মোড় ঘুরতেই দূরে দেখা গেল একখণ্ড নীল। ওটাই কি প্যাংগং? এক পলকে উড়ে চলে যাওয়া যায় কি ওখানে? নাহ্! অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুক্ষণ। অগত্যা গাড়ি চলতে থাকে। পাহাড়ি পথে ঘুরতে ঘুরতে ওঠা আর সেই সঙ্গে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। অবশেষে যখন পৌঁছনো গেল, তখন গাড়ি থেকে নামতে আর তর সইছে না। এক ছুট্টে সেই নিঃসীম নীলের একেবারে কাছে চলে যাওয়া। প্যাংগং লেক! জলের রং এমন নীলও হতে পারে? বিশ্বাস হয় না নিজের চোখকেও। নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে সেই দিগন্তবিস্তৃত নীলের মাঝে।
আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের আঁকিবুকি। তার সঙ্গে লেকের জলও রং বদলায়। চার দিক ঘিরে থাকা রুক্ষ সুন্দর পাহাড়ের সারি ছায়া ফেলে জলে। সেই পাহাড়ের যে কত বিচিত্র রং! হলদে-কমলা-খয়েরি। ইতিউতি উড়ে বেড়াচ্ছে শীতের দেশের হাঁস। তাদের ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই কোথাও। মানুষজনও নেই। নেই কোনও দোকানপাট। একেবারে নির্জন চার পাশ। একমাত্র সঙ্গী ড্রাইভার শিরিনজি তখন ব্যস্ত দূরের চিন সীমান্ত চেনাতে। লেকের ধারে পা ছড়িয়ে বসে জলে হাত ছোঁয়াতেই বেশ একটা কনকনে অনুভূতি। এমনিতে যদিও খুব একটা হাড় কাঁপানো শীত নেই। আসলে মাসটা তো জুন! তাই সুন্দর
ফুরফুরে আবহাওয়া।
|
লাদাখ ভ্রমণের তৃতীয় দিন এটা। বহু আকাঙ্ক্ষিত লাদাখ! দিল্লি থেকে লেহ্ যাওয়ার উড়োজাহাজটা যখন হিমালয়ের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, তখনই জানলায় এসে ধাক্কা মারছিল সাদা মেঘগুলো। হঠাৎ মনে হল, আরে! হিমালয় আমার পায়ের তলায়। জানলায় কপাল চেপে যতটুকু দেখা গেল, তাতেই চোখে বিস্ময়! নীচে পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন খেলনা। অথবা ছোট্ট ছেলের রং-পেন্সিলে আঁকা ছবি। জেলাশহর লেহ্-র ছোট্ট বিমানবন্দর। নাম কুশোক বকুলা রিনপোচি। মূল শহর থেকে একটু দূরে। হোটেলে পৌঁছতেই তিব্বতি প্রথায় গলায় ‘খাদা’ অর্থাৎ সাদা উত্তরীয় পরিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা। বুঝলাম, পৌঁছে গিয়েছি উপত্যকা আর মনাস্ট্রির দেশে। শান্তি স্তূপ, শে, থিকসে, হেমিস, আলচি, দিসকিত, স্পিতুক, লিকির। লাদাখ সত্যিই মনাস্ট্রির দেশ। কোথাও রয়েছে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু বুদ্ধের মূর্তি। আবার কোথাও জাতকের ইতিবৃত্ত। হেমিস, শে কিংবা থিকসেপ্রত্যেকটা মনাস্ট্রিই স্বতন্ত্র। মনাস্ট্রিবিশেষে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির প্রকারভেদ রয়েছে। বাইরে দু’ধারে সারি সারি ‘প্রেয়ার হুইল’। অশুভ শক্তিকে তাড়াতে পতপত করে উড়ছে মন্ত্র লেখা রংবেরঙের নিশান। নির্জন দুপুরে দমকা হাওয়ায় ‘প্রেয়ার হুইল’গুলো নিজে থেকেই ঘোরে শব্দ করে। তা ছাড়া চারিদিক অদ্ভুত নিস্তব্ধ। আর আছেন পনেরো থেকে পঁচানব্বই বছর বয়সের হাসিমুখ বৌদ্ধ লামারা। এই সুযোগে দেখে নেওয়া যায় তাঁদের সহজ-সরল জীবনযাত্রা। মনে রাখার মতো লেহ্-র প্রাসাদ, স্তোক প্যালেস, কার্গিলের সৈনিকদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মিউজিয়াম ‘হল অফ ফেম’ এবং গুরুদ্বার ‘শ্রী পত্থর সাহিব’। আর আছে ‘ম্যাগনেটিক হিল’ যেখানে নিউট্রাল গিয়ারেও গাড়ি এগিয়ে চলে দিব্যি। |
কোনও কোনও গুম্ফা বা মনাস্ট্রিতে পৌঁছনো সত্যিই বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ পাহাড়ের উঁচু ধাপে বানানো গুম্ফাগুলোয় পৌঁছতে হয় পায়ে হেঁটে। সমতলের মানুষদের অতগুলো সিঁড়ি ভাঙতে দম ফুরোবে বই কী! বেশ কয়েকটা মনাস্ট্রি ঘুরে এসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া সিন্ধু নদের পাড়ে বসে। সেই ক্লাস ফাইভের ইতিহাস বইয়ের সিন্ধু নদ। ভাবলেই কাঁটা দেয় গায়ে। আর আছে জ্যঁস্কর নদী। দুই নদীর সংযোগস্থলে এসে চোখ জুড়োয়। সবজে নীল আর ধূসর রঙের মিশেলে ঠিক যেন তেলরঙে আঁকা ছবি।
প্যাংগং-এর কথা তো আগেই হয়েছে। এ বার লাদাখ ভ্রমণের সর্বশেষ গন্তব্য নুবরা। পথে পড়ল ‘খারদুং লা’। গাড়ি চলাচলের উপযোগী সর্বোচ্চ পথ। ১৮৩৮০ ফুট উঁচু। গাড়ি ছুটল আবার পাহাড়ি পথ ধরে। পথের দু’ধারে শুধু বরফ আর বরফ। বরফ কেটে কেটে রাস্তা সাফ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পথ বেশ দুর্গম। অন্তহীন চড়াই-উতরাই। ঠান্ডাও ভালই। কে বলবে এটা জুন মাস? এর আগে প্যাঙ্গং যেতে পথে পেয়েছি ‘চাং লা’। গাড়ির মধ্যে বাইরের ঠান্ডাটা বোঝা যায় না। কিন্তু রাস্তায় নামতেই হাড় পর্যন্ত হিম। কাছাকাছি শুধু দু’চারটে মিলিটারি ক্যাম্প। অশেষ কষ্ট সহ্য করে এই ঠান্ডায় জওয়ানরা এখানেই রয়েছেন দিনের পর দিন। তাঁদের এক জনের মুখেই জানা গেল, তাপমাত্রা মাইনাস ৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। আগের রাতে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তার খানাখন্দে জমে থাকা জলও জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কলকাতার প্যাচপেচে গরমের কথা অনেক চেষ্টাতেও কল্পনা করা যায় না। ‘খারদুং লা’ পেরিয়ে বহু ক্ষণ ধরে চলেছি তো চলেইছি। মাঝে মাঝে বদলে যাচ্ছে দু’পাশের পাহাড়ের চেহারাটা। এই দেখলাম বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া। বরফের চাঁই নেমে এসেছে রাস্তাতেও। আবার তার পরেই কিছুটা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শুকনো-রুক্ষ পাথুরে পাহাড়। এই বৈচিত্র্যের জন্যই লাদাখ অনন্য। নুবরা যাওয়ার পথে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে পড়ল বালিয়াড়ি (স্যান্ড-ডিউন্স)। সেখানে আবার রয়েছে জোড়া কুঁজওয়ালা উট। আকারে কিছুটা ছোট। উচ্চতাতেও। সওয়ার হওয়া গেল তার পিঠেও। নুবরা ভ্যালি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় শেষ-বিকেল। এ বার অপেক্ষা করছে তাঁবু-বাড়িতে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা। আখরোট আর কপিখেতের মাঝে ছোট ছোট সবুজ তাঁবু। চার দিকে পর্বতশ্রেণীর অতন্দ্র প্রহরা। খুবই অতিথিবৎসল তাঁবুমালিক। জানালেন, তাঁর স্ত্রী নিজের হাতেই সব্জি ফলান খেতে। নৈশভোজে তাই মিলল সুস্বাদু তিব্বতি শাক আর অতি উপাদেয় স্যুপ।
সফর শেষ। আবার লেহ্ শহর। ফেরার আগে হাতে আর মাত্র একটা দিন। তাই একটু ঘুরে নেওয়া কাছেপিঠের বাজার। ছোট-বড় দোকানে বা রাস্তার ধারেই শীতপোশাক, গয়না আর শুকনো ফল যেমন- আখরোট, কাঠবাদাম, খেজুরের পসরা সাজিয়ে বসেছে পাহাড়ি মেয়েরা। বাড়ির অন্যান্যদের জন্যও তো নিয়ে যেতে হবে লাদাখ-ভ্রমণের টুকরো স্মৃতি। তাই টুকটাক কেনাকাটা সেরে ফের ব্যাগ গুছোনো। সুটকেস বোঝাই, সেই সঙ্গে মনও। এ বার কলকাতায় ফেরার পালা।
|