|
|
|
|
রাজ্যসভার নির্বাচন |
শরিক ভেঙে মমতা চান সিপিএমের পথ আটকাতে |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
বাম শরিকদের থেকে সিপিএমকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করার যে কৌশল তিনি ইতিমধ্যেই শুরু করেছেন, রাজ্যসভার আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তৃণমূল নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নবতম লক্ষ্য, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লকের মতো বাম দলগুলির ভোট বড় শরিকের থেকে ‘আালাদা’ করে এক জন মাত্র সিপিএম সাংসদেরও রাজ্যসভায় যাওয়ার পথ বন্ধ করতে!
আগামী ২২ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের যে ৬টি রাজ্যসভা আসনে নির্বাচন, তার মধ্যে বিধানসভায় বর্তমান শক্তির নিরিখে এক জন প্রার্থীকেই জেতাতে পারবে সিপিএম। কিন্তু সেই জয় ‘নিশ্চিত’ করতে গেলেও শরিক দলগুলির সমর্থন নিতে হবে তাদের। এখানেই ‘বিভাজনের কৌশল’ প্রয়োগ করতে চাইছেন মমতা। তিনি ভাবছেন, আরএসপি এবং ফ ব-র মতো শরিক দলের বিধায়কদের সিপিএমকে ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারলে আলিমুদ্দিনের এক জন প্রতিনিধিরও রাজ্যসভায় যাওয়া ভেস্তে দেওয়া যায়! সে ক্ষেত্রে ওই দুই শরিকের এক জন ‘জোট প্রার্থী’কে তৃণমূল তাদের বাড়তি ভোট দিয়ে সাহায্য করতে পারে এমন বিকল্প প্রস্তাবের কথাও ওই দু’দলের জন্য খোলা রাখছেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু গোটা বিষয়টি এত ‘সম্ভাবনার অঙ্ক’, যদি-কিন্তু এবং পাটিগণিতের জটিলতার উপরে নির্ভরশীল যে, তার বাস্তবে প্রয়োগ ‘দুরূহ’ বলেই মনে করছে বাম শিবির। দুই শরিক দলের নেতৃত্ব এই সম্ভাবনাকে ‘তৃণমূল নেত্রীর কল্পনা’ আখ্যা দিয়ে উড়িয়েই দিচ্ছেন।
প্রকৃতপক্ষে, লোকসভার পরে এখন রাজ্যসভাতেও সিপিএমকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে নারাজ মমতা। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি জানিয়েছেন, যে ভাবে লোকসভায় সিপিএমের সংখ্যা গত বারের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, সে অবস্থা যাতে রাজ্যসভাতেও হয়, তার জন্য ‘সক্রিয়’ থাকবে তৃণমূল শিবির। তা ছাড়া, ৩৪ বছর পরে যদি সামগ্রিক ভাবে বাম শিবিরকেই ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যায়, রাজনৈতিক ভাবে তার থেকে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে তৃণমূলের জন্য! দলের এক নেতার কথায়, “এতে বামফ্রন্টের মেরুদণ্ডই ভেঙে যেতে পারে!” পক্ষান্তরে, বাম শরিক মহলের বক্তব্য, সিপিএমকে ভোট না-দিয়ে তৃণমূলকে সমর্থন বা তাদের সমর্থনে নিজেদের সাংসদকে রাজ্যসভায় পাঠানো বামফ্রন্ট ভেঙে দেওয়ারই সামিল। মমতা চাইলেও সেই সম্ভাবনা দূর অস্ত। তা ছাড়া, রাজ্যসভার ভোটের ব্যালট এখন প্রয়োজনে পোলিং এজেন্টকে দেখাতে হয়। গোপন ব্যালটের ফায়দা নিয়ে অতীতে কংগ্রেসের হাইকম্যান্ড মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ন্ত ভট্টাচার্য যে ভাবে রাজ্যসভায় গিয়েছিলেন, এখন সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সিপিএমের এক বিধায়কের মৃত্যু হওয়ায় এখন রাজ্যসভায় এক জন সাংসদকে জেতাতে রাজ্য বিধানসভায় প্রথম পছন্দের ৪১.৮৫ ভোট দরকার। অর্থাৎ সহজ অঙ্কে ৪২ জন বিধায়কের ভোট লাগবে। এখন সিপিএমের বিধায়ক-সংখ্যা ৩৯। ফলে, রাজ্যসভায় দলের এক জন সাংসদ পাঠাতে শরিকদের সাহায্য দরকার পড়বেই তাদের। তাই মমতা চান, আরএসপি, ফ ব-র বিধায়কেরা সিপিএমকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। সে ক্ষেত্রে বাম শরিক দলগুলির কাছে মমতার বিকল্প প্রস্তাব, প্রয়োজনে আরএসপি এবং ফ ব-র এক জন ‘জোট প্রার্থী’কে তৃণমূল বাড়তি ভোট দিয়ে সাহায্য করবে। তৃণমূল সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই আরএসপি, ফ ব শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে এক প্রস্ত আলোচনা হয়েছে।
পক্ষান্তরে, আরএসপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “পুরোটাই মমতার কল্পনা! বামফ্রন্টের এক জন প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করেও বামেদের হাতে ১৯টি প্রথম পছন্দের ভোট থাকবে। তার ভিত্তিতে দ্বিতীয় এক জন প্রার্থী রেখে দিয়ে বিরোধী শিবিরে ভাঙন ধরানো যায় কি না, এ বার আমরা বরং সেটা ভেবে দেখব!” ফ ব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “মমতা চেষ্টা করতেই পারেন। তর্কের খাতিরে ওই প্রস্তাবটিই যদি ধরে নেওয়া হয়, তাতেও সমস্যা আছে। প্রথমত, তৃণমূলের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য বামফ্রন্ট ভাঙা অর্থহীন। দ্বিতীয়ত, আরএসপি এবং ফ ব-র মধ্যে কোনও একটি দলের যদি প্রার্থী হয়, তা হলে অন্য দল বলবে, অন্যের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য তারা বামফ্রন্টে বিশ্বাসঘাতকতার ঝুঁকি নেবে কেন? তার চেয়ে ফ্রন্টের মধ্যে ঘুরে-ফিরে শরিকদের সাংসদ করানোর চেষ্টা করা ভাল। ২০১২ এবং ২০১৪ সালে আরও তো রাজ্যসভার নির্বাচন আছে।”
তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, এই মুহূর্তে তৃণমূলের যা বিধায়ক-সংখ্যা (১৮৪), তাতে ৪ জন রাজ্যসভার প্রার্থীকে প্রথম পছন্দের ভোট দেওয়ার পরেও ১৬টি ভোট হাতে থাকবে মমতার। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব তাই মনে করছেন, তাঁদের হারানোর তো কিছু নেই, সে ক্ষেত্রে সিপিএম প্রার্থীকে হারানোর চেষ্টা করতে অসুবিধা কোথায়? তার জন্য বাম শরিকদের ‘সাহায্য’ প্রয়োজন। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সিপিএমের সঙ্গে শরিক দলগুলির ‘দূরত্ব’ তৈরি করতে পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছেন মমতা। আরএসপি নেতা তথা প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর স্ত্রী সুনন্দা মুখোপাধ্যায়কে ইতিমধ্যেই রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বাম শিবিরের আবার পাল্টা যুক্তি, সুনন্দাদেবীর চেয়ারপার্সন হওয়া নিয়ে আরএসপি যে হেতু প্রবল ‘অস্বস্তি’তে পড়েছে, তৃণমূলের থেকে ‘দূরত্ব’ রাখতে তারা বরং ‘বাড়তি সতর্ক’ থাকবে! এ ছাড়া, রাজ্যে শিল্পায়নের প্রশ্নে সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত বর্ষীয়ান নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
কিন্তু তৃণমূলের এই কৌশলে কী আদৌ সিপিএমের এক জন প্রার্থীর রাজ্যসভায় যাওয়া বানচাল হবে? মমতা নিজেও বিলক্ষণ জানেন, বিষয়টি অত সহজ নয়। কেননা, ৪২টি প্রথম পছন্দের ভোটের মধ্যে ধরেই নেওয়া যায়, সিপিএম প্রার্থী দলীয় বিধায়কদের মোট ৩৯টি ভোট পাবেনই। এ ছাড়া, সিপিআইয়ের দু’টি ভোটও সিপিএম প্রার্থী পাবেন বলেই বাম শিবিরের বক্তব্য। বাকি রইল একটি ভোট। আরএসপি বা ফ ব-র মতো শরিকেরা যদি মমতার ‘ইচ্ছামতো’ সিপিএম প্রার্থীকে ভোট না-ও দেন, সে ক্ষেত্রে সমাজবাদী পার্টি, ডিএসপি বা নির্দল প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় একটি ভোট জোগাড় করে নেওয়া যাবে বলে মনে করছে সিপিএম শিবির।
পাশাপাশি এই প্রশ্নও থাকছে যে, আরএসপি-র ৭ এবং ফ ব-র ১১ এই মোট ১৮ টি ভোটের ভরসায় যদি দু’টি দল ঐকমত্যের ভিত্তিতে এক জন প্রার্থী দেয়, সে ক্ষেত্রেও ওই প্রার্থীকে জেতাতে বহু পরিশ্রম করতে হবে। তৃণমূলের হাতে-থাকা অতিরিক্ত ১৬টি ভোট ধরলে ওই প্রার্থী পাবেন ৩৪টি ভোট। সিপিএম তাদের ৩৯টি ভোট পাবেই ধরে নিয়ে তাদের টপকাতে আরও ৬টি ভোট ওই প্রার্থীর দরকার। সে ক্ষেত্রে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার তিন, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ সমর্থিত এক জন নির্দল এবং কংগ্রেসের একাংশের সমর্থনে বিধানসভায় জেতা এক নির্দল বিধায়ক, এই পাঁচটি ভোট ধরলে ওই প্রার্থীর ঝুলিতে আসবে ৩৯টি ভোট। অর্থাৎ সিপিএমের সঙ্গে ‘টাই’! তা হলে তাঁকে জেতাতে ছোট বাম শরিকদের ভোট দরকার হবে। অথবা এসইউসি-র সমর্থন লাগবে। কারণ, কংগ্রেসের ৪২ জন বিধায়ক তাঁদের এক জন প্রার্থীকেই জেতাবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। অর্থাৎ শুধু তৃণমূলের ভোটে ওই প্রস্তাবিত ‘বিকল্প প্রার্থী’র জয় অঙ্কে সম্ভব হচ্ছে না।
সেই জন্যই এক ফ্রন্ট নেতার প্রশ্ন, “মমতা চাইলেও এতগুলো দলকে একসঙ্গে নিজের পক্ষে আনা কি সম্ভব?” |
|
|
|
|
|