|
|
|
|
|
ন্যাপথায় শুল্ক তুলে আজ কেন্দ্র
স্বস্তি দিতে পারে হলদিয়াকে
সুপর্ণ পাঠক • কলকাতা |
|
অবশেষে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস-এর উপর থেকে ‘শনির দৃষ্টি’ সরতে শুরু করল। সব কিছু ঠিকঠাক চললে আজ, সোমবারই ন্যাপথার উপর আমদানি শুল্ক তুলে নেবে কেন্দ্রীয় সরকার। পাশাপাশি বিক্রয় করের বাড়তি বোঝা সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সংস্থার দাবিও সক্রিয় ভাবে খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার। এর ফলে সংস্থাটি প্রায় ৭০০ কোটি টাকা করের চাপ থেকে রেহাই পাবে।
মুক্তি পাবে ঋণ করে ঋণ মেটানোর ‘দুষ্টচক্র’ থেকেও।
এই দশকের গোড়ায় চালু হওয়া রাজ্যের ‘শো-পিস’ শিল্প সংস্থা হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস একের পর এক আর্থিক বিপত্তির মধ্য দিয়ে চলেছে। আজ যা পরিস্থিতি, তাতে সংস্থার এক টাকা নগদ আয় হলে প্রায় এক টাকা ৬৬ পয়সা যায় ঋণের বোঝা সামলাতে। ঋণের সেই বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো হঠাৎই পরপর চেপে বসে কেন্দ্র ও রাজ্যের করের দায়।
২০০৬ সালে রাজ্য সরকার সংস্থাটিকে তেল উৎপাদনকারী (মোটর স্পিরিট) সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করায় চেপেছে বিক্রয় করের বোঝা। এর পর পরই ২০০৮-এ কেন্দ্র চাপিয়ে দেয় ন্যাপথার উপর আমদানি শুল্ক। রাজ্যের বিক্রয় কর ও কেন্দ্রের আমদানি শুল্ক বাবদ মোট প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ঋণের বোঝা চেপেছে সংস্থার উপর। ন্যাপথা, যা সংস্থার মূল কাঁচামাল, তার উপর থেকে কর তুলে নেওয়া হলে সংস্থাটি বাঁচাতে পারবে ৩৫০ কোটি টাকার মতো। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই তা প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে আর্জি জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
ন্যাপথার উপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন করা হলে রবিবার কেন্দ্রীয় অর্থসচিব সুনীল মিত্র বলেন, “এখনও নয়।” অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, অর্থসচিব এখন ছুটিতে। সোমবার ছুটি থেকে ফিরলে তাঁর কাছে এই সংক্রান্ত ফাইলটি যাবে এবং তাঁর সিলমোহর মিললেই আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পদ্ধতিটি চূড়ান্ত হবে। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত পাকা। অপেক্ষা শুধু প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার।
এ ব্যাপারে হলদিয়া পেট্রোকেমের শীর্ষ কর্তা পার্থ ভট্টাচার্যকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ দিন বলেন, “আমি সরকারি ভাবে এখনও কিছু জানি না।’’ তবে তিনি বলেন, হলদিয়া পেট্রোকেমই সম্ভবত ন্যাপথা নির্ভর একমাত্র সংস্থা, যাদের উপর এই করের বোঝা রয়েছে। কর প্রত্যাহার করা হলে সংস্থার পক্ষে আর্থিক ভাবে নিশ্বাস ফেলে বাঁচার একটা জায়গা তৈরি হবে। বুধবার দিল্লিতে অর্থসচিবের সঙ্গে পার্থবাবুর বৈঠক হওয়ার কথা। উল্লেখ্য, পূর্বতন রাজ্য সরকারও বহুবার কেন্দ্রের কাছে এই কর মকুবের আবেদন জানিয়েছিল। যদিও তারাই আবার সংস্থার চরিত্র বদল করে বিক্রয় করের বাড়তি বোঝা চাপায় সংস্থার উপর। পার্থবাবু জানান, বিক্রয় করের আওতা থেকে রেহাই মিললে সংস্থার নগদ আয় দৈনন্দিন ঋণ মেটানোর দায়ের থেকে অনেক বেশি হয়ে যাবে। ঋণ করে ঋণ মেটানোর দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পাবে সংস্থা।
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন জানান, হলদিয়ার সমস্যা মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ও তিনি, দু’জনে মিলেই প্রণববাবুর কাছে ন্যাপথার উপর কর মকুবের ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিক্রয় করের বিষয়টিও মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনা হয়েছে। তাঁর দাবি, যে সংস্থার মালিক রাজ্য সরকারও, সেই সংস্থা এই ভাবে দুঃস্থ হয়ে পড়বে তা কখনওই কাঙ্ক্ষিত নয়। মহাকরণ সূত্রের খবর, হলদিয়াকে কী ভাবে বিক্রয় করের আওতা থেকে মুক্তি দেওয়া যায়, তা অর্থ দফতর সক্রিয় ভাবে খতিয়ে দেখছে। কর মকুব হলে বাঁচবে আরও প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে সংস্থার নগদ আয়ের হিসাব দাঁড়াবে ঋণ শোধের দায়ের দেড় গুণ। অর্থাৎ, সংস্থার হাতে কিছু নগদ আসবে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। জন্মলগ্ন থেকেই অর্থ সঙ্কটের রোগী এই শিল্প সংস্থা। যার সূত্রপাত ৯৭৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক ছিল ৫ হাজার ১৭০ কোটি টাকার প্রকল্পে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা আসবে শেয়ার বেচে। বাকি ৩ হাজার ১৯১ কোটি টাকা তোলা হবে ঋণ করে। ১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার মধ্যে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী ও রাজ্য সরকার দেবে ৪৩৩ কোটি টাকা করে, টাটা গোষ্ঠী দেবে ১৪৪ কোটি টাকা। বাকি টাকাটা তোলা হবে বাজারে শেয়ার ছেড়ে। কিন্তু তখন শেয়ার বাজারের মন্দার জেরে সেই পরিকল্পনা শিকেয় তুলে ৩ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার ঋণের সঙ্গে আরও ৯৭৯ কোটি টাকা তুলতে হয়, তা-ও ১৭ শতাংশ সুদে।
এর পরে চ্যাটার্জি গোষ্ঠী কম সুদে বিদেশের বাজার থেকে টাকা তুলে চালু ঋণ শোধ করার প্রস্তাব দিলেও তাতে সহমত হয়নি তৎকালীন রাজ্য সরকার।
পাশাপাশি গোড়াতেই তদানীন্তন রাজ্য সরকার বলেছিল, ৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি বা ১২ বছর, যেটা আগে হবে তার ভিত্তিতে সর্ম্পূণ বিক্রয় কর ছাড় মিলবে। কিন্তু ২০০৬ সালে রাজ্য হঠাৎ হলদিয়াকে তেল প্রস্তুতকারক সংস্থা হিসাবে ঘোষণা করায় সেই ছাড় উঠে যায়। তখনও কিন্তু ১২ বছরের সময়সীমা কিংবা সংস্থার পণ্য বিক্রির পরিমাণের (১৭০০ কোটি টাকা) শর্ত, দুটোই দূর অস্ত্। ফলে কর ছাড়ের হিসেব ধরে সংস্থার আর্থিক পরিকল্পনাও পুরোটাই ভেস্তে যায় ও ঋণের ভার আরও বাড়ে।
সংস্থা সূত্রের খবর, কর মকুব হলে পরের পদক্ষেপ হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে কম সুদে টাকা ধার করে তা দিয়ে বেশি সুদে নেওয়া ঋণ মেটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে হলদিয়া পেট্রোকেম। তা করতে পারলে আর্থিক দায়ে যে ভাবে আধমরা হয়ে পড়েছিল হলদিয়া পেট্রোকেম, তার থেকে তারা রেহাই পাবে।
এই পরিস্থিতিতে দুই করের বোঝা ঘাড় নামলে এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সহযোগিতা মিললে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সমস্যাগুলিকে পাশে রেখে ব্যবসায়িক সাফল্যের পথে হাঁটতে শুরু করতে পারবে রাজ্যের শিল্পায়ন মানচিত্রের অন্যতম শো-পিস এই সংস্থাটি। |
|
|
|
|
|