|
|
|
|
টাটাদের মামলায় ‘লাভ’ই দেখছেন মমতা |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “সিঙ্গুরে রাজ্য সরকার জমির অধিকার পেয়ে গিয়েছে। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিল পাশ হয়েছে। রাজ্যপাল তাতে সই করেছেন। আমি ভোটের সময় অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আজ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাটা আমার রাজনৈতিক কর্তব্য।”
সমগ্র বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে গত কাল মমতা আরও বলেন, “আমি কিন্তু শিল্পবিরোধী নই। সিঙ্গুরে জমি নিয়ে যা হয়েছে, তা একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত মাত্র। অন্য শিল্পগোষ্ঠীকে কিন্তু আমি রাজ্যে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সেই কারণে আমি শিল্পপতিদের নিয়ে সম্মেলনও করেছি।” মমতার দাবি, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন যে, পরিস্থিতিটা তিনি বুঝতে পারছেন। শুধু তা-ই নয়, মনমোহন তাঁকে এ-ও জানিয়েছেন যে, কংগ্রেস গোটা দেশে কোথাও অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি নিয়ে শিল্প গড়তে রাজি নয়। এবং এটাই এখন তার দলীয় লাইন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে গত কাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পরেই মমতা জানতে পারেন যে, টাটারা বুধবার মামলা করতে চলেছে। সে কথা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা রণকৌশল তৈরি করে ফেলেন তিনি। মমতার রাজনৈতিক কৌশল হল, এই মামলার শুনানির মধ্য দিয়ে তাঁর সরকার যে কৃষকদের জন্য ‘বলিপ্রদত্ত’ তা জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করা। টাটারা মামলা করায় তৃণমূলের লাভ বই ক্ষতি নেই বলেই মনে করছেন মমতা। এমনকী ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি এ-ও বলছেন, “আদালতে যদি হেরেও যাই, তা হলেও গ্রামের প্রতিটি কৃষক অন্তত জানবেন যে তাঁদের জমি নিয়ে শিল্পপতিদের সঙ্গে কোনও আপস করিনি।” আজ সিঙ্গুর নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মমতা বলেন, ‘‘বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। তাই আমি কোনও মন্তব্য করব না। তবে মামলা করা যে কারওরই গণতান্ত্রিক অধিকার।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “ওই জমি সরকারের। সরকার বৈধ ভাবে জমির অধিকার লাভ করেছে। কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া সরকারের অগ্রাধিকার। অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।” মমতার বক্তব্য, বাম আমলে পুলিশ ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের লাঠিপেটা করে টাটাদের জমির দখল দিয়েছিল। এখন চাষিরা জমির দখল নিলে পুলিশ আর তা জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে টাটাদের ফেরত দেবে না। আর শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশ যা-ই হোক, এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তাঁর দলের কৃষিভিত্তি আরও সম্প্রসারিত হল বলেই মনে করছেন মমতা।
এর পরে রাজ্যে প্রথম বড় নির্বাচন পঞ্চায়েত ভোট। সেই নির্বাচনে সিঙ্গুরের ঘটনা তৃণমূলকে আরও শক্তিশালী করবে বলে মনে করছেন মমতা। তেভাগা আন্দোলন ও অন্যান্য কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে একদা সিপিএম এই কৃষিভিত্তি অর্জন করেছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম যে সেই ভিত্তি অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে, তা এখন সিপিএম নেতৃত্বও স্বীকার করছেন। আর এই কারণেই সিপিএম-ও কিন্তু সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরত দিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলছে না। তাদের প্রশ্ন পদ্ধতিগত দিক নিয়ে। তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে যে সিঙ্গুরের পর এ বার নন্দীগ্রাম নিয়ে যে মামলা চলছে, সে বিষয়েও যথোচিত ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হবেন মমতা।
টাটা গোষ্ঠী অবশ্য প্রথমে মামলা না-করে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সংস্থার কর্তারা দেখলেন, মমতা আলোচনার কথা বলছেন বটে, কিন্তু সেটা ক্ষতিপূরণ নিয়ে। ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনও আপসে যেতে রাজি নন। মমতা দিল্লি এসেও বারবার খোঁজ নিয়েছেন যে, রাজ্যপাল বিলটিতে সই করলেন কি না। রাজ্যপালের দিল্লি সফরের আগেই যাতে বিলটিতে সই হয়ে যায়, সে জন্যও সক্রিয় ছিলেন তিনি। রাজ্যপাল সই করে দেওয়ার পর তাড়াতাড়ি নোটিস জারি করার জন্য দফায় দফায় মহাকরণে ফোন করেছেন মমতা। টাটা-কর্তারা যখন দেখলেন যে, বুধবার রাতেই সিঙ্গুরের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁরা মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মমতাও সিঙ্গুরে কৃষকদের মিছিল সংগঠিত করার নির্দেশ পাঠিয়ে দেন দলের কাছে। ব্যানার পর্যন্ত আগে থাকতেই তৈরি ছিল, যাতে লেখা, ‘আমাদের জমি আমাদের দাও, টাটা তুমি বাড়ি যাও’।
সাতাত্তর সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে জোতদারদের থেকে জমি কেড়ে নিয়ে ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। তাতেও প্রবল রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। আজ এত বছর পর মমতা সিঙ্গুরের জমি দখলের মধ্যে দিয়ে সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। সিঙ্গুর-নাটকের চূড়ান্ত পরিণতি এখনও অজানা। কিন্তু কৃষিভিত্তি সম্প্রসারণে মমতার রাজনৈতিক অভিমুখ খুব স্পষ্ট। |
|
|
|
|
|