকাতার বেনিয়াপুকুরের মফিদুল ইসলাম লেনে বড় হয়ে ওঠা আমির রেজা খান বর্তমানে দাউদ ইব্রাহিমের অন্যতম প্রধান ‘এজেন্ট’। কলকাতারই একটি কলেজে পড়াশোনা করা এই আমির ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, পাকিস্তানের হাতে পঞ্চাশ জন অপরাধীর নামের সংশোধিত তালিকা তুলে দিয়েছে ভারত, সেখানে দু’জন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গির নাম রয়েছে। তাদের এক জন আমির রেজা খান।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কলকাতায় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের ‘স্লিপিং সেল’ তৈরির পাশাপাশি সে কেন জাল নোটের ব্যবসায় নেমেছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, জঙ্গি-কার্যকলাপে আর্থিক মদত দেওয়ার জন্য যে কোনও উপায়ে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছে আমির ও তার দলবল। গত বছর মার্চে কলকাতার চার জন শিল্পপতি ও হোটেল-মালিকের কাছে বিরাট অঙ্কের টাকা চেয়ে ফোন আসে। ফোনে হুমকি দেওয়া হয়, টাকা না দিলে ওই শিল্পপতিদের অবস্থাও খাদিম-কর্তার মতো হবে। আমির রেজা খানের নির্দেশেই এই সব হুমকি ফোন এসেছিল বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব সম্প্রতি ‘জাতীয় তদন্ত সংস্থা’-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, হুমকি দিয়ে তোলা আদায়ের পাশাপাশি আরও সহজ পথে টাকা জোগাড়ের চেষ্টাতেই জাল নোটের ব্যবসা শুরু করেছে আমিরের দলবল। চটজলদি আয়ের জন্য পাঁচশো টাকার সঙ্গে তাই হাজার টাকার নোটও জাল করা হচ্ছে।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, পাঁচশো টাকার নোট বাজারে চলে বেশি। তাই এত দিন এই নোটই বেশি জাল করা হত। এমনকী, জাল ও আসল নোটের ফারাক বোঝাতে সরকার যে সব বিজ্ঞাপন দেয়, সেখানেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঁচশো টাকার নোটের ছবিই দেখানো হয়। এ বার জঙ্গিরা শুধু হাজার টাকার নোট জাল করাই শুরু করেনি, অত্যন্ত ‘নিপুণ’ ভাবে করছে সেই কাজ। কলকাতা পুলিশের তরফে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানানো হয়েছে, সাধারণত গাঁধীর ছবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হরফের মতো যে সব চিহ্ন দেখে আসল ও জাল নোটের মধ্যে ফারাক করা যায়, সে সবই নকল করে ফেলছে আমিরের দলবল। তাই চট করে আসল-নকল বোঝা খুবই কঠিন কাজ।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আমির এখন পাকিস্তানে। সেখান থেকে কলকাতায় জাল নোট ছড়ানোর কাজে বাংলাদেশকে ‘পথ’ হিসেবে ব্যবহার করছে আমিররা। শেখ হাসিনার সরকার হুজি-জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সক্রিয়। কিন্তু আমির পাকিস্তানে বসেই হুজি-সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তাদের সাহায্যেই চট্টগ্রাম বন্দর বা অন্যান্য শহর থেকে কলকাতায় পৌঁছচ্ছে রাশি রাশি হাজার টাকার জাল নোট। এ রাজ্যের পাশাপাশি এই জাল নোট-চক্রের শিকড় ছড়িয়েছে বিহার, মহারাষ্ট্র, গুজরাতের মতো রাজ্যেও। মুম্বই-বিস্ফোরণের তদন্তের পাশাপাশি জাল নোটের তদন্তেও পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মহারাষ্ট্র ও গুজরাত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
সন্ত্রাসবাদে আমির রেজা খানের হাতেখড়ি দাদা আসিফের কাছে। আসিফই খাদিম-কর্তা অপহরণের পরিকল্পনা করে। মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে হামলাতেও সে জড়িত ছিল। এই দুই ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত আমিরও। তত দিনে সে দাদা আসিফের তৈরি জঙ্গি-সংগঠন ‘কম্যান্ডো ফোর্সে’ নাম লিখিয়েছে। ২০০১-এ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় আসিফ। তার বদলা নিতেই আমির পুরোপুরি জঙ্গি-কার্যকলাপে নেমে পড়ে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।
খাদিম-কর্তা অপহরণ এবং মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে হামলার পরে আমির বাংলাদেশ হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যায় বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে দাউদের সঙ্গে আমিরের বেশ কয়েক বার বৈঠক হয়েছে বলেও গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। পাকিস্তান থেকেই সে কলকাতায় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের কাজকর্ম ও জাল নোটের ব্যবসা চালাচ্ছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
আমির রেজা খান দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার স্ত্রী-কন্যা ও ভাইরা এখনও মফিদুল ইসলাম লেনেই থাকে। কিন্তু তাদের উপর নজর রাখা ছাড়া আর কিছু করার নেই কলকাতা পুলিশের। কারণ নির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া তাদের আটক বা গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। তবে আমিরের ডান হাত, বেনিয়াপুকুরের আর এক বাসিন্দা আবদুল্লা ওরফে নাটা মুম্বই-বিস্ফোরণের ঠিক আগেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে। আবদুল্লা এত দিন গোয়েন্দাদের নজরদারিতে ছিল। কিন্তু ১৩ জুলাই মুম্বইতে বিস্ফোরণের ঠিক আগে সে উধাও হয়ে যায়। আর তাই আবদুল্লা ১৩/৭-কাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে সন্দেহ করছে মহারাষ্ট্র-এটিএস।
মুম্বই-বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করছে, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্র করলেও দাউদ ইব্রাহিমের ডি-কোম্পানির লোকেরা স্থানীয় স্তরে তাদের সাহায্য করেছিল। সব দিক দেখে কলকাতার আমির রেজা খানের নামই সন্দেহের তালিকার শীর্ষে উঠে আসে। কারণ তার দু’দিকেই যোগাযোগ রয়েছে। আর এই সূত্র ধরে তদন্তেই জানা যায় হাজার টাকার নোট জাল করার কথা। |
|
|
|
|
|