|
|
|
|
|
|
স্বাধীনতা = দায়িত্ব |
‘কলেজে উঠে অনেক স্বাধীনতা পাবে ঠিকই। কিন্তু মনে রেখো ‘স্বাধীনতা’র উল্টো দিকটা আসলে ‘দায়িত্ব’।
নিজের দায়িত্ব। বিশেষ করে নিজের পড়াশোনার কথা, ভবিষ্যতের কথা ভুলে গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে।
স্কুল থেকে যারা কলেজে পৌঁছলে তাদের জন্য কিছু পরামর্শ দিচ্ছে প্রস্তুতি। |
স্কুল থেকে কলেজ, মানে অনেকের কাছেই গলি থেকে রাজপথ, কিংবা গ্রাম থেকে শহর, এমনকী দেশ থেকে বিদেশ। নিঃসন্দেহে এটা জীবনের একটা খুব বড় সন্ধিক্ষণ। এই পরিবর্তন কী ভাবে মোকাবিলা করবে? স্কুল থেকে কলেজে পৌঁছলে যারা, তাদের কয়েকটা কথা ভেবে দেখতে বলি।
প্রথমেই একেবারে পড়াশোনার কথা। কলেজে উঠে পড়াশোনার ধরন এবং পদ্ধতি অনেকটা পালটায়। উচ্চ মাধ্যমিকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পাঠ্যবই পাওয়া যায়। মুশকিল হল, স্নাতকস্তরে উন্নত মানের এমন কোনও দেশি বা বিদেশি বই নেই যেখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পুরো সিলেবাস কভার করা থাকে। এর সমাধান একটাই। একই বিষয়ে অনেকগুলি বই পড়া। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অনেক সময়েই যে কোনও বিষয়ে একাধিক পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজন হয় ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। সে ক্ষেত্রে হয় ছেলেমেয়েরা সেই সমস্ত বইপত্র কিনে নেয় অথবা বন্ধুবান্ধব বা দাদাদিদিদের কাছ থেকে জোগাড় করে নেয়। কলেজ স্তরে কিন্তু অত বই কেনা খরচসাপেক্ষ, জোগাড় করাও মুশকিল। তাই, কলেজে ভর্তি হয়ে লাইব্রেরি যাওয়ার অভ্যেস করে ফেলো। পড়াশোনার পরিধি বাড়াতে চাইলে কলেজের লাইব্রেরি ছাড়াও অন্যান্য লাইব্রেরির মেম্বারশিপ করিয়ে নাও। যেমন, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকান সেন্টার ইত্যাদি।
আর একটা জিনিস খুব কাজে আসবে কলেজ জীবনে। ইন্টারনেট। দেশবিদেশের বহু নামী কলেজের ওয়েবসাইটের খোঁজ এখানে তোমরা পাবে। সেই সব সাইটে অনেক সময়েই নামী অধ্যাপকদের কাজকর্মের বৃত্তান্ত বা লেকচার নোটস পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আছে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য বিশেষ বিশেষ ওয়েবসাইট। তবে এই সব লেখার বড় অংশ ব্যবহার করতে চাইলে কপিরাইট-এর ব্যাপারটা মাথায় রেখো।
স্কুলে ক্লাসে মন দিয়ে শুনলেই অনেকটা পড়া হয়ে যেত। কলেজে কিন্তু অনেক সময়েই নোট নেওয়ার অভ্যেস করতে হবে। ক্লাসে লেকচার শুনে ও বুঝে একই সঙ্গে নোট নেওয়াটা বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু সেটাই শিক্ষণীয়। যতই বই পড়ে নিজেরা বোঝো না কেন মাস্টারমশাইরা তো অনেক দিনের পড়ানোর অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়গুলি তোমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। তাতে বিষয়টার অন্যান্য দিকগুলিও তোমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, যেগুলি হয়তো তোমরা সে ভাবে ভাবোইনি। যাদের এই বাড়তি দক্ষতা থাকে, তাদের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। |
|
নোট নেওয়ার আর একটা সুবিধে হল লেখার স্পিড বৃদ্ধি। পরীক্ষার সময় যেটা খুব কাজে আসে। এখন বাজারে যে সমস্ত মোবাইল পাওয়া যায় সেগুলিতে প্রায় আধ থেকে এক ঘন্টা রেকর্ডিং করার সুযোগ থাকে। স্যরের লেকচার রেকর্ড করতেই পারো। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে নোটও নিতে থাকা উচিত। রেকর্ডিং করা থাকলে কোথাও কোনও মিস হয়ে গেলে পরে সেটা তুমি বাড়িতে গিয়ে যোগ করে নিতে পারবে। তা ছাড়া, নোট নিলে মনে থাকে অনেক বেশি। সব সময় নিজে যা বুঝলে সেই মতো নোট নেওয়ার চেষ্টা করো। বন্ধুর নোট জেরক্স করে পড়া আর নিজের নোট পড়ার মধ্যে তফাত থাকেই।
কলেজে অধ্যাপকদের পক্ষে আলাদা করে প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। এখানে কিন্তু উদ্যোগটা তোমাকেই নিতে হবে। ক্লাসের মধ্যে শিক্ষক বুঝিয়ে যাওয়ার পর তোমার যদি কোনও প্রশ্ন বা দ্বিধা থাকে তা হলে ক্লাস শেষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে যাও। তাঁকে তোমার অসুবিধার কথা জানাও। কোনও ফাঁকা পিরিয়ড বা ছুটির পর, যখন সময় দেবেন তাঁর কাছে গিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করে নাও। অধিকাংশ শিক্ষকই কিন্তু ছাত্রদের এই বাড়তি জানার ইচ্ছেটাকে পছন্দ করেন ও মর্যাদা দেন। এর ফলে তোমার জানার পরিধিটা যেমন বাড়বে তেমনই শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্কটাও ক্রমে ক্রমে সহজ হয়ে যাবে। বিষয়টা তোমরা কতটা শিখলে বা জানলে তার শেষ বিচার তো হয় পরীক্ষার খাতায়। সে ক্ষেত্রে কী ভাবে উত্তর করতে হয় সেটা জানাও জরুরি। শিক্ষকদের কাছ থেকে বড় প্রশ্ন বা টীকা লেখার ধরন জেনে নিতে ভুলো না। এর জন্য টিউটোরিয়াল বা ক্লাস টেস্ট-এর খাতা শিক্ষকের কাছে নিয়ে গিয়ে খামতির জায়গাগুলি দেখে নাও।
কলেজে ঢোকার পর আর কয়েকটি বিষয়ের সম্বন্ধে তোমাদের জানিয়ে রাখতে চাই। যেমন, পোশাক। স্কুলের ইউনিফর্ম ছেড়ে নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। কলেজে পোশাকের ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা নিশ্চয়ই উপভোগ করার। তবে অনেক সময়েই এই মজার সঙ্গে মনে একটা সাহসী ভাব জাগে। বাধা অতিক্রম করার প্রবণতা তৈরি হয়। এটা খেয়াল রাখতে হবে যে তুমি যা-ই পরো না কেন সেটা যেন খুব উগ্র না লাগে। ভুলে যেয়ো না, কলেজও একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আর একটা ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতে হয়। ছাত্র ইউনিয়ন। যে বয়েসে তোমরা কলেজে পড়তে আসো সেই সময়ে রাজনীতির প্রতি একটা আগ্রহ সাধারণত তৈরি হয়। তবে পড়াশোনা ও রাজনীতি দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে না পারলে বা ঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারলে কিন্তু পড়াশোনার মূল কাজটাই শিকেয় উঠবে। তাই ইউনিয়ন করার প্রস্তাব বা চাপ এলে নিজের বোধবুদ্ধি প্রয়োগ করো। আর যদি বুঝতে না পারো তা হলে বাবা মা, দাদা দিদি বা কোনও শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শ নাও।
একটা কথা মনে রেখো। কলেজে উঠে অনেক কিছুতেই তোমরা স্বাধীনতা পাবে ঠিকই। কিন্তু সেটার অপব্যবহার কোরো না। একেবারে গোড়ার দিন থেকেই মনে রেখো ‘স্বাধীনতা’র উল্টো দিকটা আসলে ‘দায়িত্ব’। নিজের দায়িত্ব। সেটা কিন্তু কম কঠিন কাজ নয়। বিশেষ করে নিজের পড়াশোনার কথা, ভবিষ্যতের কথা ভুলে গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে। অপূরণীয় ক্ষতি। তাই বলে এটা বলছি না যে সব কিছু ছেড়ে শুধু পড়াশোনাই করতে। সবই করবে, কিন্তু পড়াশোনার সময়টা কম্প্রোমাইজ না করে। নিজেকে এক দিন যখন প্রতিষ্ঠা করতে
পারবে, তখন দেখবে কলেজ লাইফের এই দিনগুলির কথা মধুর স্মৃতি হয়ে ভেসে উঠছে।
|
বারো বছর পরে যেন সেই ছোটবেলার অনুভূতিগুলো |
স্কুল থেকে কলেজ জীবনের এই পালাবদলের সম্মুখীন একদিন না একদিন সকলকেই হতে হয়। আর মা-বাবার হাত ধরে প্রথম দিন যাওয়া নয়, নিজের চলার পথ নিজেই বেছে নেওয়া। প্রথম প্রথম সব কিছু অচেনা লাগা, কাউকে চিনতে না-পারা এই সমস্ত অনুভূতিগুলি যেন বারো বছর পর আবার ফিরে আসে। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কও এই দুই জায়গায় একেবারেই অন্য রকম। স্কুলের শ্রেণিশিক্ষকের ছোট পরিসরের গণ্ডিটাও ছিল ছোট, কিন্তু কলেজের সব কিছুর সীমানাই যেন অনেকটা বেশি বিস্তৃত। এখন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কিছুটা অধরা মনে হয়, কোনও কিছু বুঝতে না পারলে জিজ্ঞাসা করার আগে খানিকটা দ্বিধাবোধ হয়। হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই আবার চেনা ছকে পড়ে যাবে। পরিবর্তন আসে বন্ধুমহলেও। এত দিনের চেনা-পরিচিত বন্ধুরা প্রায় সবাই ছিটকে গেছে, এখন আবার নতুন করে নতুন বন্ধু বানানো, নতুন করে সকলকে চেনা। যদিও এটা সত্যি যে, অনেকের ক্ষেত্রেই স্কুল জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে যে হৃদ্যতা, যে বোঝাপড়া, সেটা কলেজ-জীবনে আসে না হয়তো সময়ের অভাবে, কিংবা শৈশবের সরলতার অভাবে।
দয়িতা সাহা, প্রথম বর্ষ, রসায়ন বিভাগ, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ।
|
নিরীহ স্বপ্নগুলো আচমকা সাবালক |
কলেজ ... তিন অক্ষরের মায়াময়ী শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে ডিসিপ্লিন, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক নামক নানা হার্ডল টপকানোর পর নানা অচেনা আনন্দের হদিশ দেওয়া একটা ক্যাম্পাসের ইমেজ, যেখানে কেরিয়ার, কবিতা, আড্ডা, ফ্রিকিং আউট কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। পনেরো বছর স্কুল জীবনের রেললাইনে এক নাগাড়ে ইস্পাত আর বিদ্যুতের ঘোষণা মাফিক হাঁটার পর যখন জীবন আচমকা এরোপ্লেনের রূপ নেয়, সামনে চরে বেড়াবার উন্মুক্ত আকাশ তখন নিজের পছন্দের সাবজেক্টে অনার্স, সমমনস্ক বন্ধুবান্ধব বা যাদবপুরে পড়ার সৌভাগ্য থাকলে ঝিলপাড়, গ্রিন জোন, মিলনদা, নেপালদা, ওয়ার্ল্ড ভিউ ইত্যাদির হাতছানি জীবনে আনে নতুন মোড়, ঘুমে জাগরণে নতুন দিগন্ত।
লাইব্রেরির অনন্ত বিস্তৃত জ্ঞানভাণ্ডারে বই ঘাঁটা বা প্রিয় পি বি, এ ডি জি, আর বি সি, এ এল, এ জি, এস সি এইচ স্যর-ম্যামদের ক্লাস করার পাশাপাশি কলেজ লাইফ আনে সদ্য যৌবনে বসন্তের দুরন্ত হাওয়া, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকারা দাদা-দিদি হয়ে যান, সিনিয়ররা ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড। লুকিয়ে-চুরিয়ে অলিতে-গলিতে সিগারেটে টান রূপান্তরিত হয় ক্যান্টিনে পা তুলে বসা দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানব ইঞ্জিন জন হেনরিতে। কলেজ লাইফে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কোন ক্লাসটা রকিং আর কোনটা বোরিং। এবং সেই মতো একশো বছরের বিরক্তি সঞ্চারিত ভুলভাল ক্লাস কেটে ঠেক মারার বা নিভৃত আলাপচারিতার সময় বেরিয়ে যায়। স্কুল লাইফের নিরীহ স্বপ্নগুলো যেন কলেজে এসে আচমকা সাবালক হয়ে যায়।
দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায়, দ্বিতীয় বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। |
|
|
|
|
|
|