|
|
|
|
|
|
কী পড়ছ, কেন পড়ছ... |
নিজের বিষয় বেছে নেওয়ার সময় |
এক-একটা বিষয় নিয়ে পড়তে শুরু করা যেন এক-একটা নতুন দেশে বসবাস শুরু করার মতো, তাই না? কিন্তু,
থাকতে শুরুর আগে দেশটাকে তো একটু জেনে নিতে হবে! তোমরা যে যা বিষয় বেছে নিচ্ছ, সেগুলো কী ও
কেন, তিনটি সংখ্যা জুড়ে আলোচনা করছে প্রস্তুতি। দ্বিতীয় পর্বে চারটি বিষয়। |
|
ইংরেজি
দেবলীনা বন্দ্যোপাধ্যায়,
শিক্ষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
|
অনেক ছাত্রছাত্রীই উচ্চ মাধ্যমিকের পর স্নাতকস্তরে এই বিষয়টি নিয়ে পড়তে চায়। তবে মনে রাখা দরকার দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত ইংরেজি বলতে যে ধরনের পঠনপাঠন ছেলেমেয়েরা করে আসে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের ইংরেজি তার থেকে অনেকটাই আলাদা। তাই ‘ইংরেজি নিয়ে পড়ছি’ বলার জন্য ইংরেজি পড়া উচিত নয়। ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে সত্যিই গভীর ভাবে ঢুকতে চাও কি না, সেটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বিষয়টা পড়তে গিয়ে যদি তোমার ভাল না লাগে তখন সেটার সঙ্গে তুমি একাত্ম হতে পারবে না। যে কোনও ভাষারই নিজস্ব একটা মাধুর্য থাকে। সৌন্দর্য থাকে। সেটা বুঝতে হয়। তবেই বিষয়টা তোমার কাছে ধরা দেবে। বিষয়টাকে যদি তুমি বুঝতেই না পারলে, বা ভালবাসতেই না পারলে, তা হলে ভবিষ্যতে যে পেশাতেই যাও না কেন, বেশি দূর এগোতে পারবে না। হয়তো সকলের জন্যই কোনও না কোনও কেরিয়ার পথ ঠিকই বেরিয়ে যায়, তবে যারা ইংরেজিকে ভালবেসে পড়তে আসে তাদের পক্ষে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করা কঠিন কাজ নয়।
কী ধরনের চাকরি? সাংবাদিকতা, সংবাদপাঠ, সঞ্চালনা, সম্পাদনা, জনসংযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলিতে ইংরেজির স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ছেলেমেয়েদের প্রচুর সুযোগ। ব্যাঙ্ক এবং বিমা ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসিং এবং যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা দু’ভাবেই ইংরেজির ছাত্র-ছাত্রীরা সুযোগ পাচ্ছে। সর্ব ক্ষেত্রে, ইংরেজির অপরিহার্যতার জন্য নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে, যেমন কর্পোরেট কমিউনিকেশন, বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থায় ইংরেজির প্রয়োগ শিক্ষণ, বাণিজ্যিক সংস্থায় কনটেন্ট রাইটিং এবং বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক বিশ্লেষণ। বিনোদন-জগৎ দরজা খুলে দিয়েছে ইংরেজির লোকদের জন্য সিনেমার পরিচালনা, সম্পাদনা, সিনেমাটোগ্রাফি, স্ক্রিপ্ট লিখন, অভিনয়, ফিল্ম রিভিউ, গ্রাফিক ডিজাইন, ফ্যাশন শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগের সম্ভাবনা রয়েছে বিজ্ঞাপন জগৎ, বিপিও, এনজিও সংস্থা ইত্যাদি। ইচ্ছুক এবং উদ্যোগীদের জন্য সুযোগ রয়েছে লাইব্রেরি সায়েন্স এবং অ্যাপ্লায়েড আর্টসে। রাজ্য এবং কেন্দ্রের বিভিন্ন রকম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ইংরেজির ছাত্র-ছাত্রীদের। যদি কেউ এমবিএ করতে চাও, এই বিষয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করলে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাও বেশ উজ্জ্বল।
সর্বোপরি রয়েছে শিক্ষাজগতের সুযোগ। যাঁরা শিক্ষকতা করতে চান ইংরেজি সাহিত্যে এবং বিভিন্ন এমবিএ কলেজে, যোগ্যতার নিরিখে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা তো দেশ-বিদেশে হচ্ছেই। গবেষণার কত রকম বিষয় ইংরেজি সাহিত্য, অন্যান্য ভাষার সাহিত্য, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, নিউরো লিঙ্গুয়িস্টিক্স, আর্ট এবং আর্কিটেকচার, জেন্ডার, শিশুসাহিত্য, কল্পসাহিত্য, থিয়োলজি, দলিত সাহিত্য, কালচার স্টাডি ইত্যাদি।
|
|
অর্থনীতি
সুগত মারজিৎ,
অধিকর্তা, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস
|
স্কুল পাশ করে অনেক ছাত্র-ছাত্রী অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হবে। তাদের অনেকের কাছেই বিষয়টি নতুন। অনেকে আবার স্কুলে খানিকটা অর্থনীতি পড়ে এসেছে। বলে রাখা ভাল যে, এই দ্বিতীয় দলকেও কিন্তু নতুন করে অর্থনীতি শিখতে হবে; কারণ স্কুল স্তরে বিষয়টির ঠিকঠাক পঠন-পাঠন হয় না।
কিন্তু সবার আগে প্রশ্ন: অর্থনীতি বিষয় হিসেবে আসলে কী নিয়ে আলোচনা করে, আর কেনই বা করে? অর্থনীতি মানুষের তথা সমাজের অর্থনৈতিক বিজ্ঞান, সে কারণেই অনেকে একে ‘ইকনমিক সায়েন্স’ বলেন। মানুষ, বা কোনও কোম্পানি, বা কোনও সরকার কী ভাবে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নির্ধারণ করে, কার্যকর করে, তার থেকে দশের বা দেশের কী লাভ, কী ভাবে মাপতে হবে লাভ-লোকসানের বহর, মানুষের দারিদ্র ঘুচবে কী ভাবে সব নিয়েই অর্থনীতির শিক্ষা।
কিন্তু আরও গভীরতর অর্থে অর্থনীতির শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রীদের চিরজীবনের মূলধন, সমাজ ও ব্যক্তিকে দেখার, বোঝার, বিশ্লেষণ করার শিক্ষা। সমাজে প্রতিনিয়ত যে সব ঘটনা ঘটে, সে ক্রীড়াক্ষেত্র, অপরাধজগৎ, রাজনীতি যে কোনও ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সব কাজের পেছনে একটা লাভ-ক্ষতির যুক্তি লুকিয়ে থাকে। লাভ-ক্ষতির অঙ্ক। তাই অঙ্কের সঙ্গে অর্থনীতির এত গভীর সম্পর্ক। অঙ্ক মানুষকে যুক্তির বাঁধনে বেঁধে রাখতে সাহায্য করে, যাতে দিশেহারা না হতে হয় অথবা ‘এও হতে পারে তাও হতে পারে’ এমন অনিশ্চিতিতে যাতে না ঘুরে বেড়াতে হয়। যুক্তি দিয়ে লাভ-ক্ষতির হিসেব করে সংঘটিত হয় ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ কর্মকাণ্ড। আর সেই লাভ-ক্ষতির পেছনে কোনও-না-কোনও ধরনের রসদের অভাব কাজ করে। কারণ, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা-চাহিদা অনেক; কিন্তু যা দিয়ে তা মিটবে, সেই রসদের জোগান সীমিত। সীমিত রসদ আর লাভ-ক্ষতির হিসেব এই দুইয়ের মেলবন্ধনের বিজ্ঞানের নাম অর্থনীতি। যারা অর্থনীতি পড়বে, তারা যে শুধু অর্থনীতির বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে জ্ঞানচর্চা করবে তা নয়, অর্থনীতির নজর দিয়ে বৃহত্তর সমাজ, পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করার হাতিয়ারও পাবে।
মজা করে বলা যায় যে, শেয়ার বাজারের ওঠানামা বা বাজারে দাম নির্ধারণের তত্ত্ব নিয়ে যেমন আলোচনা থাকবে, তেমনই ‘বিয়ের’ বাজারের বৈজ্ঞানিক আলোচনাও হতে পারে অর্থনীতির আর একটি বিষয়। অপরাধমূলক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে বেশি পুলিশ প্রয়োজন, না পুলিশের মাইনে বাড়ানো প্রয়োজন, কিংবা অপরাধ করলে বেশি-বেশি শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন এ সব নিয়েও প্রচুর গবেষণাও হয়। আর সর্বত্র ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক পদ্ধতি।
এ বার প্রশ্ন হল, অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে কী করতে পারো? আমি তো উল্টে বলব, কী করতে পারো না? প্রথমত, এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণার সুযোগ প্রচুর, দেশে ও বিদেশে বিস্তর স্কলারশিপ। যারা শিক্ষকতা করতে চাও, তাদের পক্ষে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই একটি বিষয়ে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় (এবং স্কুল) মিলিয়ে শিক্ষকের পদও বিস্তর। তবে যত দিন যাচ্ছে, কর্পোরেট সেক্টরে অর্থনীতির পড়ুয়াদের দর বেড়েই চলেছে। ব্যাঙ্ক বা বিমার মতো আর্থিক সংস্থা, শেয়ার বাজারের সঙ্গে জড়িত নানান প্রতিষ্ঠানে তো বটেই, প্রায় যে কোনও বড় কোম্পানিতেই অর্থনীতি-জানা কর্মীর খুব কদর। ইদানীং পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনে সাংবাদিকতার চাকরিতেও অর্থনীতির চাহিদা প্রবল, সেটা কেবল সরাসরি ব্যবসা বা অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে লেখালিখির জন্যই নয়, সাধারণ ভাবেও, কারণ অর্থনীতি জানা থাকলে দুনিয়াটাকে বোঝার সুবিধা হয়, আর সাংবাদিকের প্রধান দায়িত্বই হল দুনিয়াটাকে বোঝা এবং বোঝানো। এ ছাড়া, সরকারি চাকরি তো আছেই।
|
রাষ্ট্রবিজ্ঞান
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়,
শিক্ষক, বঙ্গবাসী কলেজ
|
অনেকেই জানতে চান রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে কী হবে? রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেহেতু স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় না, তাই কেউ কেউ বলেন, ‘ওটা তো আর স্কুল সাবজেক্ট নয়!’ এখন কারও জীবনের একমাত্র লক্ষ্য যদি হয় স্কুলে নীচু শ্রেণিতে পড়ানো, অবশ্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞান তাঁর বিষয় হওয়া উচিত নয়। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর ক্ষেত্রে যদি কেউ শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা করে, জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া তার আটকাবে না।
প্রথমত, অ্যাকাডেমিক লাইন তো খোলা আছেই। স্নাতকোত্তর স্তরে ৫৫ শতাংশ নম্বর এবং নেট/সেট পাশ করলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। কেউ যদি না পড়িয়ে শুধুমাত্র গবেষণা করতে চায়, তবে তার সুযোগও ক্রমবর্ধমান। এমনিতেই ইউ জি সি-র ফেলোশিপ নিয়ে যে-কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করা সম্ভব। গবেষণার বিষয় নানাবিধ হতে পারে। সমাজবিজ্ঞানে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে প্রথাগত প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক বিষয়ের বাইরে ইন্টারডিসিপ্লিনারি ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটছে। সাধারণ ভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাজনৈতিক দর্শন, তুলনামূলক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হলেও, জনসাধারণ, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি নানাবিধ ক্ষেত্রে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। এ ছাড়াও মানবাধিকার, লিঙ্গবৈষম্য বা সেফোলজি-র মতো আকর্ষণীয় বিষয় চর্চার মাধ্যমে গবেষকদের চিন্তা ও কাজের পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হতে পারে। সাধারণত একটি গবেষণা আরও পাঁচটির সুযোগ ও পরিধিকে বিস্তৃত করে, নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়, কাজের সুযোগও বাড়ে।
ধরা যাক, নির্বাচন প্রক্রিয়ার কোনও একটি পর্যায় নিয়ে কেউ সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলীর একটি অংশের প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা করতে চান। জানতে চান সাধারণের আচরণগত বৈশিষ্ট্য। সে ক্ষেত্রে নিজ গবেষণার পরিধি বাড়ালে অচিরেই তিনি এক জন ভোট-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন। এখন মিডিয়া প্রতিযোগিতার কালে তাঁর চাহিদা তখন বাড়তে পারে। এর জন্য গবেষককে অবশ্যই নিয়মিত লেখালেখি চালিয়ে যেতে হবে, নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু এক বার প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর পিছনে ফিরে তাকাতে
হবে না।
অবশ্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা সাংবাদিকতায় এলে সাফল্য পান। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমে প্রতিদিন আমরা যে খবরগুলিকে প্রধান হয়ে উঠতে দেখি বা যেগুলি নিয়ে নিয়মিত চর্চা-বিশ্লেষণ বা সম্পাদকীয় রচনা চলে, তার অধিকাংশই রাজনৈতিক। সে ক্ষেত্রে কেউ যদি স্নাতকস্তর পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করে তার পর সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করেন, তবে তাঁর সাফল্য সুনিশ্চিত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা আইন ব্যবসাতেও অত্যন্ত সফল হন। সারা বিশ্বে লব্ধপ্রতিষ্ঠ যত জন আইনজ্ঞ রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা অর্থনীতির পড়ুয়া। এখন উচ্চ মাধ্যমিকের পর সরাসরি আইন নিয়ে পড়া যায়। কিন্তু কেউ যদি স্নাতকস্তর পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে তার পর আইন পাঠ করেন, তবে আরও দ্রুত বিষয়ে প্রবেশ সম্ভব।
এ ছাড়াও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা বিভিন্ন অ-সরকারি (এনজিও) সংগঠনে কাজ পেতে পারেন। বিশেষত কেউ যদি সোশ্যাল ওয়ার্ক বা মাস্ কমিউনিকেশনের একটা পর্যায় পর্যন্ত পেশাদারি শিক্ষা লাভ করেন তো কথাই নেই। প্রকৃত সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে স্বাধীন গবেষণাকেন্দ্রও গড়ে তোলা সম্ভব। উচ্চশিক্ষায় গবেষণামূলক কাজে যত বেশি অ-সরকারি ক্ষেত্রের প্রসার ঘটবে, ততই গবেষকের স্বাধীনতা ও সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। আর, রাজ্য বা সর্বভারতীয় (পি এস সি বা ইউ পি এস সি) প্রশাসনিক পরীক্ষা তো আছেই। এগুলিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা সর্বদাই এগিয়ে থাকেন।
সবশেষে বলি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য পড়ে আছে রাজনীতির প্রাঙ্গণ। এক জন যুবনেতা (তিনিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র) ‘নেতা হোন, নেতা বানান’ স্লোগান দিয়ে সারা দেশে আলোড়ন তুলেছেন। তাঁর দলে না গেলেও ‘নেতা’ হতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারাই যে এগিয়ে থাকবেন, তা বলাই বাহুল্য।
|
|
সাইকলজি
সৌগত বসু,
শিক্ষক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
|
যারা একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণিতে সাইকলজি বিষয়টা পড়োনি, তারাও কিন্তু স্নাতকস্তরে সাইকলজি নিতেই পারো। তবে মনে রেখো, বিষয়টা সম্পর্কে অনেকেরই একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। মনে করা হয় সাইকলজি মানে মনোরোগের বিদ্যা। না। বরং মনকে জানবার একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হল সাইকলজি। মনোরোগীদের শুশ্রূষাও এর একটি অঙ্গ নিশ্চয়ই, (যেটা পড়ে ক্লিনিক্যাল সাইকলজি-র মধ্যে) কিন্তু তা ছাড়াও সাইকলজি-র আরও অনেক শাখা। যেমন, সোশ্যাল সাইকলজি, এক্সপেরিমেন্টাল সাইকলজি, ডেভেলপমেন্টাল সাইকলজি, অর্গানাইজেশনাল সাইকলজি, এডুকেশনাল সাইকলজি ইত্যাদি। এদের মধ্যে সোশ্যাল সাইকলজি, এক্সপেরিমেন্টাল সাইকলজি-তে মূলত বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করা হয়। তবে বাকি শাখাগুলিরও কিন্তু অ্যাপ্লায়েড ভ্যালু রয়েছে। ধরো, ডেভেলপমেন্টাল সাইকলজি-তে বর্তমানে বিশেষ কাজ হচ্ছে ডেভেলপমেন্টাল ডিস-এবিলিটি নিয়ে। সোশ্যাল সাইকলজি-তে মূলত প্রোপ্যাগান্ডা, প্রেজুডিস, স্টিরিওটাইপ, লিডারশিপ ইত্যাদি নিয়ে কাজকর্ম হয়। একটা উদাহরণ দিই। এ বছর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে। এই নেতৃত্বের পরিবর্তন কেন এল? কী ভাবে এল? যে নেত্রী এখন ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁর মধ্যে কী বৈশিষ্ট্য ছিল যার জন্য জনসাধারণ তাঁকে মনোনীত করল? বা যদি প্রেজুডিস-এর (কুসংস্কার) কথাই ধরি, কেন কুসংস্কার মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়, কেন তা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক, কী ভাবে এই কুসংস্থার থেকে মানুষকে মুক্ত করা যায় এই সব নিয়ে কাজ করা যায় সোশ্যাল সাইকলজিতে। আবার এক্সপেরিমেন্টাল সাইকলজি-র (যার আর এক নাম কগনিটিভ সাইকলজি) মধ্যে বেসিক বিষয়গুলি রয়েছে অর্থাৎ সেনসেশন, পারসেপশন, মেমরি, লানিং ইত্যাদি। এই কগনিটিভ সাইকলজির সঙ্গেই এখন জুড়ে গেছে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন (যেমন আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স), কম্পিউটার সিমুলেশন ইত্যাদি। গবেষণার জন্য দারুণ ক্ষেত্র! অ্যাপ্লায়েড কগনিটিভ সাইকলজির মধ্যে পড়ে নিউরো-সাইকলজি অর্থাৎ মস্তিস্ক বিষয়ক কাজকর্ম। এই যেমন ব্রেন বিহেভিয়র রিলেশনশিপ। এখানে ব্রেন প্যাথোলজি স্টাডি করার হয় এবং এর সঙ্গে ব্যক্তির ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন (বিহেভিয়ারাল চেঞ্জ) হচ্ছে কিনা সেটা দেখা হয়। যদি তা হয় তা হলে তাকে কী ভাবে ‘রিহ্যাবিলিটেট’ করা যাবে সেই সব দিক নিয়ে কাজ হয় নিউরো সাইকলজি-তে। এটা ক্লিনিক্যাল সাইকলজি-র একটা অংশ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
ক্লিনিক্যাল সাইকলজি সম্বন্ধে আমরা কম বেশি কিছু না কিছু জানি। সে ভাবে দেখতে গেলে ক্লিনিক্যাল সাইকলজির একটা বড় অংশই রোগীর শুশ্রূষা, তাদের অ্যাসেসমেন্ট, থেরাপি, রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনবার্সন। এ ছাড়াও ক্লিনিক্যাল সাইকলজিস্টরা কাজ করেন অন্যান্য ক্ষেত্র নিয়ে, যেমন বৈবাহিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা। এই ধরনের সমস্যা যখন মাত্রাতিরিক্ত নয় তখন যে ধরনের কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন হয়, সেটা ক্লিনিক্যাল সাইকলজিস্টরাই করতে পারেন। এদের বলা হয় ক্লিনিক্যাল কাউন্সেলিং সাইকলজিস্ট। তবে একটা কথা। সাইকলজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করলেই কিন্তু ক্লিনিক্যাল সাইকলজিস্ট হওয়া যায় না। ক্লিনিক্যাল সাইকলজিস্ট হিসেবে প্র্যাকটিস করার জন্য ভারত সরকারের রেজিস্ট্রেশন নম্বর চাই। তার জন্য ক্লিনিক্যাল সাইকলজি-র এম ফিল ডিগ্রি লাগে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকলজি-তে দুটো বিভাগ ডিপার্টমেন্ট অব সাইকলজি এবং ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাপ্লায়েড সাইকলজি। রাজ্যের বাইরে ভাল প্রতিষ্ঠানগুলি হল, নিমহান্স বেঙ্গালুরু, রিনপাস রাঁচি, সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব সাইকায়্যাট্রি রাঁচি, দিল্লি ইউনিভার্সিটি, বি আর অম্বেদকর ইউনিভার্সিটি, পুণে ইউনিভার্সিটি, বরোদা এম এস ইউনিভার্সিটি, গাঁধীনগরের ইনস্টিটিউট অব ফরেনসিক সায়েন্সেস, গুরগাঁও-এর ব্রেন রিসার্চ সেন্টার, এলাহাবাদ-এর ইনস্টিটিউট অব কগনিটিভ সায়েন্সেস।
সাইকলজির সঙ্গে অনেক বিষয়ের যোগ। সব থেকে বেশি যোগ বায়োলজিক্যাল সায়েন্স-এর সঙ্গে। তা ছাড়াও আছে ইনফরমেশন-রিলেটেড সায়েন্স, ফিজিক্স, সোশিয়োলজি, ফিজিয়োলজি, অ্যানাটমি, নিউরো-অ্যানাটমির সঙ্গে। আর একটা বিষয় বাদ দিলে চলবে না: স্ট্যাটিসটিক্স। এখন কোয়ান্টিটেটিভ ও কোয়ালিটেটিভ মেথডস্-এর ওপরেও বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে সাইকলজি-তে। আবার, সোশিয়োলজি, অ্যানথ্রপোলজি বিষয়দুটির সঙ্গেও সাইকলজির গভীর যোগ।
এখন যে ভাবে সমাজে মনোরোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে সচেতনতা। ফলে চাকরির ক্ষেত্রে স্কুল, বেসরকারি সংস্থা, এন জি ও এবং হাসপাতালে সাইকলজিস্টদের প্রচুর চাহিদা। বিভিন্ন স্কুলে এখন কাউন্সেলরদের নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া বিষয়টি পড়ে আই এ এস, বি সি এস-এর মতো কম্পিটিটিভ পরীক্ষাও দেওয়া যায়।
সব শেষে বলব, যারা মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসে, কথা বলতে ভালবাসে, মানুষের সমস্যা নিয়ে কাজ করার মানসিকতা আছে তাদের সাইকলজি নিয়ে পড়া উচিত। মানুষের মন এতটাই বিচিত্র যে এখনও অনেক কিছুই উদ্ঘাটন করা বাকি রয়েছে। |
|
|
|
|
|