কোথাও পঠনপাঠন বন্ধ হওয়ার জোগাড়, ব্যাহত হচ্ছে মিড-ডে মিল
শিক্ষক বদলির জেরে সমস্যায় বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়
শুধু বীরভূম জেলাই নয়, রাজ্যের প্রাথমিক স্কুলগুলির শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলি নেওয়ার হিড়িকে পঠন-পাঠনে সমস্যা দেখা দিয়েয়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেও। জেলার মধ্যে বদলির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে বনগাঁ মহকুমার বাগদা ব্লকে। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত এই ব্লকে ৬৭ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার বদলির নিদে৪শ দিয়েছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা দফতর। সরকারি ওই সিদ্ধান্তের ফলে এই ব্লকের বেশ কিছু স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র একজন-এ ঠেকেছে। কোথাও কোথাও সংখ্যাটা দুই কি তিন। বদলির এই ঢালাও নির্দেশ নিয়ে ইতিমধ্যেই ‘বেনিয়ম’-এর অভিযোগ উঠেছে। দেখা গিয়েছে এমন অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকেই বদলি করা হয়েছে যাঁদের এখনও বদলি করার সময়ই আসেনি। এই অবস্থার জেরে বাগদা ব্লকের বহু স্কুলে যেমন নিয়মিত পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনই স্কুলে মিড মিল চালানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। শিক্ষক বদলির জেরে সমস্যা দেখা দিয়েছে বসিরহাট মহকুমাতেও।
বদলির জেরে বহু স্কুলেই শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পড়ুয়াদের ভিড় সামলাতে নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। হটাৎ এমন বদলির ঘটনায় শিক্ষকমহলের ধারণা, গ্রামের স্কুল থেকে শহরের স্কুলে আসার প্রবণতার জন্যই এটা হচ্ছে। বাগদা ব্লকের একটি স্কুল কুলবেড়িয়া এফ পি স্কুল। স্কুলসূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে সেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২৫ জন। জানুয়ারি মাসেও এখানে শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন ৪ জন। ইতিমধ্যেই একজন অবসর নিয়েছেন। তিনজনের মধ্যে সম্প্রতি দু’জন বদলি হয়েছেন। বিদ্যালয়ের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে একা প্রধান শিক্ষক রমেশচন্দ্র বিশ্বাসকে।
সামলাচ্ছে বলা ভুল। বলা ভাল কোনওরকমে চালিয়ে যাচ্ছেন। কী ভাবে চালাচ্ছেন? প্রশ্ন শুনে রমেশবাবুর উত্তর, “একটি ঘরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির এবং আর একটি ঘরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াদের বসানো হচ্ছে। একটা ঘরে রোল কল করে, পড়া বুঝিয়ে কিছু লিখতে দিয়ে আর একটা ঘরে চলে যাচ্ছি। খুবই সমস্যা হচ্ছে। তবু কী করব, এ ভাবেই চালাতে হচ্ছে।” ক্ষুব্ধ রমেশবাবু বলেন, “শিক্ষকদের বদলির নির্দেশপত্রে লেখা থাকে ‘ইন দ্য বেস্ট ইন্টারেস্ট অব প্রাইমারি এডুকেশন’। কিন্তু এই বিদ্যালয় থেকে দু’জন শিক্ষককে তুলে নিয়ে শিক্ষার কি স্বার্থ পূরণ করা হল বুঝতে পারলাম না।” দিন কয়েক আগে রমেশবাবু সর্বশিক্ষার গণিত অভিমুখীকরণ কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিতে গিয়েছিলেন। সেই সময় অন্য একটি স্কুল থেকে শিক্ষক এনে স্কুল চালাতে হয়েছিল। একই ছবি দেখা গিয়েছে রাজকোল এফ পি স্কুলেও। সেখানেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনজন শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন। গত জুন মাসে দু’জনকে বদলি করে দেওয়া হয়। এখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকই স্কুল চালাচ্ছেন। চাপারুই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেও প্রধানশিক্ষক-সহ দু’জন শিক্ষককে সম্প্রতি বদলি করা হয়েছে। একমাত্র শিক্ষক বাসুদেব বিশ্বাস স্কুল চালান। কিন্তু তাঁকেও আবার বিএলও প্রশিক্ষণে যেতে হচ্ছে। ফলে সেই সময় বন্ধ থাকছে পঠনপাঠন। কাশীপুর এফ পি স্কুলে একজন পার্শ্বশিক্ষক-সহ শিক্ষকের সংখ্যা তিন। জুন মাসেই একজন বদলি হয়েছেন। সমস্যা হচ্ছে সেখানেও। প্রধান শিক্ষক অশ্বিনী বিশ্বাস বলেন, “প্রথমত ঘরের সমস্যা। দু’টি ঘর থাকলেও বৃষ্টি হলে একটি ঘরে ক্লাস করা যায় না। এর উপর একজন শিক্ষক বদলি হয়ে গিয়েছেন। পড়াব নাকি মিড ডে মিলের চালের হিসাব রাখব? সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
শিক্ষকদের এ হেন বদলিতে বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে পঠনপাঠন এবং মিড ডে মিল ব্যাহত হওয়ার জেরে ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরাও। বাগদা ব্লকের বেশিরভাগ মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। অভিভাবকদেরও বেশিরভাগই খেতমজুর। তাঁদের কথায়, “স্কুলে ছেলেমেয়েদের পাঠালেও কোনও ক্লাস হয় না। আমাদের সামর্থ্য নেই ছেলেমেয়েদের বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর। পনাশোনার ক্ষতি করে এভাবে স্কুল থেকে শিক্ষক সরিয়ে নেওয়াটা অন্যায়।”
শিক্ষক মহলের একাংশের অভিযোগ, জেলায় বহু স্কুল শিক্ষক সমস্যায় ভুগলেও দেখা যাচ্ছে বদলির জেরে কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শিক্ষক রয়েছেন। আবার যেখানে স্কুলে দু’জন শিক্ষক ছিলেন সেখানে একজনকে স্কুল চালাতে হচ্ছে। কী কারণে এটা করা হচ্ছে তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। তবে পুরো বিষয়টিতেই তাঁরা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। বনগাঁ মহকুমায় তৃণমূলের শিক্ষা সেলের সভাপতি কৃষ্ণপদ দাস বলেন, “কোনও আইন না মেনে জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের পক্ষ থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলি করে কিছু স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব তৈরি করা হয়েছে।”
প্রাথমিক স্কুলগুলির এই সমস্যা নিয়ে বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ রাজ্যের স্কুলশিক্ষামন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে ইতিমধ্যেই অভিযোগ জানিয়েছেন। গোপালবাবু বলেন, “জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের এই সব বদলির ফলে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্কট তৈরি হয়েছে। গোটা ঘটনায় অবৈধ লেনদেন রয়েছে বলে তাঁর আশঙ্কা।”
স্কুল দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বাগদা ব্লকে দু’টি চক্র রয়েছে। বাগদা পূর্ব চক্র থেকে বদলি হয়েছেন ৪০ জন এবং বাগদা পশ্চিম চক্র থেকে ২৭ জন। নিয়োগের চারমাসের মধ্যে বদলি হয়েছেন এমন ঘটনোা ঘটেছে। যেমন রণঘাট অম্বেডকর স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে কয়েক মাস আগে যোগ দিয়েছিলেন মিজানুর রহমান। সম্প্রতি তাঁকেও বদলি করা হয়েছে। যদিও দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, নিয়োগের এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ‘সার্ভিস বুক’ চালু না হওয়া পর্যন্ত কোনও সিক্ষককে বদলি করা যায় না। তা ছাড়া দেখা গিয়েছে, বদলির কোনও প্রপোজাল পাঠানো হয়নি, অথচ কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে। যেমন স্থানীয় রাঘবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষককে ২৭ জুনের মধ্যে অন্যত্র বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়। গাঘিাটা পূর্ব ও পশ্চিম চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক খইরুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, “আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষককে ছাড়া সম্ভব নয়।”
আর এমন বদলি নিয়ে কী বলছেন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক দ্বীপায়ন দাস? তাঁর কথায়, “আমি দিন কয়েক হল দায়িত্বভার নিয়েছি। স্কুলে কম শিক্ষক-শিক্ষিকার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” শিক্ষক বদলির জেরে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পঠনপাঠনের সমস্যার প্রসঙ্গে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “রাজ্যের কয়েকটি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ নতুন করে গঠন করা হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাও রয়েছে। সংসদ গঠিত হওয়ার পরে যাবতীয় অভিযোগের তদন্ত করা হবে। যেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা খুব কম, সেই সব স্কুলে শিক্ষক পাঠানোর ব্যবস্থা হবে। যতদিন না এই ব্যবস্থা কার্যকর করা হচ্ছে ততদিন প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ এবং বদলি বন্ধ রাখা হবে।”
First Page South Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.