পাঁশকুড়ায় ভাই-বোনের মৃত্যু
বাঁধের ধারে অবৈধ বাড়ি ভেঙেই দুর্ঘটনা
শেষ মুহূর্তে ভাইয়ের সেই সাহায্যের আর্তি কিছুতেই ভুলতে পারছে না মৌসুমী সাহু। হাত বাড়ানোর আগেই হুড়মুড়িয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছিল দোতলা বাড়িটি। চোখের সামনে কাঁসাইয়ের জলে তলিয়ে যাচ্ছিল বোন মৌমিতা (১১) আর ভাই শুভ (৮)। ভয়ার্ত গলায় দিদিকে ডাকছিল শুভ। হাত বাড়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কোনও রকমে প্রাণে বাঁচলেও তাই শোকে মূহ্যমান মৌসুমী। বস্তুত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পাঁশকুড়ার চাঁপাডালি এলাকায় মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার পরে শোকস্তব্ধ চার দিক। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে নদীবাঁধ দখল করে বিপজ্জনক ভাবে বাড়ি তৈরির এই প্রবণতা ও তা বন্ধ করতে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়েও। পাঁশকুড়া পুর এলাকার মধ্যে কাঁসাই নদীর বাঁধ দখল করে মাথা চাড়া দিয়েছে একের পর এক বাড়ি-দোকানঘর-গুমটি। বেপরোয়া এমনই এক নির্মাণের মাসুল দিতে হল স্কুল পড়ুয়া দুই ভাই-বোনকে।
অন্য দিনের মতো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চাঁপাডালি এলাকায় অনিল ধাড়ার দোকান বাড়িতে টিউশনে গিয়েছিল সংলগ্ন জদড়া গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্রী মৌসুমী সাহু ও তার দুই ভাই-বোন। একই গ্রামের আরও দুই বোন গায়ত্রী ও লক্ষ্মী সী-ও ছিল তাদের সঙ্গে। কাঁসাই নদীর বাঁধের ধারে দোতলা ওই পাকা বাড়ির ভিত বলতে ছিল কয়েকটি ইটের থাম। নীচে এক তলায় মুড়ি ভাজার কল। দোতলায় এক কুঠুরির ঘরে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের পড়াতেন চাঁপাডালি হাইস্কুলের পার্শ্বশিক্ষক অনিলবাবু। গত তিন দিন ধরে কাঁসাই নদীর জলস্রোত বেড়ে যাওয়ায় ক্রমেই ডুবে যাচ্ছিল বাড়ির নিচের অংশ। আলগা হচ্ছিল ভিত। তারই জেরে দুর্ঘটনা।
বুধবার সকালেও জগদা গ্রামের পরিবেশ ছিল থমথমে। মৌসুমীর বাবা গোপাল সাউ ও মা নিয়তিদেবীর চোখের জল বাঁধ মানছে না কিছুতেই। বাড়ির ভিতরে খাটে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল মৌসুমী। কান্না ভেজা গলায় মঙ্গলবার রাতের ঘটনার বর্ণনা দিল সে। মৌসুমীর কথায়, “আমরা সবে পড়তে বসেছিলাম। ভাই খাতায় লিখছিল। আচমকা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। কড়কড় করে শব্দ হচ্ছিল। তখনও কিছু বুঝতে পারিনি।” খানিকটা থেমে আত্মস্থ হয়ে ফের বলতে শুরু করে মৌসুমী, “আচমকাই ঘরের মেঝে নীচে নেমে যেতে থাকে। আমি বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। ভাই আমাকে ডাকছিল। আমি হাত বাড়ানোর আগেই হুড়মুড়িয়ে ঘর ভেঙে পড়ে। সবাই জলে পড়ে যাই। স্যার আমাকে কোনও রকমে টেনে তোলে। কিন্তু ভাই আর বোনের মাথায় পুরো ছাউনি পড়ে গিয়েছিল। ওদের তোলা যায়নি। ভাইয়ের সেই ডাক এখনও কানে বাজছে।” ঝুড়ি বুনে টেনেটুনে সংসার চালান গোপালবাবু। এ দিন তিনি বলেন, “ছেলেমেয়েরা পড়তে যাওয়ার পর বাড়িতে ঝুড়ি বুনছিলাম। সন্ধে ৭টা নাগাদ হুড়মুড়িয়ে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ পাই। কেন কী জানে, ছেলেমেয়েদের কথাই মাথায় এসেছিল প্রথমে। ছুটে গিয়ে দেখি বাঁধের সামনে প্রচুর লোকের ভিড়। মৌমিতা আর শুভকে জল থেকে টেনে তুলছিল এলাকারই লোকজন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।”
শিক্ষক অনিলবাবুকে বাড়িতে গিয়েও পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী চম্পা ধাড়া বলেন, “আমার ছেলে-মেয়েও ওখানে পড়তে যায়। গত কাল এক অনুষ্ঠান বাড়িতে যাবে বলে ওরা পড়তে যায়নি। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ।”
কাঁসাইয়ের তীরে অবৈধ নির্মাণ চলছে অনেক দিন ধরেই। বাধা দেওয়ার নেই কেউ। নদীর চরের দিকে যেমন অবৈধ নির্মাণ রয়েছে, তেমনই স্রোতের দিকে বাঁধ ঘেষেও প্রচুর ঘর-বাড়ি রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভেঙে পড়া দোতলা বাড়িটি খুব বেশি পুরনো নয়। অবৈধ নির্মাণের কথা মেনে নিয়ে পাঁশকুড়ার উপপুরপ্রধান কংগ্রেসের আশুতোষ চক্রবর্তী বলেন, “পুরসভা গঠনের অনেক আগে থেকেই এই সব নির্মাণ চলছে। তবে, দুর্ঘটনার পরে মহকুমা প্রশাসনের তরফে অবৈধ বাড়িঘরের তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই মতো আমরা সমীক্ষার কাজ শুরুও করে দিয়েছি।”
এ দিকে, ধীরে ধীরে কাঁসাইয়ের জল কমলেও জলমগ্ন গ্রামগুলির অবস্থা প্রায় একই রয়েছে। তমলুক, পাঁশকুড়া, নন্দকুমার ও ময়না ব্লকের বহু গ্রাম এখনও জলবন্দি। ত্রাণসামগ্রী না মেলার অভিযোগ উঠছে সর্বত্র। সেই সঙ্গে রয়েছে পানীয় জলের জন্য হাহাকার। জেলার পান ও ফুল চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমনের বীজতলাও। শুরু হয়েছে সাপের উপদ্রব। এ দিনই সাপের ছোবল খাওয়ার পরে পাঁশকুড়ার পূর্ব চিল্কা গ্রামের দুই বাসিন্দাকে তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন পরিজনেরা। সরকারি ভাবে নৌকা এসে না পৌঁছনোয় কলায় ভেলায় চাপিয়ে ওই দু’জনকে নিয়ে যেতে হয়েছে রাস্তা পর্যন্ত। জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি মামুদ হোসেন এ দিন পূর্ব চিল্কা গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় মানুষদের অভাব-অভিযোগের কথা শোনেন। তিনি জানান, ২৫টির মতো গ্রাম ডুবেছে। জলবন্দি প্রায় ১০ হাজার পরিবার। সিপিআইয়ের প্রাক্তন বিধায়ক চিত্ত দাস ঠাকুরের অভিযোগ, “পাঁশকুড়ার বানভাসি মানুষদের দুর্দশার কথা শোনার নেই কেউ। সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার এলাকা পরিদর্শনের কথা থাকলেও, তিনি আসেননি। দুর্গতদের ভোগান্তির দিকে নজর নেই প্রশাসন, সরকারের। মিলছে না ত্রাণসামগ্রী।”
First Page Medinipur Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.