দুর্যোগের লর্ডস: সেই দ্রাবিড়-লক্ষ্মণের ত্রাতা হয়ে ওঠার অপেক্ষায় ভারত
ব্যতিক্রমী লর্ডসেই দ্বিতীয় টেস্ট হারের
দুর্যোগও তাড়া করছে ধোনিদের
গৌতম গম্ভীর: ফিল্ডিংয়ে আহত কনুইয়ের পাশটা ডিমের মতো ফুলে রয়েছে। ভেঙেছে কি না সেই এক্স-রে রিপোর্টের অপেক্ষায় টিম। রাতে জানা গেল ভাঙেনি কিন্তু এখনও ফুলে রয়েছে।
জাহির খান: হ্যামস্ট্রিং এখনও ভোগাচ্ছে। ভারতীয় শিবিরের যাবতীয় মিথ্যে প্রমাণ করে অনিশ্চিত পরের টেস্টেও।
সচিন তেন্ডুলকর: ভাইরালে আক্রান্ত থাকায় গোটা ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ফিল্ড করতে পারেননি। ইঞ্জেকশন নিয়েও দুর্বলতা যায়নি।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি: হাত-পা ভাঙার মতোই সাংঘাতিক। দ্বিতীয় ইনিংসেও ওভার রেট কম। ম্যাচ রেফারি রঞ্জন মদুগালের হাতে এখন ভাগ্য। তিনি যদি মনে করেন, এত সময় নেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না, তা হলে এক ম্যাচ সাসপেন্ড হবেন ধোনি। নটিংহ্যামে খেলা হবে না।
রোববার এমন একটা বিরল দিন গেল, যে দিন ম্যাচ জ্যান্ত থাকা অবস্থাতেও স্কোরবোর্ডের চেয়ে অনবরত গুরুত্ব পাচ্ছিল মেডিক্যাল বুলেটিন। আর রকমারি হিসেব। দিনের শেষ বলেও সেখানে টেস্টের ওপর আজকের মতো শাটার ডাউন হওয়ার উপায় নেই। আম্পায়াররা কী হিসেব কষবেন? সচিন তেন্ডুলকরকে সাত নম্বরের আগে ব্যাট করতে দেবেন কি না? ধোনিকে নিয়ে কী করা হবেসাসপেন্ড না বাঁচবেন? সাসপেন্ড হলে কি জীবনে প্রথম বারের মতো ভিভিএস লক্ষ্মণ ভারতের অধিনায়কত্ব করবেন?
হতাশ ধোনি।
এমন একটা দিন, যে দিন ভারত ০-১ নয়, প্রথম টেস্টেই দ্বিতীয় টেস্টও হারার দুর্যোগ দেখতে পাচ্ছে। কদাচিৎ এমন হয়। ধোনির ভারতের কপালে কখনও ঘটেছে বলে মনেই করতে পারছি না। ইংল্যান্ডে আজ পর্যন্ত বিগত ১৫ সফরের ১২ বার তারা সিরিজের প্রথম টেস্ট হেরেছে। ১২৮ ওভারে ৪৫৭ রান তুলতে হবে এই নিরাপদ ইংরেজ ডিক্লেয়ারেশনের সামনে পড়ে টেস্ট হারলে সেটা চরম অস্বাভাবিক কিছু হবে না। ক্রিকেটে হয়েই থাকে। কিন্তু লর্ডসেই যে যুগপৎ তাড়া করবে ট্রেন্টব্রিজের দুঃস্বপ্নব্যতিক্রমী তো নিশ্চয়ই!
ভারতের সর্বকালের সেরা চতুর্থ ইনিংস জুড়ি অবশ্য ক্রিজে। সেই দ্রাবিড়। সেই লক্ষ্মণ। একজন ওপেন করতে এসে দু’ঘণ্টা ধরে ইংরেজি সুইংয়ের বিষদাঁত সামলে গেলেন। পরের জন সোয়া ঘণ্টাতে কব্জির মহিমা প্রকাশ করেছেন। ধোনির ভাগ্যরেখায় আপাতত এঁরা দাঁড়িয়ে। এই জুড়ি দ্রুত বিছিন্ন হয়ে গেলে ম্যাচ হারার আশঙ্কা বাড়বে। উইকেট যাচ্ছেতাই নয়। কিন্তু এক-আধটা বল অফস্টাম্পের বাইরে মারাত্মক সুইং করছে। আরও একটা সমস্যা, দ্রুত উইকেট পড়লে চার নম্বরে নামতে পারবেন না সচিন তেন্ডুলকর। ইংল্যান্ড ইনিংসে বাইরে থাকার জন্য তাঁকে ব্যাটিংয়েও ২১৫ মিনিট বাইরে থাকতে হবে। তার মধ্যে আজ যা সময় গেল সেটা ধরে পড়ে থাকছে আরও দেড় ঘণ্টা। অথবা সাত নম্বরে নামা। গম্ভীর কত নম্বরে নামবেন সেটাও অজানা। তাঁর হাড় ভাঙেনি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যে জায়গায় লেগেছে ব্যাটিংয়ের সুইং-ই তো হবে না! সোমবার লর্ডসে ভারতের শুধু ম্যাচ বাঁচানোর অভিযান নয়, মিনি হাসপাতাল হয়ে যাওয়া শিবির থেকে সুস্বাস্থ্যের জীবনে উত্তরণও।
চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ছেন গম্ভীর।
দিনটা যে এমন মহানাটকীয় হবে কে জানত। বরং ধরে নেওয়া হয়েছিল যা-ই ঘটুক আজ বিশাল কোনও চাকা ঘোরার নয়। যা হওয়ার লাস্ট দিনে। বৃষ্টির দিনে যেমন সবচেয়ে জম্পেশ খিচুড়ি আর বেগুনভাজা, তেমনই যে দিনটা জমবে না বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে ক্রিকেট প্রেসবক্সে সে দিনের আদর্শ ‘পানীয়’ হল গভীর ক্রিকেটাড্ডা। রোববার যেমন। আম্পায়ার ‘প্লে’ ঘোষণা করার পরেও লর্ডস প্রেসবক্সের লাউঞ্জে ভিড়টা হাল্কা হচ্ছে না। ক্রিকেটার-সাংবাদিক-ভাষ্যকারের এক-একটা টেবিলে এক-এক রকম জমায়েত। একটা টেবিলে সৌরভ জমিয়ে বলছেন, ওয়াসিম আক্রমকে প্রথম খেলার অভিজ্ঞতার কথা। “শারজায় তখন আশির কাছাকাছি রানে ব্যাট করছি। শেষ কয়েক ওভার বাকি রয়েছে। ওয়াসিম বল করতে এসেছিল। ওকে স্টেপ আউট করতে গিয়ে আউট হলাম। ড্রেসিংরুমে সচিন আমায় আলাদা করে ডাকল। বলল, কীরে তুই! জানিস না দুনিয়ায় ওয়াসিম আক্রম এক জন, যাকে স্টেপ আউট করা যায় না! তখন আমি বললাম, কী করে জানব? ওকে তো আগে কোনও দিন খেলিইনি।”
আক্রম শুনতে পাচ্ছেন না সৌরভের তাঁকে ঘিরে প্রশংসার কথা। তিনি আর এক দিকে। কিছুটা অন্যমনস্ক। আনন্দবাজার-এর সঙ্গে ‘শেয়ার’ও করলেন তাঁর অন্যমনস্ক থাকার কারণ। “ইয়ান বোথাম কী অদ্ভুত না! কাল লন্ডনের একটা রেস্তোরাঁয় আমি, বোথাম আর স্টিভ ওয় খেতে গিয়েছিলাম (পাপারাৎজি কেন যে ছবি পায়নি আশ্চর্য)। খুব আড্ডা হচ্ছে। হঠাৎ বোথাম বলল, ওয়াসিম তোমার ওপর কিন্তু আমার প্রচণ্ড অভিমান আছে। নাইনটি টু ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে তুমি আমায় যেটা আউট করেছিলে সেটা মোটেও আমি আউট ছিলাম না।” বলতে বলতে আক্রমের মুখচোখ বদলে গেল। “আমি বললাম, আমার মনে হয়েছিল তুমি আউট। তাই অ্যাপিল করেছিলাম। তা ছাড়া তুমি কি আশা করেছিলে, ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে আম্পায়ার আউট দেওয়ার পর আমি সোনা মুখ করে বলব, এসো ভাই ফিরে এসো। আমায় খেলো।” আক্রমের অতর্কিত বাউন্সারে ব্যাটসম্যানের যা হাল হত, মনে হল স্যর ইয়ান বোথাম তাঁর হাল একই রকম করে ছেড়েছেন ঘটনার প্রায় কুড়ি বছর পর পুরোনো একটা আউটের প্রসঙ্গ তুলে।
বিষণ্ণ সচিন।
প্রেসবক্সেও অতর্কিত বাউন্সারের খেল। কেন না, টেস্টটা হঠাৎ ঘোরাতে শুরু করে দিলেন এমন দীর্ঘদেহী, যাঁর সম্পর্কে অনাস্থা প্রথম তিন দিনে সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে। কোনও এক ইশান্ত শর্মা! ইশান্ত আচমকা এমন একটা স্পেল নার্সারি এন্ড থেকে শুরু করলেন যে লাউঞ্জের ভিড়টা হাল্কা হয়ে গিয়ে মনোযোগী ছাত্রের মতো যে যার সিটে বসে পড়ল। কাল খেলা শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক বাদে লর্ডসে যে কড়া পাহারা ডিঙিয়ে এক পুরুষ স্ট্রিকার মাঠে ঢুকে পড়েছিল তার চেয়েও আশ্চর্যজনক হঠাৎ ইশান্তের ঠিক লাইনটা পেয়ে যাওয়া। ইংল্যান্ড হঠাৎ ধসে পড়তে শুরু করল, ৬২-৫। ইশান্তের আবিষ্কর্তা দিলীপ বেঙ্গসরকর তখন টিভির সামনে নেই। স্কোর শুনে উইম্বলডন থেকে ফোনে চিৎকার করলেন, “দারুণ করেছে ইশান্ত। তা হলে তো আমরা টেস্ট ম্যাচ জিতছি।”
লাঞ্চে ইশান্ত খেলেন জীবনের সবচেয়ে বিহ্বল করা বোলিং হিসেব নিয়ে। ১১-৫-১৩-৪। আর সেই বিহ্বলতাকে আবার নতুন রং দিলেন ধোনি। লাঞ্চের পর বোলিং শুরু করালেন রায়নাকে দিয়ে। উল্টো দিকে প্রবীণ কুমার। ইশান্তইশান্তের কী হল? না, তিনি দিব্যি আউটফিল্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ধারাভাষ্যে তখন বয়কট-গাওস্কর সমবেত ভাবে বলছেন, “ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন এটা করছেটা কী। ইশান্তকে দিচ্ছে না কেন?” ইশান্তকে আনা হল আধ ঘণ্টারও দেরিতে। ম্যাট প্রায়র এবং মর্গ্যান তখন সেট হয়ে গিয়েছেন। কোথায় টেস্ট হারবে তা নয়। ইংল্যান্ড শেষ দুটো পার্টনারশিপে দূরে চলে যাওয়া টেস্ট ম্যাচ আয়ত্তে নিয়ে নিল। ইশান্ত রাতে জানালেন, তিনি নিজেই ক্যাপ্টেনের কাছে একটু রেস্ট চেয়েছিলেন। কিন্তু কথা হল, ক্যাপ্টেন সেই অনুরোধ রাখবেন কেন? কেন তিনি ছন্দ চলে যেতে দেবেন? প্রায়রের সেঞ্চুরি এবং ব্রডের ধুন্ধুমারের মধ্যে যেটা উত্তরবিহীন থেকে গেল, তা হচ্ছে ধোনির অধিনায়কত্ব। ইশান্তকে দেরিতে আনাই শুধু নয়। যাঁর মাথার ওপর স্লো ওভার রেটের জন্য সাসপেন্ড হওয়ার খাঁড়া ঝুলছে তাঁর টিম বল করার সময় এত গয়ংগচ্ছ হবে কেন? রায়নার মতো স্পিনারদের ওভারপিছু ৫ মিনিট করে নিতে দেবেন কেন তিনি? প্রথম ইনিংসে যেখানে ঘাটতি রয়েছে, যেখানে টিমে এমনিতেই এত চোট-আঘাত সেখানে এত বড় ঝুঁকি নেবেন কেন যেখানে নটিংহ্যামে তাঁর নামা বা না-নামা রঞ্জন মদুগালের অ্যাটাচিতে থাকা সই করা কাগজটা ঠিক করবে?
না, রোববার আসলে একটা বিরল দিন ছিল যেখানে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বহুখ্যাত ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল মাথাটাও সময় সময় গড়বড় করল। তাঁর বহুপ্রসিদ্ধ ভাগ্যও তাই করবে? সেটা এ বার লর্ডসের সোমবারের ওপর ছাড়া থাকল।

ছবি: এএফপি

প্রথম ইনিংস

ইংল্যান্ড: ৪৭৪-৮ ডিঃ
ভারত প্রথম ইনিংস: ২৮৬

দ্বিতীয় ইনিংস
ইংল্যান্ড (আগের দিন ৫-০)
স্ট্রস এলবিডব্লিউ হরভজন ৩২
কুক ক ধোনি বো প্রবীণ ১
ট্রট বো ইশান্ত ২২
পিটারসেন ক ধোনি বো ইশান্ত ১
বেল ক ধোনি বো ইশান্ত ০
মর্গ্যান ক গম্ভীর বো ইশান্ত ১৯
প্রায়র ন.আ. ১০৩
ব্রড ন.আ. ৭৪
অতিরিক্ত ১৭
মোট ২৬৯-৬ ডিঃ
পতন: ২৩, ৫৪, ৫৫, ৫৫, ৬২, ১০৭।
বোলিং: প্রবীণ ২০-২-৭০-১, ইশান্ত ২২-৬-৫৯-৪, হরভজন ২১-১-৬৬-১,
রায়না ৬-১-৪৩-০, ধোনি ২-০-১৬-০।

ভারত দ্বিতীয় ইনিংস
মুকুন্দ বো ব্রড ১২
দ্রাবিড় ব্যাটিং ৩৪
লক্ষ্মণ ব্যাটিং ৩২
অতিরিক্ত
মোট ৮০-১
পতন: ১৯
বোলিং: অ্যান্ডারসন ৮-০-২৬-০, ট্রেমলেট ৮-৩-২২-০, ব্রড ৬-২-১২-১,
সোয়ান ৫-০-১৯-০।
First Page Khela Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.