|
|
|
|
নিখুঁত হয়েই ‘হিট’ ডিজিটাল পোস্টার |
পরমা দাশগুপ্ত |
তুলির টানে জীবন্ত উত্তম-সুচিত্রা? নাকি ঝকঝকে ডিজিটাল জিৎ-কোয়েল?
সত্যজিৎ রায়ের ছবির পোস্টার কিংবা পরবর্তীকালে আরও অনেকের ভাবনায় হাতে আঁকা টলিউডি পোস্টার হয়ে ওঠে শিল্পের মাধ্যম। বছর পনেরো আগে বাংলা ছবির প্রথম ডিজিটাল পোস্টার আসতে ক্রমে ধুয়েমুছে সাফ হাতে আঁকা পোস্টারের গোটা বাজারটাই। সিনেমার পোস্টার মানেই এখন মাউসের ক্লিকে রঙিন মনপসন্দ্ ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝকঝকে ডিজিটাল-ওয়ার্ক। ফোটো কিংবা কম্পিউটারে আঁকা নিখুঁত ছবি।
সময় কম লাগে, খরচও কম। ইচ্ছেমতো নিমেষে বদলে ফেলা যায় ডিজিটাল পোস্টারের আকার-আয়তন, থিম, ব্যাকগ্রাউন্ড, নায়ক-নায়িকার হাসি থেকে চাহনিও। হাতে আঁকা ছবির চাইতে ডিজিটাল ফোটো অনেক ঝকঝকেও লাগে। বাণিজ্যিক দিক থেকে ডিজিটাল পোস্টারেরই চাহিদা বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু শিল্পের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে কি কোথাও পিছিয়ে রয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর পোস্টার ডিজিটাল জমানায় প্রশ্নটা এসে দাঁড়িয়েছে সেখানেই।
শিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলছেন, “হাতে আঁকা পোস্টার আঁকছে মানুষ, আর ডিজিটাল পোস্টার আঁকছে যন্ত্র। দু’টো কখনও এক হয়? শিল্পীর মানসিক অবস্থাটা তুলির টানে ফুটে ওঠে বলেই হাতে আঁকায় একটা প্রাণের ছোঁয়া থাকে। হঠাৎ আঁকতে বলা হলে তুলির টানে যে অপ্রস্তুত ভাবটা থাকবে, কিংবা দক্ষ হাতে আঁকা ছবিতে যে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গী, সেটা কি আর যন্ত্রে পাওয়া যায়? ডিজিটাল পোস্টার একেবারে নিখুঁত। যেমনটা চাইছেন তেমন। মানসিক অবস্থার হেরফের তাতে কোনও প্রভাব ফেলে না। তাই প্রাণহীন লাগে।”
এখনকার টলিউডের বহু ছবির পোস্টারই যাঁর ভাবনা, সেই গৌতম বরাটও মানছেন, “হাতে আঁকার ধৈর্য, নির্ভুল আঁকার দক্ষতা, সিনেমার থিম অনুযায়ী ভেবেচিন্তে আঁকা এ সবে যে সৃষ্টিশীলতা ছিল, প্রযুক্তিনির্ভর কাজে তা নেই। তা ছাড়া, আগে সিনেমার নামের লোগো হাতে লিখে-এঁকে ডিজাইন করায় বাংলা অক্ষরের চেহারায়, থিম অনুযায়ী লেখার কায়দায় নিজস্বতা থাকত। ফলে প্রতিটা লোগোই হত আলাদা রকম। দেখে চেনা যেত, কার তৈরি। কম্পিউটারে লোগো বানাতে হাতেগোনা কিছু ফন্টই ভরসা। সেগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে যেমন লোগোগুলোর চেহারা একই ধাঁচের, তেমনই খানিকটা একঘেয়েও হয়ে পড়ে।” এই একঘেয়েমিটাই হাতে আঁকা পোস্টার ফিরিয়ে আনবে, এমনটা বিশ্বাস করতে চান সুব্রতবাবু। তাঁর কথায়, “ডিজিটাল পোস্টার হালে এসেছে। সবার এটাই ভাল লাগবে, সে তো স্বাভাবিকই। কিন্তু যন্ত্র তো মস্তিস্ক নয়। তাতে ছবি আঁকতে নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি ঘুরিয়েফিরিয়ে ব্যবহার হয়। কিন্তু এক দিন তো ঘুরিয়েফিরিয়ে সব রকম ভাবেই ব্যবহৃত হয়ে যাবে। তখন আর নতুন সৃষ্টির সুযোগ থাকবে না। সেটাই হয়তো আবার ফেরাতে পারে হাতে আঁকা পোস্টারের যুগ।”
কয়েক দশক আগেও যাঁরা সিনেমার পোস্টার বানাতেন, তাঁদের বেশির ভাগই আঁকার প্রথাগত শিক্ষা নিয়ে আসা। এখন ডিজিটাল জমানায় পোস্টার আঁকিয়েদের মধ্যে হাতেকলমে ছবি আঁকাটা তেমন রপ্ত নয় অনেকেরই। গৌতমবাবু যেমন সাফ বলছেন, “প্রযোজকেরা এখন আর হাতে আঁকা পোস্টার চান না। কেউ শখ করে নিজের ছবির পোস্টার একটু অন্য রকম করতে হাতে আঁকালেন হয়তো। কিন্তু তেমন আর ক’টাই বা হয়! কাজ না থাকলে ছবি আঁকতে পারা লোকেরা এই পেশায় আসবেন কেন?” হাতে আঁকা পোস্টারের যুগ তবে ফিরবে কী করে? গৌতমবাবুর তাই ধারণা, পুরোপুরি রং-তুলিতে নয়। চালু প্রযুক্তির ভিত্তিতেই ফিরতে পারে হাতে আঁকা পোস্টার।
ডিজিটাল পোস্টারের মতোই এখন বিশাল সিনেমার বিজ্ঞাপন মানেই ফ্লেক্স, যাতে শুধু ডিজিটাল ছবিই ব্যবহার করা যায়। আগেকার হাতে আঁকা ব্যানার হোর্ডিংয়ের বদলে ফ্লেক্সের সুবিধাটা কোথায়? পাবলিসিস্ট উত্তম বসু বলছেন, “প্রতিটা ফ্লেক্সে ডিজাইনারের তৈরি পোস্টারটাই ব্যবহার হচ্ছে, ফলে সব ফ্লেক্সে ছবি একই রকম হবে। হাতে আঁকায় হিউম্যান এররের সুযোগ থেকেই যায়। হয়তো একই শিল্পীর আঁকা দু’টো ব্যানার। গ্রাফ করে নিখুঁত ভাবে আঁকা হলেও কোথাও সূক্ষ্মতম ভুল হয়ে গেল মাপে। নায়কের চোখ বা সিনেমার নামের অক্ষর এক চুলের জন্য উনিশ-বিশ হয়ে গেল। সেখানে ডিজাইনারের ভুল না হলে ফ্লেক্সে ভুলত্রুটির কোনও সুযোগ নেই।” এখানেই ফের প্রাণের ছোঁয়ার কথা তুলছেন সুব্রতবাবু। তাঁর মতে, “ব্যানার বা হোর্ডিং আঁকাটা ঠিক চিত্রকলা না হলেও সৃষ্টিশীলতা ছিল। যাঁরা আঁকতেন, বেশির ভাগই আর্ট কলেজ পাশ করা কেউ নন। ফলে তাঁদের আঁকা আর প্রথাগত পেন্টিংয়ে বিস্তর ফারাক। কিন্তু নিজেদের মতো করে ছবি আঁকাটা রপ্ত করে, নিজস্ব পদ্ধতিতে তুলির টান ওঁরা দক্ষ হাতেই দিতেন। নায়ক-নায়িকার মুখও নিখুঁতই লাগত। উনিশ-বিশ ভুলও কিন্তু ছবিকে জীবন্ত করে।”
ব্যানার-হোর্ডিং আঁকার স্টুডিও ছিল আমানত আলিদের। বছর সাতেক হল কাজ আসা একদম বন্ধ। শ্যামবাজারের সেই স্টুডিওয় এখন ফ্লেক্স ফিটিং হয়। আমানত বলেন, “ব্যানারে ছবি আঁকার আনন্দ ছিল। এখন স্টুডিওয় দিয়ে যাওয়া ছাপানো ফ্লেক্স ফ্রেম করে ফিটিং করে দিতে হয়। ব্যস! কাজে সে আনন্দ কই?” তবে এখনকার বাজারে একটা ব্যানার হাতে আঁকতে প্রতি বর্গফুটে খরচ পড়ে প্রায় বারো টাকা। সেখানে পাঁচ-ছ’টাকা বর্গফুটে ফ্লেক্স হয়ে যায়। ফ্লেক্সেরই যে চাহিদা বাড়বে, মানছেন বৃদ্ধ আমানতও।
ফ্লেক্সকেও কি এগিয়ে দিল ভুলত্রুটির সুযোগ না থাকাটাই? উত্তমবাবু বলছেন, “এক একটা ব্যানার হাতে এঁকে রং শুকিয়ে রেডি করতে সময় লাগে পাঁচ-ছ’দিন। আগে সিনেমা রিলিজ করত খুব বেশি হলে কুড়ি-তিরিশটা হলে। এখন ছবি রিলিজই করে দেড়শোর বেশি হল-মাল্টিপ্লেক্সে। এতগুলো হলের জন্য হাতে আঁকা ব্যানার-হোর্ডিং তৈরি করতে হলে সময় কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সেখানে রাতে অর্ডার দিলে দুপুরেই হাতে পৌঁছে যাবে ফ্লেক্স। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে রং খারাপ হওয়ার ভয় নেই, পিছন থেকে আলো দিয়ে রাতেও উজ্জ্বল রাখা যায়। হাতে আঁকা ব্যানারের ফ্লেক্সই তো চাইবেই লোকে!” |
|
|
|
|
|