|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ব্যাধির জগতে ‘সম্রাট’ ধ্রুব নয় |
স্থবির দাশগুপ্ত |
দি এম্পারার অব অল ম্যালাডিজ: আ বায়োগ্রাফি অব ক্যানসার, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। ফোর্থ এস্টেট (লন্ডন), ৪৯৯.০০ |
রোগব্যাধির সমস্যাগুলো নিয়ে পণ্ডিতমহলে ঐকমত্য নেই। আধুনিক কোষবিজ্ঞানের জনক রুডলফ ভের্শো বহুকাল আগেই আমাদের জানিয়ে গেছেন যে সমস্যাগুলো নিরালম্ব না। তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্যও সমধিক। অবশ্য ঐকমত্য না-থাকার ফলে বিতর্কটা থেকেই যায়। সেটা ভাল। বিজ্ঞানের আকাশে বিচিত্র মতের বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে, অখণ্ডনীয় বাস্তবতাকে স্পর্শ করার স্পর্ধিত প্রয়াস চলতে থাকে এবং আমরা ঋদ্ধ হই। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চা অবশ্য তা নিয়ে সর্বদা আলোড়িত হয় না, বরং তাৎক্ষণিক সাফল্যের মোহই তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। মনে হয় একমাত্র নিদারুণ, সামগ্রিক ব্যর্থতাই সেই আচ্ছন্নতা কাটাতে পারে।
আমেরিকায় কর্মরত চিকিৎসক-গবেষক সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় ক্যানসারকে ব্যাধি-সম্রাট হিসেবে উল্লেখ করে গল্পচ্ছলে সেই সম্রাটের জীবনকাহিনি রচনা করেছেন। এই বিপুল শ্রমসাধ্য কাজটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাঁর রচনার প্রতিটি পাতায় সেই পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট। আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একজন চিকিৎসক এবং নিষ্ঠাবান গবেষক হিসেবে ক্যানসারগ্রস্ত মানুষজনের প্রতি তাঁর অকপট সংবেদনশীলতা। এই গ্রন্থের প্রতিটি পরিচ্ছেদ পাঠককে প্রতি মুহূর্তে সচেতন করে রাখে। কারণ, ক্যানসার গবেষণা ও চিকিৎসার যে ইতিহাস তিনি বিধৃত করেছেন, তার পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে উল্লাস ও হতাশার দ্বৈরথ আর নাটকীয় মূর্ছনা। ভাষার অনবদ্য ব্যবহারে সেই মূর্ছনা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
লেখক অবশ্য তাঁর রচনাটিকে ক্যানসার গবেষণার ইতিহাস না-বলে বরং ক্যানসারের জীবনকাহিনি বলতে চেয়েছেন। এই কাহিনিতে ক্যানসারই মূল চরিত্র, আর তাকে ঘিরে রয়েছে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, শৌখিন ও কেতাদুরস্ত সমাজসেবক, প্রচারমাধ্যম, ক্যানসারগ্রস্ত রোগী এবং প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির মতো অসংখ্য চরিত্র। এঁদের সম্মিলিত অবদানে সংঘটিত হচ্ছে ক্যানসার নিধন যজ্ঞ। আর চরিত্রগুলো যেন এই যজ্ঞকাহিনির এক-একটা নাটকীয় উপাদান। তাই, এক দিকে যেমন কর্তব্যনিষ্ঠা, পরিশ্রম আর আকুতির মায়াময় দৃষ্টান্ত থাকে, তেমনই অপর দিকে থাকে শঠতা, কপটতা, অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য, দর্প আর প্রতারণার অপকীর্তি। এক দিকে রোগীদের হাহাকার, কান্না আর আতঙ্ক; আবার অন্য দিকে তাঁদের উজ্জ্বল হাসি, সরল বিস্ময় আর রোগমুক্তির অপার আনন্দ। এ সব থাকে ক্যানসারকে ঘিরেই, অথচ সেই মূল কেন্দ্রীয় চরিত্রটি যেন তার সর্বব্যাপী কর্মসূচি আর নিয়তি-নির্দিষ্ট সংলাপ নিয়ে আজন্ম, আবহমান সাবলীল। পাঠক তাই সচকিত হয়ে থাকেন, কেননা ওই কাহিনিগুলোর মধ্যেই ধরা থাকে ক্যানসার কোষের পরিচয়, তার অদ্ভুত ব্যবহারের বর্ণনা। সেই বর্ণনা সময়ে সময়ে এতই কাব্যিক যে, আশা করা যায় গ্রন্থটি রসবেত্তার কাছে সমাদৃত হবে।
কোনও সচেতন পাঠকই অবশ্য কেবল রসে বুঁদ হয়ে থাকেন না। সচেতনতা প্রশ্নের জন্ম দেয়, সংশয়েরও। যেমন, ক্যানসারকে বলা হয়েছে ব্যাধি-সম্রাট। ব্যাধির জগতে যুগে যুগে সম্রাট, সেনাপতি আর প্রজার ভূমিকাগুলো নিরন্তর পাল্টাতে থাকে। এর পেছনে থাকে এক-একটা দেশের জনমানুষের সমস্যা, যুগের চরিত্র, রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব ইত্যাদির বিচিত্র সমীকরণ। তাই এক দেশের ব্যাধি-সম্রাটকে দুনিয়ার ওপর আরোপ করে দেওয়াটা বোধ করি সমীচীন না। আর ক্যানসারের জীবনকাহিনি কথাটাও যেন অতিকথন। কারণ, জীবনকাহিনি বলতে গেলে জন্মের কথাটা এসেই পড়ে। সে কথা স্বীকার করেও লেখক তা সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন। কোষবিজ্ঞান দেখিয়ে দেয় যে, প্রাণের প্রথম স্পন্দনের সঙ্গেই ক্যানসারের জন্ম অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। কোষীয় বাস্তবতার কথা ভাবলে ক্যানসার প্রাণেরই অপর এক রূপ, অবাঞ্ছিত কিন্তু স্বাভাবিক। লেখকও স্বীকার করেছেন যে, ক্যানসার আমাদের জিনসজ্জায় যেন ‘সেলাই করে রাখা আছে।’ কিন্তু এর তাৎপর্য যে কী, তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি।
তা যদি পারতেন, তা হলে মাত্র খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে জীবনকাহিনি শুরু করতেন না। তিনি প্রামাণ্য নথির কথা তুলেছেন। সত্যিই তথ্যনিষ্ঠ হলে তিনি কিন্তু মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতার কথা বলতে পারতেন (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০)। প্রমাণ তো সেখানেও ছিল। এর পর এক বিরাট উল্লম্ফনে তিনি সটান চলে এসেছেন পারসিক রানি অ্যাটোসার স্তন ক্যানসারের রোমাঞ্চকর কাহিনিতে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০। অথচ, রানির রোগটি যে আদৌ ক্যানসার ছিল না, তা ১৯৫৯-এ সুবিখ্যাত ‘মেডিক্যাল হিস্টরি’ পত্রিকায় প্রকাশিত এ টি স্যান্ডিসন-এর লেখাতেই পাওয়া যায়। এহ বাহ্য। ব্যাধি হিসেবে ক্যানসারের নামকরণ নাকি ঘটেছিল হিপোক্রাতেস-এর হাতেই (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০) ‘কার্কিনস’। অর্থাৎ, এই গ্রন্থ পড়ে আমরা জানলাম যে, চরক বা সুশ্রুত (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০) নামে কেউ কখনও ক্যানসারের চিকিৎসা করেননি, আর ‘কর্কট’ নামে কোনও ব্যাধিও কোনও কালে ছিলই না। তা হলে তো কলম্বাস-এর আগে আমেরিকাও ছিল না!
মনে হয় ক্যানসারের জীবনী নিয়ে তিনি যতখানি চিন্তিত, তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বেলিত ও চমৎকৃত হয়ে আছেন ‘ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র দামামা শুনে। জীবাণু সংক্রমণের সঙ্গে ক্যানসারকে গুলিয়ে ফেলা আধুনিক ক্যানসার প্রতিষ্ঠানের আদরণীয় ভ্রান্তি। না-চাইতেও লেখক সেই ভ্রান্তির কবলে পড়েছেন। অথচ রবার্ট এন প্রক্টর লিখিত ক্যানসারের বিরুদ্ধে নাতসি যুদ্ধের ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালে। তা গৌরবের ইতিহাস না। সে দিকে যে তাঁর নজরই পড়ল না, তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত কি না বলা মুশকিল। ক্যানসার নিয়ে শত শত বিজ্ঞানীর সাধনা মিথ্যে না; তা নির্মম সত্য। কিন্তু ক্যানসারের জীবনী রচনায় আরেকটু যত্নবান হলে লেখক হয়তো বুঝতেন যে, যুদ্ধের প্ররোচনা দেওয়া বিজ্ঞানের কাজ না। বরং বিজ্ঞানের কাজ হল, যুদ্ধ এড়িয়ে কী ভাবে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব, তারই সন্ধান দেওয়া। অথচ তারুণ্যের উচ্ছলতা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বাস লেখককে এমন অস্থির করে তোলে যে তিনি বার-বার যুদ্ধের জন্যই আবেদন করেন। অবশ্য একটু পেলব, মধুর স্বরে। এ তো আধুনিক প্রচার-কুশলতারই অঙ্গ।
তাই ক্যানসার যে ‘নির্মূল’ করা সম্ভব না, তা তিনি স্বীকার করেন। অথচ পরক্ষণেই ভাবেন, ‘ম্যাজিক বুলেট’ বুঝি যুদ্ধটাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। বৌদ্ধিক বিচারে তা যে ম্যাজিকও না, বুলেটও না, সে কথা ভাবতেও তাঁর দ্বিধা। প্রচুর ব্যয়ে অধিকাংশ ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি-র অবদান যে সামান্যই, তা তিনি জানেন। অথচ, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিই হয়তো তাঁকে তাতে আস্থাবান করে রাখে। আমাদের মহৎ বাসনাগুলোর সঙ্গে যে কোষীয় বাস্তবতার কোনও সম্পর্ক নেই, সে কথা অনুচ্চারিতই থেকে যায়। তার বদলে তিনি পরিসংখ্যানের ছলনায় মুগ্ধ ‘আগে-ভাগে’ ক্যানসার নির্ণয়ের অভিলাষে রোমাঞ্চিত। ধূম্রপানের বিরুদ্ধে পবিত্র ধর্মযুদ্ধের কথা বলেন, অথচ ডিজেল নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেন না। ওদিকে যুগের পর যুগ ধরে জাপানে ধূম্রপানের হার কমেছে, অথচ ফুসফুস-ক্যানসারের হার বেড়েছে। এ-ও তো পরিসংখ্যানই। তাঁর যুদ্ধপরায়ণতা সহজবোধ্য, কিন্তু তা ক্যানসারের আধুনিক কোষবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর প্রাজ্ঞতা প্রমাণ করে না। ক্যানসার সত্ত্বেও কী ভাবে জীবন আরও সহনীয় হতে পারে, সে আলোচনা অধরাই থেকে যায়।
এই গ্রন্থ পড়তে পড়তে মনে হতে পারে, যেন একটা নির্দিষ্ট, কূপমণ্ডূক, পৌরুষপ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি লেখককে মোহমুগ্ধ করে রেখেছে। নইলে চিকিৎসা গবেষণায় প্রতারণার দৃষ্টান্ত খুঁজতে তাঁর কলম ‘লঙ্কা’য় (দক্ষিণ আফ্রিকা) যেতে পারে, অথচ খোদ ‘অযোধ্যা’য় (নিউ ইয়র্ক) যে তার শুরু, সে কথা বলাই হয় না। জোসেফ হিক্সন-এর লেখা প্যাচওয়ার্ক মাউজ নামক গ্রন্থে ১৯৭৬ সালেই তার দৃষ্টান্ত বিবৃত হয়েছিল। এই ধরনের আচরণগত সঙ্কীর্ণতা ইতিহাস লেখনের উপযুক্ত কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। আর ধারণাগত সঙ্কীর্ণতার প্রমাণ তিনি পরিশেষে নিজেই দিয়ে রেখেছেন, ‘ক্যানসার-যুদ্ধে আমরাই বিজয়ী হচ্ছি, শুধু জয়ের সংজ্ঞাটা একটু বদলে দিতে হবে।’ বৃত্তকে চতুষ্কোণে পরিণত করার উন্নততর স্পৃহায় আমরা তো আমাদের ধারণা যে-ভাবে খুশি বদলাতে পারি। তাতে ক্যানসারের জীবনীটা বদলাবে কি না তা বলা দুষ্কর।
এ সব সত্ত্বেও, ক্যানসারের মতো দুরবগাহ বিষয়টিকে সর্বজনগ্রাহ্য করার দুর্লভ প্রচেষ্টার জন্য পাঠক তাঁকে মনে রাখবেন। একই সঙ্গে কামনা করবেন তাঁর নির্মোহ বিজ্ঞানসাধনা। |
|
|
|
|
|