রাজকুমারীর মুখে হাসি নেই
রাজামশাই বললেন, ‘মন্ত্রী, এ কেমন কথা। কেউ হাসে না আজকাল। হাসলেও চেয়েচিন্তে হিসেব কষে মেপেজুপে হাসে। ভারী অন্যায়। আজ থেকে হুকুমজার, হাসতে হবে সক্কলকে। সে হাসি পাক, আর না পাক। নজরদারির দায়িত্ব তোমার।’
মন্ত্রীমশাই ফাঁপরে পড়লেন। কিন্তু রাজামশাইয়ের সামনে তো আর বিরক্তি প্রকাশ করলে চলে না। সুতরাং নকল দাঁতের পাটি অর্ধেক বের করে কাষ্ঠ হেসে বললেন, ‘হাসবে কী, দুনিয়ার যা অবস্থা, হেসে গড়িয়ে পড়ার খোরাকটাই যে এখন অমিল ভারী!’
রাজামশাই তার জোড়া ভুরু নাচিয়ে বললেন, ‘হাসির খোরাক নেই! তাই মনে হয় আপনার? নিজেকেই দেখুন না, গাল বসে গিয়েছে। মাথার চুল অধিকাংশ ঝরে গিয়েছে। তবুও যে ক’টি আছে সেগুলি রং করে জোয়ান সেজেছেন। এমন উদ্ভট দৃশ্য হাসির খোরাক নয় বুঝি? আমার তো দেখলেই হাসি পায়। আগে সামলে ছিলুম। আজ থেকে আর নয়।’
বলেই রাজামশাই ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগলেন। মন্ত্রীমশাই কী করেন, ঢ্যাড়া পিটিয়ে দিলেন। রাজ্যে হাসির ধুম পড়ল। কারণে-অকারণে হাসতে শুরু করল লোকে।
রাজামশাই খুব খুশি। রাজ্যে গোমড়ামুখো কেউ নেই আর। সবার মুখে লেগে আছে হাসি। হাসতে হাসতেই সব কাজ হাসিল হচ্ছে তাঁর রাজ্যে।
এরই মধ্যে এক দিন রাজসভায় গোয়েন্দা এসে রাজামশাইয়ের কানে কানে কী বলল। রাজামশাই হেসে হেসে শুনলেন বটে, কিন্তু মুখে তার চিন্তার মেঘ। তিনি সভা ভঙ্গ করে অন্তঃপুরে ফিরে গেলেন। সত্যি তো। রাজকুমারীর দিকে নজরই পড়েনি তাঁর। মোটে ন’বছর বয়স তার। কিন্তু ভাবভঙ্গিতে যেন নব্বই বছরের ঠানদিদি। কান উপচে পড়া হাসি তো দূরের কথা, ঠোঁট বেঁকিয়ে একপেশে মিচকি হাসিও হাসে না সে। ঘোর সংকট। কথাটা পাঁচ কান হলে ভারী লজ্জা। রাজামশাই ডাকলেন মহারানিকে।
‘কী ব্যাপার রানি, রাজকুমারী হাসে না কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন রাজামশাই।
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মহারানি মুখে পঞ্চসব্জির একটি ‘প্যাক’ লাগাচ্ছিলেন। রাজামশাইয়ের হঠাৎ তলবে ছুটেই এসেছেন প্রায়। কারণ জেনে বিরক্ত হলেন তিনি। বললেন, ‘মেয়ে যে হেসে বেড়াবে এমন সময় কোথায় তার’!
‘মানে?’ বুঝলেন না রাজামশাই, ‘কী এমন রাজকার্য করে সে? ভোরে উঠেই তো হেসে নিতে পারে একচোট।’
‘ভোরে উঠেই জগিংয়ে যেতে হয় তাকে। তার পর জুডোর ক্লাস। দিনের শুরু থেকেই ভয়ানক ব্যস্ত সে। হাসির ফুরসত নেই।’ বললেন মহারানি।
রাজামশাই অবাক হলেন, ‘ঠিক আছে। শরীরচর্চা তো করতেই হবে। কিন্তু তার পর?’
‘তার পর? তার পর ইস্কুল। ইস্কুলের পর সাঁতার। তার পর আঁকার ক্লাস। আঁকা না থাকলে গানের ক্লাস। যে-দিন গান না থাকে, সে দিন নাচ। দুটোই না থাকলে গিটার, নয়তো জুডো। কিংবা অ্যাবাকাস। সময় কোথায় ওর। বাড়ি ফিরতে আসে টিউটর।’
রাজামশাই বিরক্ত হলেন। আশ্চর্য! যুগ যা পড়েছে এ সব মামুলি বিষয় না শিখলে কি চলে! এতে মুখের হাসি আটকে যাওয়ার কী আছে! এগুলির সঙ্গে হাসির বিরোধটাই বা কোথায়!
গৃহশিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন রাজামশাই। হাসির গল্পের অডিয়ো সিডি কেনা হল গুচ্ছের। রাজকুমারীর গল্পের বই পড়তে রুচি নেই। তাই অডিয়ো সিডি। রাজামশাই নিজে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে এক হাজারটি দমফাটা হাসির জোক ডাউনলোড করলেন। কিন্তু সব বৃথা। সব পণ্ডশ্রম।
রাজকুমারী সব দেখল। শুনল। পড়ল। কিন্তু হাসল না। শেষে ‘ইউনিট টেস্ট আছে’ বলে উঠেই গেল গম্ভীর মুখে।
ইতিমধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ল বাইরে। অকারণে হেসে ক্লান্ত সবাই। এক জন দু’জন করে হাসা বন্ধ করতে শুরু করল প্রজারা। রাজামশাই নিজেও এখন মাঝে মাঝে হাসতে ভুলে যান।
এমন সময় এক দিন রাজকুমারীর ঠাকুমা স্বয়ং রাজমাতা এসে হাজির। নগর থেকে দূরে গ্রামে থাকেন তিনি। নগরের এত কোলাহল ভাল লাগে না তাঁর। মন যখন আকুল হয়, চলে আসেন নাতনির কাছে।
রাজমাতা সব দেখেশুনে বললেন, ‘আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে। গরমের ছুটিটা ও আমার কাছেই থাকবে।’
পাহাড়-নদী-ঝর্না দিয়ে ঘেরা সুন্দর গ্রাম রাজমাতার। কত রকমের পাখি। প্রজাপতি। মুগ্ধ হয়ে গেল রাজকুমারী। কত দিন পর সে এল। পড়াশোনার চাপে আসতেই পারে না সে।
রাজামশাই কেক-বিস্কিট, প্যাটিস-কোল্ডড্রিঙ্ক সব পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সঙ্গে। রাজমাতা সব ফিরিয়ে দিলেন। তার পর নিজে হাতে চালেডালে রাঁধলেন খিচুড়ি। সঙ্গে কুমড়ো ফুলের মুচমুচে বড়া আর আমের চাটনি।
রাজকুমারীর খাওয়া নিয়ে ভারী সমস্যা। খেতে বড় অনীহা তার। পাটকাঠির মতো চেহারা। এখন কাঠের আগুনে মাটির হাঁড়িতে করা রাজমাতার রান্না খাবার জিভে দিয়ে তো অবাক। আহা, কী অপূর্ব স্বাদ! অনেক দিন পর পেটভরে মনের সুখে খেল সে। তার পর ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে জম্পেশ একটি ঘুম।
কয়েক দিনের মধ্যে চেহারাই ফিরে গেল রাজকুমারীর। পাকা গমের মতো হল গায়ের রং। যে দেখে সে-ই বলে, এই না হল রাজার মেয়ে, রাজকুমারী!
খালি চেহারার পরিবর্তন নয়, রাজকুমারী জেনেও ফেলল কত কী! কামারশালায় গিয়ে দেখল কেমন করে লোহা পিটোনো হয়, হাপর চলে কেমন করে। তাঁতিপাড়ায় গিয়ে দেখল তাঁত বোনার কায়দা। সবচেয়ে মজা হল কুমোরের চাকা দেখে। কী আশ্চর্য ভাবে কুমোরকাকা মাটির সরা হাঁড়িখুড়ি সব বানিয়ে ফেলছে। রাজকুমারী নিজেও চেষ্টা করে দেখতে গিয়ে কাদায় মাখামাখি। সকলে হা হা করে উঠল, আর রাজকুমারী হেসে কুটিপাটি। তাই দেখে রাজমাতাও হেসে উঠলেন ফোকলা দাঁতে। এত দিন পর মনটা হাল্কা হল তাঁর, কে বলে নাতনি তার হাসে না!
এমনি করে দিন কেটে গেল। রাজকুমারীর ইস্কুল খোলার সময় হয়েছে। রাজামশাই গাড়ি চেপে এলেন তাকে নিয়ে যেতে। সে-দিন খুব বৃষ্টি। এঁটেল মাটির রাস্তায় গাড়ি চলে না। রাজমাতার বাড়ির দাওয়ার সামনে কিছুতেই পৌঁছনো যাচ্ছে না। কাদার মধ্যে গাড়ির চাকা ঘুরে যাচ্ছে এমনি-এমনি।
রাজামশাই মুশকিলে পড়েছেন। পরনে মসলিনি ধুতি আর আদ্দির ফিনফিনে পাঞ্জাবি। পায়ে শুঁড়তোলা খানদানি নাগরা। এ সব পরে কি আর প্যাচপেচে কাদার মধ্যে নামা যায়? দেহরক্ষী দু’জনকে বললেন নেমে গিয়ে গাড়ি ঠেলতে। তারা নামল বটে। তবে ঠেলতে গিয়ে নিজেরাই পপাত ধরণীতলে। সেই মুহূর্তে ‘কী মজা, কী মজা’ বলে হাততালি দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল রাজকুমারী। রাজামশাইয়ের চক্ষুচড়কগাছ! কী অবাক কাণ্ড! মেয়ে হাসছে তার। জুঁইফুলের মতো সুন্দর দাঁতগুলি বের করে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে সে। আহা, কী সোনাবরণ সতেজ চেহারা হয়েছে তার।
রাজমাতা বললেন, ‘অবাক হসনি। হাসি তো ওর মনে ছিলই। কিন্তু নিয়মনীতির বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছিল এত দিন। এমন হাঁসফাঁস অবস্থা।
Magazine Rabibasariyo Anandamela


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.