|
|
|
|
|
|
প্রতি পক্ষ
শুধুই গ্রন্থাগার
|
...ভুলেই থাকা |
অনুপ চট্টোপাধ্যায় |
জন্মদিনে ‘বন্দে মাতরম্’ এর স্রষ্টার প্রতিকৃতিতে একটা মালাও পড়ল না।
তা-ও আবার কোথায় জানেন?
তাঁর নিজের বাড়িতেই। মধ্য কলকাতার ৫ প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনে। জীবনের শেষ সাতটা বছর নিজের পয়সায় কেনা ওই বাড়িতেই বাস করতেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উপন্যাস ও নানা প্রবন্ধও লিখেছেন ওই বাড়িতে। প্রিয় ওই বাড়িটিতেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। সেই বাড়ি ভেঙে সেখানে গড়ে উঠেছে নতুন ভবন। রাজ্য সরকার সেখানে একটা গ্রন্থাগার চালু করেছে। আছে গ্রন্থাগার পরিচালন কমিটিও। তাঁদের নাকি ‘মনেও নেই’ লেখকের জন্মের দিনক্ষণ। তাই মালা পড়েনি। এমনই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
ষাটের দশকে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িটি অধিগ্রহণ করে রাজ্য সরকার। তার পরে দীর্ঘকাল অনাদরে অবহেলায় পড়ে থেকে ভগ্নদশা হয় বাড়িটির। বঙ্কিম অনুরাগীদের দাবি ছিল, পুরনো বাড়িটির আদলে নতুন করে গড়ে উঠুক ভবন। হোক গবেষণাগার। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠুক জায়গাটি। কিন্তু হয়নি।
|
|
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৪ সালের পরে সাংসদ ও বিধায়ক তহবিলের টাকায় পুরনো বাড়িটি ভেঙে একটা দোতলা বাড়ি বানানো হয়েছে।
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভবনটির উদ্বোধন করেন। কিন্তু বঙ্কিম অনুরাগীদের দাবি মতো গবেষণাগার বা চর্চাকেন্দ্র গড়ে তোলায় সরকার উদ্যোগী হয়নি। কেবল তালতলা থেকে একটি গ্রন্থাগারকে বাড়িটিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগার’। কলেজ স্ট্রিটে মেডিক্যাল কলেজের উল্টো দিকে একটা সরু গলি প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের শেষে লেখকের বাড়ি। ঢোকার মুখেই বাঁ দিকে একটি ফলক। ইংরেজ আমলে তৈরি। সেখানে ইংরেজি হরফে লেখা রয়েছে, ‘হিয়ার লিভ্ড...’। কিন্তু ভেতরে গেলেই বোঝা যাবে মাত্র কয়েক বছর আগে গড়ে ওঠা বাড়িটির হাল কেমন। নীচের তলায় গ্রন্থাগার। ভিতরের দিকে একটা টেবিলের উপরে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিকৃতি। এক পাশে ফুলদানিতে ময়লা জমা গোটা কয়েক প্লাস্টিকের ফুল। কয়েকটি আলমারিতে কিছু বই। তবে বই পড়ার লোক দেখা যায়নি। লেখকের প্রতিকৃতির পিছনের দিকে একটি ঘরে গিয়ে দেখা গেল ফেটেফুটে গিয়েছে দেওয়াল। দোতলার অবস্থা আরও খারাপ। বেশ বড় মাপের টাইলসের মেঝেটা ধুলোয় ভর্তি। পা রাখার জো নেই। দোতলার ঘরটির হাল তো আরও খারাপ। পুরো দেওয়াল জুড়ে গাছের শিকড় গজিয়েছে। ফাটল ধরেছে ঘরগুলিতে। |
|
লেখকের পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন করে গড়ার সময় বঙ্কিম অনুরাগীদের দাবি ছিল আগের বাড়ির আদলে তা গড়ে উঠুক। স্থানীয় এক বাসিন্দা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম এখানে বঙ্কিম গবেষণাগার হবে। স্মৃতি সংগ্রহশালা হবে। লেখকের নথিপত্র রাখা হবে। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে এই জায়গাটা একটা আকর্ষণীয় কেন্দ্র হয়ে উঠবে।” কার্যত তার কোনওটাই হয়নি।
কিন্তু কেন হয়নি?
ওই পাড়ারই বাসিন্দা ভাস্কর সিংহের কথায়, “উদ্যোগের অভাব। বাড়িটি গড়ে তোলার সময়কার উদ্যোগে পরে ঢিলেমি হয়েছে।” তিনি বলেন, “এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক প্রয়াত লক্ষ্মীকান্ত দে এই বাড়িটি গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। সাংসদ ও বিধায়ক তহবিল থেকে প্রায় ৪০ লাখ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সেই টাকাতে বাড়ি তৈরি হলেও তা রক্ষণাবেক্ষণে চরম গাফিলতি চলছে।” স্থানীয় এক অধ্যাপকের বক্তব্য, “এই এলাকার আশপাশেই রাজ্যের নামী কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বঙ্কিম চর্চাকেন্দ্র হিসেবে কোনও একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করতে পারত শিক্ষা দফতর। তা না করে শুধু একটা গ্রন্থাগার করে ফেলে রাখা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্থানটি।” |
|
২৬ জুন ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিন। ওই দিনটিতে তাঁর প্রতিকৃতিতে ফুল-মালা না পড়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় মানুষজন। প্রবীণ বাসিন্দা বৈদ্যনাথ সাহার প্রশ্ন, “গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য একটি কমিটি হয়েছে। তাঁরা কী করছিলেন? যাঁর নামে ওই গ্রন্থাগার সেই মহান ব্যক্তির জন্মদিনটাই তাঁরা ভুলে গেলেন?” গ্রন্থাগার
কমিটির এক সদস্য প্রবীর বসুর বক্তব্য, “এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল।”
জায়গাটি কলকাতা পুরসভার ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয় কাউন্সিলর তৃণমূলের পার্থ ঘোষের বক্তব্য, “গ্রন্থাগার কমিটিতে অযোগ্য লোককে ঢুকিয়েছে স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে তাঁদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তাই এই হাল।” এ বিষয়ে এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক সিপিআইএম নেতা অনাদি সাহুর বক্তব্য, “ওটা একটা সরকারি গ্রন্থাগার। সরকারি পদ্ধতি মেনেই কমিটি হয়েছে। যদি অন্যথা হয়ে থাকে তা হলে সরকার কমিটি ভেঙে দিচ্ছেন না কেন?” তাঁর বক্তব্য, “রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটি নষ্ট হচ্ছে ঠিকই। আমি মন্ত্রী থাকাকালীন বাড়িটা দেখভালের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভাগীয় মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলাম। সরকার বদলের কারণে তা হয়ে ওঠেনি।” অনাদিবাবু বলেন, “ওঁদের তো জ্ঞানীগুণী লোকের অভাব নেই। এ বার দেখব বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িটি যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছে কি না।” |
ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ |
|
|
|
|
|