পুস্তক পরিচয় ১...
ইতিহাস চর্চায় মঙ্গলকাব্য প্রান্তিক
পোয়েট্রি অ্যান্ড হিস্টরি বেঙ্গলি মঙ্গলকাব্য অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন
প্রিকলোনিয়াল বেঙ্গল
, ডেভিড এল কার্লে। ক্রনিকল বুকস, ৬৫০.০০
ঙ্গলকাব্য-পর্বের বাংলা নিয়ে এক আধুনিক উপন্যাসের (ধনপতির সিংহলযাত্রা, রামকুমার মুখোপাধ্যায়) শুরুতেই আছে একটি বিলাপ ইংরেজের চালু করা শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্গসন্তান একদিন প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে ভুলে গেল কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামকে। অসার কথা নয়। ১৮৯৬ সালেই তো দীনেশচন্দ্র সেন সমকালের যুবকদের সম্পর্কে লেখেন ‘তাঁহারা জুলিয়েট ও এণ্ড্রেমেকি প্রভৃতি নামের পক্ষপাতী, কিন্তু বেহুলা, লহনা, কানেড়া প্রভৃতি সেকেলে নাম শুনিয়া প্রীতি বোধ করেন না।’ তাও তো ভাগ্যিস আজকাল বোকাবাক্সের দৌলতে চাঁদ বেনে, সায় বেনেদের অনেকে চিনলেন।
না। বাংলার ইতিহাসের একনিষ্ঠ গবেষক ও ওয়েস্টার্ন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড কার্লে-র আক্ষেপ এ কারণে নয়। কারণটা বোধহয় এ রকম যে, এখানকার ইতিহাসবিদরা প্রায় সকলেই মঙ্গলকাব্য ব্যবহার করে তথ্য নিলেন, কিন্তু স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয় রূপে তা নির্বাচিত হল না। হিতেশরঞ্জন সান্যালও মঙ্গলকাব্যকে গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন মধ্যকালীন বাংলার ইতিহাসের একটি উপাদান হিসেবেই। মঙ্গলকাব্যে প্রতিফলিত মধ্যযুগের বাংলার নগরজীবন সম্পর্কে আশুতোষ ভট্টাচার্যের বক্তব্য ছিল ‘বাংলার কোন উল্লেখযোগ্য ইতিহাসের মধ্য দিয়া এই সকল তথ্য আজও পরিবেষণ করা হয় নাই।’ সবে ষাটের দশকের শেষে এডওয়ার্ড ডিমক আর রোনাল্ড ইনডেন মঙ্গলকাব্য অনুসারে প্রাক্-ব্রিটিশ বাংলার শহর নিয়ে সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখলেন। আর সম্প্রতি মঙ্গলকাব্যকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রেখে তাকে ইতিহাস বলা যাবে কিনা এ জাতীয় আলোচনা-নির্ভর একটি বই লিখেছেন কুমকুম চট্টোপাধ্যায় (দ্য কালচার্স অব হিস্টরি ইন আর্লি মডার্ন ইন্ডিয়া)।
মঙ্গলকাব্য নিংড়ে প্রয়োজনীয় আহরণ বা দীনেশ সেনদের মতো কোনও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এই কাব্যকে দেখতে চাননি ডেভিড। এ কথাই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে আলোচ্য (পরের অধ্যায়গুলো অবশ্য এই বক্তব্যকে ঠিক সমর্থন করছে না)। ডেভিড বলছেন, গল্পগুলোর ধরন, কী ভাবে তা বলা হচ্ছে (‘performative genre’) ঐতিহাসিককে এ সব বিচার করতে হবে। বোঝা যাবে কেমন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গল্পগুলো ফাঁদা হয়েছিল। সময় আর পরিস্থিতি অনুসারে গল্প বা তা বলার ধরনটা কী করে বদলাচ্ছে এবং তার প্রেক্ষাপটটা ধরতে হবে। দেখতে হবে কুশীলবরা কী হারাচ্ছেন, কী ভাবে হারাচ্ছেন, আর এ থেকেই বোঝা যাবে সমকালের মঙ্গলকাব্যের লেখকরা কী ভাবে তাঁদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বর্ণনা করতেন আর তার সমাধান দিতেন। এতে একটা সময়, সমাজ, পরিস্থিতি, তার পরিবর্তন সবটাই ধরা পড়বে।
লিখতে বসে ডেভিড সীমান্ত বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথাও বলেছেন। একটা প্রেক্ষিত তুলে ধরেছেন, যেখানে রাজার আদর্শ, রাজধর্মের মূল্যবোধের অদলবদল ঘটেছিল। চণ্ডীমঙ্গলের রাজার মধ্যে ‘Warrior Ethos’-এর বদলে ‘Pacific Royal Virtue’-র প্রকাশ ঘটছে। স্থানীয় অস্পৃশ্য এক রাজার প্রেক্ষিতে শান্তিপূর্ণ একটা রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন করে তৈরি হবে, সেটাই মুকুন্দরামের সামনে অন্যতম সমস্যা ছিল বলে গ্রন্থকার দ্বিতীয় অধ্যায়ে লিখেছেন। দু’টি লেখা রয়েছে সমকালের রাজনীতিতে শাসক আর প্রজার মাঝে উপহারস্বরূপ পান-এর গুরুত্ব ও ষোড়শ শতকে মহিলাদের নীতি নিয়ম, পোশাক, আচরণ বিষয়ে। ডেভিডের বক্তব্য, আগে এ দেশে লিঙ্গ, পৌরুষ বা নারীত্বকে যে ভাবে বিচার করা হত, ব্রিটেন থেকে আমদানিকৃত ধ্যানধারণায় তার বদল ঘটে।
ছোটখাট রাজা আর তার পারিষদরা কেমন ভাবে হিন্দু বণিক আর তাদের কেরামতিকে দেখতেন, এক কথায় ষোড়শ শতকে হিন্দু বণিকের পরিবর্তিত দুনিয়াকেও আলোচনায় বাদ রাখা হয়নি। এখানে বণিক কোনও মূল্যবান সামগ্রীর জন্য বিদেশযাত্রা করেন না, তাই এই ‘বৈদেশিক বাণিজ্য’কে কূটনীতির অনুষঙ্গ বলছেন লেখক। আসলে, ষোড়শ শতক থেকে বাঙালি বণিকদের পিছু হটা শুরু হয়, মুদ্রার অভাবে চলছিল বিনিময় বাণিজ্য, আর তাই আর্থিক সংকটই নাকি ধনপতি বা চাঁদ সওদাগরের দৈবী আশ্রয় ভিক্ষার অন্যতম কারণ বলে ঐতিহাসিক গণ্য করে থাকেন। তবে মঙ্গলকাব্যের কবি কেন, পরেও অনেকে বাঙালি বণিকের সেই ‘সোনালি দিন’কে স্মরণ করেছেন, নানা ভাবে। গুয়াহাটির অধ্যাপক আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় ১৯২০-তে লিখেছিলেন শ্রীমন্ত উপন্যাস, তারও আট বছর আগে নাম না উল্লেখ করা এক জন লিখেছিলেন শ্রীমন্ত সওদাগর নামের এক আখ্যান, যেখানে আশা করা হয়েছিল যে, চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনি প্রচারিত হলে “আমাদের মধ্যে পূর্ব্ব-আচার-ব্যবহারের পুনঃ প্রতিষ্ঠা হইবে।” রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ১৯৩৮-এ বাংলার নদীবাণিজ্য নিয়ে তাঁর গ্রন্থেও প্রাসঙ্গিক ভাবে মঙ্গলকাব্যের কথা এনেছিলেন।
শেষ দু’টি অধ্যায় একটু অন্য স্বাদের। প্রথমটি নদিয়াধিপতি চতুরচূড়ামণি শ্রীযুক্ত কৃষ্ণচন্দ্র রায় সংক্রান্ত। দোরগোড়ায় দাঁড়ানো ইংরেজদের সঙ্গে বাহুবলে এঁটে উঠতে পারবেন না বুঝে তিনি ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদির দিক থেকে সর্বোচ্চ একটা বিকল্প পথ বাছলেন। ডেভিডের লেখা পড়ে তেমনটাই বোধ হয়। মন্দির গড়ে, অগ্নিহোত্র, বাজপেয় ইত্যাদি যাগযজ্ঞ করে, ভারতচন্দ্রের মতো কবি ‘পুষে’ তিনি হয়ে গেলেন স্বাধীন, যার কর্তৃত্বের উৎস মুঘল সম্রাটের সনদ নয়, মা অন্নপূর্ণার কৃপা। সত্যিই নদের চাঁদ সফল; মুর্শিদাবাদে আটক হওয়ার পরও রায়গুণাকর তাঁকে গোষ্ঠীপতি থেকে কলির কৃষ্ণ কোনওটাই বলতে ছাড়েননি। সে কথাই তো বলেছেন রজতকান্ত রায় দেওয়ানি সনদে নিয়োজিত এক খিদমৎকারি জমিদার যে লোক, সেই একই লোক দেশবাসীর কাছে সর্বশক্তিমান রাজা হওয়ায় ভারতচন্দ্রের মতো কবিদের কাছে দুইয়ের মধ্যে কোনও তফাত ছিল না।
রামানন্দ যতি আর বিক্রমপুরী বৈদ্য লালা জয়নারায়ণ সেনের হাতে আঠারো শতকে মুকুন্দরামের চণ্ডী কী ভাবে সংশোধিত হয়ে নতুন গল্প হল তা সর্বশেষ অধ্যায়। দু’জনের লেখা চণ্ডী আখ্যানেই কালের কোনও প্রভাব নেই বলে ডেভিড লিখছেন। তবে জয়নারায়ণের হরিলীলা ব্যতিক্রম। কাব্যের অন্যতম চরিত্র ‘প্রচেষ্টা’ (নামটি লক্ষণীয়) যে ভাবে তার মনিবের জায়গা দখল করে, তার মধ্যে ডেভিড ষড়যন্ত্র করে কুর্সি দখল করা দেশীয় লোকজন বা কোম্পানি আমলাদের ছায়া দেখতে পেয়েছেন। তবে জয়নারায়ণ কেন, অমরেন্দ্রনাথ রায় বহু কাল আগে যে ‘শাক্ত পদাবলি’ সংকলন করেন সেখানেও তো অনেক জায়গায় সর্বস্ব লুঠে খাওয়া ‘জুয়াচোর আমলা’ বা ‘নষ্টের গোড়া সৃষ্টিছাড়া’ দেওয়ানদের কথা পাই।
বাস্তবিকই মঙ্গলকাব্য নিয়ে ঐতিহাসিক গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। ধরা যাক মুকুন্দরামের কথাই। তিনি একটা কাহিনি লিখলেন ষোড়শ শতকে। আর ১৯৩৩-এ দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্মৃতি-রেখা-য় লিখলেন, ‘শ্রীমন্তের মশান’ পালায় চাটগেঁয়ে নাবিকের মুখে তিনি গাইতে শুনেছেন‘তিনটী টাকা লইব বাবু সিংহলে যাইতে, আর কিছু লইবো পিয়াজ পথেতে খাইতে’অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্র ও প্রেক্ষাপট ভেদে কাহিনি বা গানের ধরন বদলাচ্ছে, এই মার্কিন গবেষকের বক্তব্যই তো হল ওই স্থান-কাল বা প্রেক্ষাপটটা নির্দিষ্ট করা। রামানন্দ বা জয়নারায়ণদু’জনেই কেন ভক্তিরসে ডুবলেন, তা কি আঠারো শতকের অরাজক পরিস্থিতি জনিত উদ্বেগে? বইতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এই সময়ে হাস্যরসই বা কেন প্রাধান্য পাচ্ছে? আসলে উদ্বেগ তো শুধু ভক্তি দেয়নি, পালাবদলের সেই কালে মঙ্গলকাব্যে কামোদ্দীপক বিষয় বা হাস্যরসের অন্তর্ভুক্তির যে কথাটা লেখক বলছেন, সেই পরিস্থিতিটা গবেষণার বিষয়। অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, এর কারণ হল বহু দিনের নৈরাজ্য আর অর্থনৈতিক ভাঙাগড়ার ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয়, ‘যে কারণে কৃষ্ণনগর রাজসভার নিম্নরুচিকে তৃপ্ত করতে’ ভারতচন্দ্র ‘প্রায় পর্ণোগ্রাফি’ লিখলেন। শুধু রাজসভা কেন, চণ্ডীচরণ সেন তো ১৮৮৫-তে বসে লিখে গিয়েছেন যে একশো বছর আগে (অর্থাৎ আঠেরো শতকের শেষার্ধে) লোকে কবিকঙ্কণ না শুনে বিদ্যাসুন্দর শুনতে পছন্দ করত। সুতরাং প্রেক্ষাপটটা বিচার্য।
ডেভিড কার্লে-র লেখার মুন্সিয়ানা প্রশ্নাতীত। তবে ‘Contact Zone’, ‘Bi-Polar Model of Rulership’ বা নিকোলাস ডার্কস বর্ণিত ‘Little King’ জাতীয় শব্দ মাঝে মাঝে সাহিত্য বা ইতিহাসের নির্ভেজাল পাঠককে একটু বেগ দেবে। তবে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানীরা jargon ব্যবহারে যে পরিমাণ উদার, সেখানে ডেভিড ব্যতিক্রম। কিছু ধারণা, যেমন ‘modernity’, এ সবের প্রয়োগ সম্পর্কে একটু সতর্ক থাকলে ভাল হত। আঠারো শতকে বিদ্যাসুন্দর লেখা হচ্ছে, উনিশে তার দাপটে মাইকেল ‘শর্মিষ্ঠা’য় লিখলেন ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে।’ আবার, আঠারো শতকেই রামানন্দ যতি লিখেছেন ‘কুরসে কঙ্কন কবি ভাল’ অর্থাৎ, তখনও রস/ কুরসের অনুভূতি লোক ভেদেই পৃথক ছিল। তা হলে modernity-র হাওয়া কবে থেকে ধরা হবে?
যেহেতু বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত লেখাগুলো ডেভিড এক মলাটে এনেছেন (যদিও বোঝা গেল না এই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই রাল্ফ নিকোলাসের সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রকাশিত আরেকটি বইতে তিনি ধর্মমঙ্গলের লাউসেনকে দিয়ে বাংলায় ক্ষাত্রতেজ খোঁজার প্রয়াসে যে-লেখাটি লিখেছিলেন, তা কেন এতে ঢুকল না) তাই পুনরুক্তির সমস্যা থাকবেই। তবে এই বই প্রাক্-ঔপনিবেশিক বাংলার সাহিত্য-সমাজ নিয়ে আগ্রহী গবেষকের কৌতূহল বৃদ্ধি করবে।
First Page Alochona Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.