|
|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
দুঃখের সাগরেও উঠে এসেছে অমৃত |
সম্প্রতি ‘সিগাল ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস’-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল
সোমনাথ হোড়ের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সোমনাথ হোড় সম্পর্কে ১৯৮৬-তে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীর ভূমিকাস্বরূপ এক লেখায় কে জি সুব্রহ্মণ্যম লিখেছিলেন, ‘গ্রীষ্মের সকালে চারদিক সূর্যালোকে আলোকিত। গাছগুলি ফুলে ভরে গেছে। বাতাসে ছড়িয়ে আছে সেই ফুলের সৌরভ। কিন্তু সোমনাথের সমস্ত অনুভবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে কেবল মানুষের কষ্ট ও দুর্দশা। তাঁর চিত্র, ছাপচিত্র, ড্রয়িং বা ভাস্কর্য, সবেতেই কেবল তারই প্রকাশ। এ কথা ঠিকই সোমনাথ হোড় মানবিক বিপর্যয়কে তাঁর সমস্ত প্রকাশের প্রধান অবলম্বন করে নিয়েছিলেন। এই গভীর দায়বোধ থেকে তাঁর শিল্প কখনও বিচ্যুত হয়নি। মানুষের দুঃখের প্রকৃষ্ট শিল্পরূপ গড়ে তোলাকেই তিনি তাঁর জীবনের ব্রত করে নিয়েছিলেন। দায়বোধের এই শিল্পরূপ তাঁর হাতে এমন এক নান্দনিক উৎকর্ষে পৌঁছেছিল, যা তাঁকে শুধু আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বের আধুনিক শিল্পকলার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সভ্রান্ত এক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। সেই আলোও গভীর মনস্তাত্ত্বিক অন্ধকারে জারিত হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
বিশ্বভারতীর কলাভবনে কিছু দিন আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সোমনাথ হোড়ের (১৯২১-২০০৬) ছাপচিত্র, ড্রয়িং ও পোস্টারের একটি প্রদর্শনী। সেই প্রদর্শনীটিই ‘সিগাল ফাউণ্ডেশন ফর দ্য আর্টস’-এর উদ্যোগে তাঁদের গ্যালারিতে দেখানো হল। ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবু ১৯৫০-এর দশক থেকে তাঁর জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত করা ড্রয়িং ও ছাপচিত্রের এত অজস্র নিদর্শন যা তাঁর শিল্পী-ব্যক্তিত্বকে বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করে। |
|
শিল্পী: সোমনাথ হোড় |
সোমনাথ হোড়ের শিল্পের দর্শন গড়ে উঠেছিল ১৯৪০-এর দশকের সমাজ বাস্তবতা থেকে। তখন শিল্প ছিল তাঁর কাছে রাজনৈতিক দায়বোধেরই বিশেষ একটি প্রকাশ। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে মানুষের নির্বিচার মৃত্যু ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা তাঁর তখনকার তরুণ মনে যে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করে, সেটাই সারা জীবন তাঁর মানবিক চেতনা ও শিল্পীচেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। মন্বন্তরের মৃত্যুর ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে চিত্তপ্রসাদের পরিচয় হয়। চিত্তপ্রসাদ তাঁর জীবনবোধ ও শিল্পভাবনাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেন। ১৯৪০-এর দশকে আমাদের দৃশ্যকলায় সামাজিক দায়বোধের ও বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার যে বিশেষ ধারার বিকাশ ঘটেছিল, এই দুই শিল্পী ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রধান দুই পথিকৃত। চিত্তপ্রসাদ অনেক সময়ই তাঁর ছবিতে দেশীয় লৌকিকের প্রেরণায় সদর্থক সৌন্দর্যের সন্ধান করেছেন। কিন্তু সোমনাথ হোড় ক্ষয়, ক্ষত, শোষণ, মৃত্যু ও বঞ্চনার বাস্তবতাকে কখনও অতিক্রম করতে পারেননি। এই বাস্তবতাই তাঁর শিল্পের ‘রূপ’ নির্ধারণ করেছে। এই তমসাকেই তিনি কখনও কখনও আলোয় রূপান্তরিত করেছেন।
এই প্রদর্শনীতে তাঁর অজস্র কাজের মধ্যে একেবারে রাজনৈতিক প্রচারের আয়োজনে করা বেশ কয়েকটি পোস্টারও ছিল। ইদানীং কালে খুব বেশি দেখা যায়নি বলে, এগুলির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫০-এর দশকে করা স্তালিনের একটি উড-এনগ্রেভিং এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভিয়েতনামের উপরে করা কয়েকটি পোস্টার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সুন্দরকে কেমন করে তিনি করুণায় সঞ্জীবিত করে নিতেন, তার একটি দৃষ্টান্ত ১৯৫৭-তে করা একটি এচিং। তানপুরা নিয়ে সঙ্গীত-নিমগ্না এক মানবীর রূপায়ণ। ‘দুঃখের তিমির’-কে ‘মঙ্গল-আলোক’ করে তোলার অসামান্য দৃষ্টান্ত এটি। ১৯৬২-তে করা নির্মলেন্দু দাসের সংগ্রহের একটি প্রিন্ট কোলাজ। শিরোনাম-‘নাইনথ্ সিম্ফনি’। তমসাকে আলোয় উত্তীর্ণ করার অন্যতম এক দৃষ্টান্ত। আমরা আলোকিত হই তেভাগার কাঠ-খোদাইয়ের ছবিগুলো দেখে। ১৯৭৩-এ এচিং ও অ্যাকোয়াটিন্ট-এ করা মানব-মানবীর তীব্র শরীর-প্রেমের কয়েকটি ছাপচিত্রও মুগ্ধ করে। নানারকম মানবিক অভিজ্ঞতাকেই শিল্পী রূপ দিয়ে গেছেন। কিন্তু দুঃখের মন্থনবেগেই উঠে এসেছে অমৃত। |
|
|
|
|
|