|
|
|
|
মনমোহনের মান ভাঙালেন সনিয়া, তবে মন্ত্রী বদল নিয়ে জট বহালই |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
আর নীরব থাকলেন না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
দিগ্বিজয় সিংহের মতো শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতা যে ভাবে প্রকাশ্যে রাহুল গাঁধীকে এখনই প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে সওয়াল করেছেন, তাতে মনমোহন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কারণ, এই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে তাঁকে ‘ঠুঁটো’ প্রধানমন্ত্রী বলে কটাক্ষ করছে বিরোধীরা। গত শুক্রবার দলের কোর কমিটির বৈঠকে শীর্ষ নেতাদের সামনেই নিজের ক্ষোভের কথা সনিয়া গাঁধীকে জানিছেন মনমোহন। তিনি দলনেত্রীকে বলেছেন, “দল চাইলে আমি ইস্তফা দিতে রাজি। রাহুল গাঁধীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখতে চাই। কিন্তু নেতারা যদি প্রকাশ্যে আমার বিরুদ্ধে বলতে থাকেন, তবে তা খুবই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।” সনিয়া কালবিলম্ব না করে ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন এবং পরে দিগ্বিজয়কে ডেকে বিষয়টি স্পষ্ট করার নির্দেশ দেন। এই কারণেই গত কাল দিগ্বিজয় বিবৃতি দিয়েছেন: “প্রধানমন্ত্রী খুব ভাল কাজ করছেন। তাঁকে সরানোর কথা আমি বলিনি। রাহুল গাঁধীও যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সেটাই বলতে চেয়েছি।”
কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, এই ঘটনা মনমোহন এবং সনিয়ার পারস্পরিক বোঝাপড়াকে দৃঢ় করেছে। কোর কমিটির বৈঠকের পর সনিয়া-মনমোহন আলাদা বৈঠকে বসেন। সেখানে মন্ত্রিসভার আসন্ন রদবদল নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। ওই সূত্রটি বলছে, সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় দল ও সরকারের মধ্যে ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন, যোগগুরু রামদেবের অনশন সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে জনমানসে এই বার্তা যাচ্ছে যে, সরকার ও কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেটা কোনও অবস্থাতেই কাম্য নয়। তাই মন্ত্রিসভার রদবদলের মাধ্যমে দল এবং সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সমন্বয়কে দৃঢ় করার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন সনিয়া ও মনমোহন। সেই কারণেই মন্ত্রিসভার এ বারের রদবদলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
শুধু দল ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোই নয়, মন্ত্রিসভার রদবদলের মধ্য দিয়ে আরও একটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে চান মনমোহন। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আড়াই বছর অতিক্রান্ত। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় মনে করছে, সরকারকে ঘিরে মধ্য বয়সের সঙ্কট মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতিকে লোকে আর ক্ষমার চোখে দেখছে না, বরং সমালোচনায় অনেক বেশি মুখর হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা থেকে শুরু করে লোকপাল বিল নিয়ে আন্না হাজারের আন্দোলন, কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে যোগগুরু রামদেবের অনশন সব নিয়েই জেরবার মনমোহন সরকার। এমন দশার মধ্য দিয়ে সব সরকারকেই যেতে হয়। এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বে এই দশা কাটিয়ে ওঠার একটি স্বীকৃত উপায় হল মন্ত্রিসভায় বড় মাপের রদবদল ঘটিয়ে একটা ‘ঝাঁকুনি’ দেওয়া।
মনমোহনও সেই কথা ভাবছেন। তাই শুধু দীনেশ ত্রিবেদীকে রেলমন্ত্রী করে রদবদল পর্ব সেরে ফেলতে চাইছেন না তিনি। সেই কারণেই গোড়ায় ২ জুলাই দীনেশের শপথগ্রহণ হবে বলে ভাবা হলেও তা বাতিল করা হয়েছে। সময় নিয়ে মন্ত্রিসভার সামগ্রিক রদবদল সেরে ফেলতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদের বাদল অধিবেশনের আগে মন্ত্রিসভায় বদল হওয়ার কথা। প্রাথমিক ভাবে ২১ জুলাই থেকে অধিবেশন বসার কথা থাকলেও সময় কেনার তাগিদেই তা পিছিয়ে ১ আগস্ট করা হয়েছে। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল আগামিকাল বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। ৮ তারিখ তাঁর দেশে ফেরার কথা। তার পর মন্ত্রিসভার রদবদলের বিষয়টি বিশদে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে।
কিন্তু যে ‘ঝাঁকুনি’ মনমোহন দিতে চান, শেষ পর্যন্ত তা কি তিনি দিয়ে উঠতে পারবেন? কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, অনেকগুলি সম্ভাব্য রদবদল বিবেচনার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কতগুলি বাস্তবায়িত হবে, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। কারণ, শুধু সরকারের ‘জড়তা’ কাটানো নয়, আরও বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্ক মাথায় রাখতে হবে।
পি চিদম্বরমকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে সরানোর একটা প্রস্তাব কংগ্রেসের ভিতরে রয়েছে। একটা প্রস্তাব হল, তাঁকে বিদেশ মন্ত্রকে নিয়ে যাওয়া হোক। বিদেশমন্ত্রী পদ থেকে এস এম কৃষ্ণকে সরানোর দাবিও বহু দিনের। কিন্তু এই প্রস্তাবে আপত্তি করছেন খোদ মনমোহনই। কারণ, আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী। কৃষ্ণ বিদেশ মন্ত্রকে থাকলে তাঁর পক্ষে যে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব, চিদম্বরম এলে তা হবে না।
এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা গুলাম নবি আজাদকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। আবার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা নয়-ছয়ের একটি অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে রাজস্ব গোয়েন্দা দফতর। সেই দুর্নীতির সঙ্গে আনন্দ শর্মার জড়িত থাকার অভিযোগও উঠেছে কোনও কোনও মহল থেকে। ফলে তাঁর দাবি খানিকটা হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দলীয় পদ থেকে জনার্দন দ্বিবেদীকে সরকারি পদে আনার চিন্তা রয়েছে। তাঁর জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কথা প্রাথমিক ভাবে ভাবা হচ্ছে। এই মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা অম্বিকা সোনি অন্য কোনও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মন্ত্রকে যেতে চান। মহিলাদের কেন তথ্য-সম্প্রচার বা সামাজিক ন্যায়ের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকে আটকে রাখা হবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। কিন্তু ঘটনা হল, জনার্দনের আগ্রহ আবার মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। যদিও কপিল সিব্বলকে ওই মন্ত্রকে রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী মনমোহন নিজে।
টু-জি কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে এ রাজার পদত্যাগের পর সিব্বলের হাতে টেলি যোগাযোগ মন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই মন্ত্রকটি পাকাপাকি ভাবে ডিএমকে-র হাত থেকে নিয়ে সলমন খুরশিদকে দিতে চায় কংগ্রেস। কিন্তু করুণানিধি বেঁকে বসেছেন। ডিএমকে নেতৃত্বের বক্তব্য, রেল মন্ত্রক তৃণমূলের হাতে রাখার দাবি যদি মানা হয়, তা হলে তাদের দাবিই বা মানা হবে না কেন। এ নিয়ে করুণানিধির সঙ্গে কথা বলবেন মনমোহন।
ফলে এটা স্পষ্ট যে, মন্ত্রিসভার রদবদলের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল আকার নিয়েছে। ভারসাম্যের সামান্য ঘাটতি হলেই হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই আগামী কয়েক দিন সেই জট খোলার কাজেই ব্যস্ত থাকবেন সনিয়া-মনমোহন। |
|
|
|
|
|