পুরুলিয়া রেল স্টেশন থেকে দূরত্ব মাত্র ৪৬ কিলোমিটার। বহুল পুরনো আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি নিমড়ি স্টেশন হয়ে চান্ডিল ছুঁয়ে চলে যায় টাটানগর।
স্বাধীনতার পরে দেশ ও রাজ্যের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় এটা কেউই ভেবে দেখেননি ওই স্থানের ভাষার, জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও কথ্য ভাষা, শিক্ষার ভাষার কী হাল হবে! দেশ ও রাজ্যের ভাষাভিত্তিক সীমারেখা টানতে গিয়ে আম আদমির কপাল পোড়ে। পোড়ে ভাষা ও সংস্কৃতি। এমনকী বাংলা ভাষার মর্যাদা দানে শহিদরা, বিশেষত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শহিদের বীরের সম্মানের পাশে ম্লান হয়ে যায় শিলচরের ভাষা আন্দোলন এবং পুরুলিয়ার ভাষা আন্দোলন ম্লান। অথচ দু’বার রাজ্য বদলে নিমড়ি ব্লকটা একবার গেল বিহারে, পরে ঝাড়খন্ডে। তবে এ নিয়ে গাঁধী-ভাবনায় সম্পৃক্ত দীপঙ্কর রায়ের কোনও খেদ নেই। আঞ্চলিক নামেই বেশি পরিচিত এই মানুষটি নিমড়ি স্টেশনের কাছেই গাঁধী আশ্রম ‘লোকসেবায়তন’-এর র অন্যতম পরিচালক। “না, কোনও খেদ নেই। কী করব? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল? ঝাড়খন্ড সরকার বলেই দিয়েছে আমাদের বাংলা মিডিয়াম বিদ্যালয়, নিমড়ির এই ‘লোকসেবায়তন আশ্রম বিদ্যালয়’ কোনও রকম সাহায্য পাবে না। আমরা চাইও না। নিজেদের মতো করেই চালাচ্ছি। বর্তমানে ক্লাস ফোর থেকে ফাইভ হয়েছে। একটি করে ক্লাস বাড়ছে প্রতি বছর।”
দীপঙ্করের জন্ম ইলাহাবাদে ১৯৪৬ সালে। বাবার দেশ হুগলির সুগন্ধায়। মায়ের বাবার দেশ ঢাকার সোনারং গ্রাম। দীপঙ্করের বাবা-মা-র প্রেমজ বিয়ে, গাঁধী আদর্শে, ওয়ার্ধায়। নবদম্পতি ও পুত্রসন্তানকে আশীর্বাদ করে গ্রামের উন্নয়নের জন্য পাঠান নিমড়িতে ১৯৪৭-এ, গাঁধী নিজে। সেই থেকে দীপঙ্কর এই গাঁধী আশ্রমে। প্রাথমিক স্কুল-পাঠ নিমড়িতেই। উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনে। ভূগোল নিয়ে স্নাতক আশুতোষ কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে। তার পর শুধুই গাঁধী ভাবনায় গ্রামোন্নয়ন এবং বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। নিজে অবশ্য বাংলা-ইংরেজি-সংস্কৃত-হিন্দিতে স্বচ্ছন্দ, লিখন ও পাঠে। আঞ্চলিক দু’একটি ভাষায় অনর্গল কথা বলেন। গ্রামোন্নয়নের কাজে অনেক দিশি-বিদেশি সাহেবসুবো ঘেঁটেছেন। আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন ‘অক্সফামে’র সঙ্গে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ‘ব্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ডে’র সঙ্গে। সত্তরের দশকে ফুড ফর দ্য ওয়ার্কের বিদেশি অর্থসাহায্যে নিমড়ি ব্লকেই কাটা হয়েছিল ১৪টি দিঘি। যার আয়তন ১৫ বিঘা থেকে ৩০ বিঘা। যার জল এখনও ওই অঞ্চলের প্রাণ, কৃষি-সেচের ও গৃহীর একমাত্র রেন ওয়াটার হারভেস্টিং। আজ থেকে ৪০ বছর আগে। ভাবা যায়!
ভাবা যায় না একাধিক বিদ্যালয় বহির্ভূতদের জন্য (৬-১৪ বছর বয়স্ক পড়ুয়াদের) দীপঙ্কর তৈরি করেছিলেন দেওয়াল জোড়া পাঠ্যপুস্তক। প্রতিপক্ষে, ওই বিশাল বইয়ের শুধুমাত্র একটি পাতায় নিজে হাতে ছড়া লিখতেন, ছবি আঁকতেন। আর বিষয়? অঙ্ক-ইতিহাস থেকে বিজ্ঞান, আরও কত কী। এই ‘শিক্ষা সৈনিক’কে দেখে দিল্লির পরিদর্শকমণ্ডলীর চোখ কপালে উঠেছিল।
টাটা শহরের প্রতিষ্ঠান ‘বঙ্গ পরিষদে’র সম্পাদক-চেয়ারম্যানরা এসে আশ্রমের স্কুল পরিদর্শন করে অবাক। অথচ ঝাড়খন্ডের একমাত্র বাংলা ভাষার স্কুল এই নিমড়িতেই। ‘কী কী প্রয়োজন?’ জানতে চান বঙ্গ পরিষদের চন্দনবাবু ও অমিতবাবু। করজোড়ে বিনীত আহ্বান, “ছেলেমেয়েদের পানীয় জলের কলটা খারাপ হয়েছে। ওটা সারাতে পারছি না, যদি কৃপা করে ...”। কলে এখন জল আসে রোজ। রোজ সকালে করজোড়ে স্কুলের পথে দীপঙ্করবাবু পড়ুয়াদের আদর করে ডেকে নেন। স্ত্রী শ্রীপর্ণা সংসার সামলে, রাত জেগে বাচ্চাদের পাঠ্যবিষয় তৈরি করেন। বাচ্চাদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাসত্রে যুক্ত আশ্রমবাসী বেলাদি-পানুদি-মমতাদি। সকলেই আশির কোটা পার।
এমন ভাবার কারণ নেই যে এই শিশুদের পাঠ্য তালিকায় শুধুই বাংলা। বরং বলা ভাল ত্রিভাষী। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এদের শেখানো হয় ইংরেজি ও হিন্দি। এই স্কুলের প্রতি স্থানীয় অভিভাবকদের আগ্রহ অপরিসীম। এত ভাল পড়াশোনা হয় বলেই দিল্লির শিক্ষা বিভাগ থেকে নির্বাচিত ছাত্রছাত্রীদের আমন্ত্রণ করা হয়। এ ছাড়া একটি তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছে এই স্কুলের পঠন-পাঠন নিয়ে। এই স্কুলের পড়ুয়াদের সহবত বিস্ময়ের। বাড়ি ফেরার পথে ওই পড়ুয়াদের দিকে তাকিয়ে কোনও পথচারী যদি হঠাৎ গেয়ে ওঠেন ‘জনগণমন... তো পড়ুয়ারা দাঁড়িয়ে পড়বে, করজোড়ে গানটা গাইবে। গান শেষে ‘নমস্কার’। তার পর ঘরের পথে। |