|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
ঐকমত্যের বিলাসিতা |
আর্থিক সংস্কারের সঙ্কল্প হইতে সরকার বিচ্যুত হয় নাই, জোটধর্মের দাবি মানিতে গিয়া সংস্কারের পথে কিছুটা ধীর গতিতে চলিতে বাধ্য হইতেছে, এইমাত্র। সওয়াল করিয়াছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। দুর্নীতির মোকাবিলায় সরকার কেন যথেষ্ট তৎপর হয় নাই এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কিছু দিন আগে জোটধর্মের যুক্তি খাড়া করিয়াছিলেন। দেখা যাইতেছে, সরকারের পক্ষে জোটধর্ম অজুহাত হিসাবে অতীব উপযোগী। অর্থমন্ত্রী বলিবেন, জোটধর্ম তাঁহার অজুহাত নয়, সত্যযুক্তি। তথ্যপ্রমাণও দিবেন। যথা, তিনি বলিয়াছেন, আশির দশকের শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকারে কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল এবং তাহার সুযোগে তিনি (বলিষ্ঠ ভাবে) বিদেশি মুদ্রা, বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের মতো বিবিধ ক্ষেত্রে আর্থিক সংস্কার আরম্ভ করিয়াছিলেন; আজ সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাই, জোট শরিকদের সম্মতি ব্যতিরেকে এখন এক পা-ও অগ্রসর হওয়া যায় না, ‘অর্থ কমিশনের সামান্যতম সুপারিশ লইয়া কিছু করিতে চাহিলেও আগে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করিতে হয়।’ জোট সরকারের সমস্যা, ঐকমত্য অর্জনের অসুবিধা, কোনওটিই মিথ্যা নহে। এই সব বাধ্যবাধকতা না থাকিলে হয়তো সত্যই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সংস্কারের পথে দ্রুততর গতিতে অগ্রসর হইতে পারিত। অর্থমন্ত্রী বা তাঁহার প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা লইয়া সন্দেহ প্রকাশ করিবার কোনও কারণ নাই। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকিলেই সংস্কার সহজ হয় কিংবা সংস্কারের জন্য ঐকমত্য আবশ্যক হয়, এমন যুক্তি পাইকারি তত্ত্ব হিসাবে মানিয়া লওয়া কঠিন। আধুনিক ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস স্মরণীয়।
প্রণববাবু আশির দশকের সূচনায় আর্থিক সংস্কারের কথা বলিয়াছেন। সত্য বটে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চরম অবস্থা হইতে ভারতীয় অর্থনীতির মুক্তি সেই সময়েই শুরু হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাসের মাপকাঠিতে সিংহাবলোকন করিলে অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বীকার করিবেন যে, সেই মুক্তি ছিল নিতান্ত সীমিত, ধীরলয়, কুণ্ঠিত। তাহার পরে, আশির দশকের মধ্যভাগে, অ-স্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ক্ষমতাসীন রাজীব গাঁধীর শাসনকালেও সংস্কারের ধারা স্তব্ধ হয় নাই, কিন্তু তাহা আংশিক বিবর্তনের তাহা চলিতেছিল। প্রকৃত পর্বান্তর ঘটিল আজি হইতে ঠিক কুড়ি বৎসর পূর্বে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের নির্দেশনায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের প্রযোজনায়। রাওয়ের ঝুলিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, সংখ্যালঘুতার অঙ্কুশ সঙ্গে লইয়াই তিনি সরকার গড়িয়াছিলেন, এবং প্রথম পর্বেই বিড়াল মারিয়াছিলেন। রাষ্ট্রবাদের বিড়াল।
তাহার জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন হয় নাই, প্রধানমন্ত্রী রাও ঐকমত্যের পরোয়াও করেন নাই। সংস্কারের পথে প্রবল বাধা আসিয়াছিল। কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, সমাজতন্ত্রের মোহে আবিষ্ট অর্থনীতিবিদ সহ বিদ্বৎসমাজের একটি বড় অংশ ‘কী সর্বনাশ, বাজার আসিয়া জনকল্যাণকে লইয়া গেল’ বলিয়া ক্ষুব্ধ আর্তনাদ করিয়াছিলেন। উদার আর্থিক নীতির সাহসী রথ থামে নাই। এই সাহসের একটি বড় কারণ ছিল অর্থনৈতিক সংকট। ভারতীয় অর্থনীতির গভীর সংকট, বিশেষত বিদেশি মুদ্রার ঘোর অনটনই সে দিন সরকারকে নাগপাশ ছিন্ন করিবার তাগিদ দিয়াছিল। মরিয়ার তাগিদ। আজ ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমস্যা বিস্তর আছে, কিন্তু তীব্র সংকট বলিয়া কিছু নাই, বরং বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের মধ্যে চিনের সহিত ভারত উন্নতশির ব্যতিক্রম হিসাবে জাগিয়া রহিয়াছে এবং রীতিমত দৌড়াইতেছে। এই সুস্থিতি আনন্দের কথা, আবার ইহাই সংস্কারের গতিতে রাশ টানিয়া রাখিতেছে। সরকারের মরিয়া হইবার কোনও প্রয়োজন নাই, তাই সরকার ধীরে চলিতেছে, অল্প অল্প সংস্কার করিয়া সন্তুষ্ট থাকিতেছে। সংকট নাই বলিয়াই অর্থমন্ত্রী ঐকমত্যের সাধনার সুযোগ পাইতেছেন। সাধনা, না বিলাসিতা? |
|
|
|
|
|