মন বদলের পালা
আঁধার পেরিয়ে আলোয় ফেরার পথে
ন্ধকার থেকে আলোয় আসার লড়াই এই মেয়েদের।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সাম্প্রতিক রিপোর্ট (২০০৯) বলছে, দেহব্যবসার জন্য মেয়ে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনায় দেশের মধ্যে শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। সামগ্রিক ভাবে এ রাজ্যে নারী পাচার, মেয়ে বিক্রি এবং দেহব্যবসা সংক্রান্ত মোট ১৬০টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ওই বছর। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির মত হল, অধিকাংশ সময়ই মামলা নথিভুক্ত হয় না নানাবিধ জটিলতায়। নইলে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা।
নিরন্তর পাচার, বিক্রি আর দেহব্যবসার এই ফাঁদ থেকে যাঁরা কোনও ভাবে বেরিয়ে এসেছেন, কী ভাবে নতুন করে জীবনের সামনাসামনি হন তাঁরা? অতীতের ভার, বিশ্বাসভঙ্গের আতঙ্ক পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা কি সম্ভব তাঁদের পক্ষে? ফতিমা, জবা বা নমিতার মতো মেয়েরা সেই লড়াইটাই চালাচ্ছেন। দিদিকে সাহায্য করার জন্য মুম্বই গিয়েছিল ফতিমা (নাম পরিবর্তিত)। জামাইবাবু তাকে মীরা রোডের নিষিদ্ধ পল্লিতে বিক্রি করে দেয়। সেখানে দু’বছর কাটার পরে পুলিশের হাতে ধরা দিল ফতিমা। তার মনে হয়েছিল, এই জীবন থেকে বেরোতে হলে পুলিশই ভরসা। কিছু দিন মুম্বইয়ের হোমে থাকার পর বাড়ির জন্য মন কেমন করল। ফতিমা কলকাতায় এল। যদিও বাড়িতে বেশিদিন টিকতে পারল না। প্রতিবেশীরা সবাই তাকে ‘খারাপ’ বলে মনে করে। ফতিমা আবার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হোমে রইল কিছু দিন। এখন ফতিমার ১৯ বছর বয়স। নিজে কাজ করে রোজগার করে। আরও দু’টি মেয়ের সঙ্গে এ শহরেই ঘরভাড়া করে থাকে।
১৫ বছরের জবা (নাম পরিবর্তিত)। এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাজু নামে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয়। ছেলেটি তাকে বিয়ে করতে চায়, কাজ জুটিয়ে দেওয়ারও আশ্বাস দেয়। শহরে সে কাজ করতে পারবে, এমনও আশ্বাস দেয়। জবা ছেলেটির সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রাজু তাকে নিয়ে যায় পুণেতে। জবা বুঝতে পারে, তাকে আনা হয়েছে দেহব্যবসার জন্য। রাজু তাকে বোঝায়, অনেকে মেয়েই এই কাজ করে। এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই। জবার রাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বছরখানেক পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। জবা এখন কলকাতারই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোমে থেকে অর্থনৈতিক এবং মানসিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তালিম নিচ্ছে।
নমিতার (নাম পরিবর্তিত) গ্রামে আসা-যাওয়া করত ‘মিস্টার গিরি’ নামে একটি লোক। সে বলেছিল, মাসিক ১৪ হাজার টাকার চাকরি দেখে দেবে। নমিতাকে নিয়ে যাওয়া হল বিহারে। ১৬ বছরের নমিতা তখন বুঝল, তাকে নিয়ে আসা হয়েছে বার-ডান্সার হওয়ার জন্য। মাস তিনেক পরে নমিতার মায়ের সঙ্গে ‘গিরি’র দেখা। ‘গিরি’ জানাল, নমিতা ‘ক্যাসেট-নাচ’ শিখছে। কিছু দিন পর থেকেই টাকা পাঠাবে। নমিতার মায়ের সন্দেহ হওয়ায় তিনি ‘গিরি’কে ধরে নিয়ে গেলেন পঞ্চায়েতে। পঞ্চায়েত প্রধানের হস্তক্ষেপে ১৫ দিন পর বাড়ি এল নমিতা। ‘গিরি’ ছ’হাজার টাকা মাত্র দিয়েছিল তাকে।
ফতিমা, জবা আর নমিতার লড়াই এখনও শেষ হয়নি। নতুন করে আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। এদের সঙ্গে অনেকটা মিলে যেতে পারে ‘বিন্দি’র মুখ। সানন্দা টিভির এই আসন্ন ধারাবাহিকে বিন্দি একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। দেহব্যবসার একটি চক্রের হাতে তাকে তুলে দেয় তার বাবা-ই। কোনও মতে সেখান থেকে পালায় বিন্দি। ঘটনাচক্রে সে আশ্রয় পায় শহরের মেয়ে রাহীর কাছে। কিন্তু বিন্দি কি পারবে সত্যিকার এক নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে? তাকে ঘিরে ধরে উদ্বেগ আর অবিশ্বাস।
নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলছিলেন, “মূলত দু’ধরনের ভাবনা কাজ করে এ ক্ষেত্রে। এক, আমি নষ্ট হয়ে গেছি। তখন নিজের শরীরকে শত্রু মনে করা, নিজেকে গোপন করে রাখার একটা প্রবণতা জন্ম নেয়। এর জন্য সমাজ অনেকটাই দায়ী। বাড়ির লোক, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন তাকে সব সময়ই মনে করিয়ে দেয়, সে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আবার এর বিপরীতে একটা ভাবনা কাজ করে যে, আমার আর হারানোর কিছু নেই। সেটা একটা বেপরোয়া মনোভাবের জন্মও দিতে পারে। এই জায়গা থেকেই ফের অন্ধকারে চলে যাওয়ার রাস্তাও তৈরি হয়।”
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বিভিন্ন হোমে মেয়েদের সঙ্গে মিশেছেন, কথা বলেছেন। তাঁর মতে, চরম ঝড় পেরিয়ে আসা এই মেয়েদের মনে সমাজের প্রতি একটা রাগ থেকে যায়। তারা কাউকে আর পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। একটা উদ্বেগ প্রবণতা থেকে যায়। আতঙ্কের স্মৃতি থেকে যায়। আবার একই সঙ্গে একটা বেপরোয়া, মরিয়া ভাবও কাজ করে।” স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির পর্যবেক্ষণও তাই বলছে। তাঁদের মতে, এই মেয়েরা বদ্ধ হোমে থাকতে চান না। তাঁরা চান স্বাধীনতা, সংসার, সম্মান।
অন্ধকার থেকে বেরনোটা লড়াইয়ের একটা ধাপমাত্র। আলোয় ফেরার প্রক্রিয়াটা দৃশ্যতই আরও দীর্ঘ ও জটিল।

তথ্যসূত্র: (বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র নাথ রায় এবং ইন্দ্রাণী সিংহ)
Previous Story First Page First Page



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.