|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
পরিবর্তনের রক্তকরবী |
রবীন্দ্রনাথ থেকে শম্ভু মিত্র। নাটক পাল্টেছে বারবার। সে পথেই পূর্ব পশ্চিমের এ সময়ের
প্রযোজনা। প্রতি বাঁকে পাল্টে যাওয়া দিনের স্বাক্ষর। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
সম্প্রতি ‘পূর্ব পশ্চিম’ প্রযোজিত ‘রক্তকরবী’ নাটকটি আর এক বার দেখা গেল। ৮৮ বছর আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই নাটক যে এখনও কত প্রাসঙ্গিক!
নাটকের শুরুতে বন্দুক উঁচিয়ে যক্ষপুরীর প্রহরীরা। আমান আলি খান ও আয়ান আলি খানের সঙ্গীতে তখন অ্যাম্বুল্যান্সের হর্ন। আর জালের কাছে এসে নন্দিনী আর্ত স্বরে ডাকতে থাকে, “রাজা, বেরিয়ে এসো। দেখছ না, মানুষগুলি কেমন সন্দেহ করছে। রেগে আছে। যে কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।”
কিন্তু ক্ষমতার জালে বন্দি, দাম্ভিক রাজা কবেই বা বিস্ফোরণের খবরে পাত্তা দিয়েছে? রবীন্দ্রনাথের টেক্সটে যে সংলাপ ছিল অনেক পরে, তাকেই আগে নিয়ে এসেছেন পরিচালক গৌতম হালদার। রবীন্দ্রনাথ এতটাই তীক্ষ্ম যে, আজও খুঁজে পাওয়া যায় বিস্ফোরণের অ্যালকেমি!
এই নতুন ‘রক্তকরবী’ কী রকম? অ্যাম্বুল্যান্সের হর্ন ছাড়ুন! যক্ষপুরীর শ্রমিকেরা কানে ‘হেডফোন’ লাগিয়ে হরিনামের সময় ডিস্কো নাচের তালে শরীর দোলায়। যক্ষপুরীতে যে যান্ত্রিকতার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই যন্ত্রসভ্যতা আজকের চেনা উপচার নিয়েই উঠে আসে মঞ্চে। সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চসজ্জা এ নিয়ে সাধুবাদ পেতে পারে।
নাটকের অন্যতম সম্পদ নন্দিনীর চরিত্রে চৈতি ঘোষালের অভিনয়। ‘রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি নন্দিনী বলে একটি মানবীর ছবি’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজ অবশ্য জালের আড়ালে ওই শক্তিশালী রাজা কে, নন্দিনীই বা কে, তা নিয়ে আমাদের অস্পষ্ট ধারণা আছে।...
১৬ বছরের রানু অধিকারী (পরবর্তী কালে লেডি রানু মুখোপাধ্যায়)-কে নিয়ে তখন শিলং যাচ্ছেন ৬২ বছরের রবীন্দ্রনাথ। সেখানেই রক্তকরবীর প্রথম খসড়া। নায়িকার নাম তখন ‘খঞ্জনী’। তার পরেও দশ বার বদলেছে পাণ্ডুলিপি। |
|
রানুই যে নন্দিনী, সংশয় নেই। আর জালে বন্দি রাজা? শঙ্খ ঘোষ তাঁর এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, জাল ছেঁড়ার পথে কী ভাবে এগিয়ে আসেন রক্তকরবীর রাজা। প্রথমে রাজা জানান, “সময় নেই, একটুও না।” দ্বিতীয় বার: “এখনও সময় হয়নি।” তৃতীয় বার বলেন, “তোমাকে আমার পরিচয় দেওয়ার সময় এসেছে।” তিনটি সংলাপই এই নাটকে আছে। কিন্তু কী ভাবে এল পরিচয় দেওয়ার সেই সময়? শঙ্খ ঘোষের বক্তব্য ছিল, ‘নিজের ভিতরে ভালবাসার জেগে-ওঠাই হল সেই সময়।’ তাই তো নন্দিনীর সঙ্গে রঞ্জনের মিলনের পথে আর বাধা দেন না শক্তিমান রাজা। নিজে থেকেই চলে যেতে চান দূরে। ক্লান্ত ব্যথায় তিনি নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করেন, “রঞ্জনকে চাও বুঝি? সর্দারকে বলে দিয়েছি, এখনই তাকে এনে দেবে।” ৬২ বছরের রবীন্দ্রনাথই যে জালে বন্দি রাজা, সন্দেহ নেই।
চৈতি ঘোষালের নন্দিনী পারলেও মলয় ঘোষালের ‘রাজা’ দিতে পারল না রবীন্দ্র-অবচেতনার সেই নিগূঢ় বার্তা। রাজা মানেই আজও বহুরূপীর প্রযোজনায় শম্ভু মিত্র। তবে সেখানে রাজা জাল ভেঙে বেরিয়ে এসেও মঞ্চের অন্ধকারে থাকতেন। এখানে অন্ধকার নেই। স্মোক মেশিনের ধোঁয়া আর উজ্জ্বল আলোয় বেরিয়ে আসেন রাজা। টেলিফিল্মের ঢঙে!
কিশোরের ভূমিকায় শ্রমণ চট্টোপাধ্যায় ও বিশু পাগলের ভূমিকায় শুভ্রজিৎ দত্ত চমৎকার। আর সর্দারের চরিত্রে চোস্ত কুর্তা-পায়জামা ও ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে সৌমিত্র মিত্রের অভিনয় নীরবে জানিয়ে দেয় এক ট্রাজেডির কথা। যক্ষপুরীর রাজা নিজেকে বদলাতে পারলেও বেতনভুক সর্দারেরা পারে না!
পাঁচ দশক আগে শম্ভু মিত্র পরিচালিত রক্তকরবীতে নন্দিনী মরেনি। এখানে অবশ্য শেষ দৃশ্যে পড়ে থাকে তার লাশ। একটু আগেই ‘সর্দার ওর বর্শার আগে আমার কুন্দফুলের মালা ঝুলিয়েছে। ওই মালাকে আমার বুকের রক্তে রঙিন করে দিয়ে যাব,’ বলতে বলতে শেষে সুইসাইড বম্বারের মতো ছুটে বেরিয়ে যায় সে! পাঁচ দশক আগের পাশে আজকের প্রযোজনায় এমনই সব ‘পরিবর্তন’!
আর পরিবর্তনই জীবন! সৌমিত্র মিত্র, গৌতম হালদারেরা সে কথা বিলকুল জানেন। |
|
|
|
|
|