|
|
|
|
নিভৃত অনশনেই প্রাণ দিলেন গঙ্গার ‘যোদ্ধা’ |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
তাঁর শয্যা ঘিরে অসংখ্য সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা, ডাক্তার-নার্স, ভক্ত। উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স-এ ভিআইপি ওয়ার্ডে ফলের রস খেয়ে অনশন ভাঙছেন বাবা রামদেব।
অথচ ওই শয্যা থেকে সামান্য দূরেই মৃত্যুর আরও কাছে চলে যাচ্ছিলেন এক নবীন সাধু। হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমের স্বামী নিগমানন্দ। গঙ্গাকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতেই ১১৪ দিন ধরে অনশন করছিলেন তিনি। কালো টাকা উদ্ধারে রামদেবের ন’দিনের অনশন নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে কারও নজরেই আসেনি ৩৪ বছরের এক সাধুর নীরব লড়াই।
নজর অবশেষে পড়ল। তাঁর মৃত্যুর পরে! ১৩ জুন, সোমবার মৃত্যু হয়েছে নিগমানন্দের। ১৯ ফেব্রুয়ারি অনশন শুরু করেছিলেন তিনি। এক মাস অনশন করার পর তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। তাঁকে ভর্তি করা হয় হিমালয়ান ইনস্টিটিউটে। রাখা হয় আইসিইউ-এ। সেই একই আইসিইউ-এ ভর্তি ছিলেন রামদেবও। ২ মে নিগমানন্দ ‘কোমা’য় চলে যান। সোমবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়।
১১৪ দিন ধরে না খেয়ে কীসের প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন নিগমানন্দ?
গঙ্গার বুক থেকে অবৈধ ভাবে পাথর সংগ্রহ করে ক্রাশারে ভাঙার ব্যবসা গত কয়েক বছর ধরেই উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন অংশে জমে উঠেছে। হরিদ্বারেও একটি সংস্থা গত কয়েক বছর ধরে এই ব্যবসা চালাচ্ছিল রমরমিয়ে। এই সব পাথর ভাঙা কল থেকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দূষণ ছড়ায়। ক্রাশার থেকে যে সূক্ষ্ম ধুলো বাতাসে মেশে, তা থেকে ফুসফুসে বাসা বাধে মারণ ব্যাধি সিলিকোসিস। হরিদ্বারেও এ সবের অন্যথা হয়নি। বাড়তি হিসেবে সেই দূষণে ভয়ঙ্কর ভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল গঙ্গাও। গঙ্গার বুকের উপর রমরমিয়ে চলা ওই সব ক্রাশার বন্ধের দাবি তুলেই অনশনে বসেছিলেন নিগমানন্দ। ওই সব ক্রাশার বন্ধের দাবিতে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাও চলছিল। |

স্বামী নিগমানন্দ |
নিগমানন্দের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই শুরু হয়েছে তোলপাড়। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তো সরাসরিই বলেছেন, “গঙ্গার দূষণ রোধ করার লড়াই চালাতে গিয়ে ওই সাধুর আত্মত্যাগকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে। চার মাস ধরে অনশন চলছে, অথচ সরকার কী ভাবে উদাসীন থাকল? এ আমাদের চরম লজ্জা!” কলকাতার গঙ্গার দূষণ রোধের লড়াইয়ে যিনি নিরলস, সেই পরিবেশ-কর্মী সুভাষ দত্ত-ও বলেন, “এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়?”
কিন্তু প্রশ্নটা শুধু লজ্জার নয়, আতঙ্কেরও। দেশের প্রধানতম নদীটি যে ভাবে দূষণের শিকার হচ্ছে, তাতে তার আয়ু আর কত দিন, সে প্রশ্নটাও বেশ কয়েক বছর ধরে তুলছেন পরিবেশবিদেরা। |
|
উত্তরাখণ্ড সরকার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে যে ভাবে এই নদীর উপর একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার কাজ হাতে নিয়েছে, তাতে গোটা নদীর অস্তিত্বই আগামী দিনে বিপন্ন হবে বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদদের। কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কিছু দিন আগেই এক রিপোর্টে জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই শ্রীনগর (গাড়োয়াল) অঞ্চলে একাধিক জায়গায় গঙ্গার খাত প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। তার উপর আছে গঙ্গার ধার ঘেঁষে ক্রমবর্ধমান জনবসতি ও নাগরিক-দূষণের সমস্যা। পাহাড় থেকে নেমে সমতলে পা রাখার আগেই গঙ্গায় শুরু হয় দূষণ। হরিদ্বারে তা আরও বেশি। তার মধ্যেই ক্রাশারের বিপদ দেখে চুপ করে থাকতে পারেননি নিগমানন্দ।
কিন্তু তাঁর মৃত্যু ঘিরে পরিবেশবিদদের আতঙ্ককে ছাপিয়ে গিয়েছে রাজনীতির দড়ি টানাটানি। নবীন এই সাধুর মৃত্যুকে হাতিয়ার করে বিজেপি-বিরোধী সুর চড়িয়েছে কংগ্রেস। একই সঙ্গে রামদেবকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি দলের নেতারা। এআইসিসি সাধারণ সম্পাদক জনার্দন দ্বিবেদী বলেন, “বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রী, যিনি কথায় কথায় গঙ্গার নামে শপথ করেন, গঙ্গা বাঁচানোর জন্য নিগমানন্দের অনশনের দিকে তিনি নজরই দেননি! মেতে ছিলেন অন্য এক ‘রাজনৈতিক খেলা’য়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং দুঃখের।” রামদেব এবং আন্না হাজারের অনশনের ঘটনায়
বিজেপি তাদের বিরুদ্ধে যে আক্রমণ শানিয়েছে, সেটাই আজ ফিরিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। জনার্দন বলেন, “নিগমানন্দ এবং রামদেবের চিকিৎসা হচ্ছিল একই হাসপাতালে। ওই সাধুর অনশনের খবর থাকলেও নিগমানন্দের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থাই নেয়নি।”
নিগমানন্দের মৃত্যু স্বাভাবিক নয় বলে অভিযোগ তুলেছেন মাতৃসদনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান স্বামী শিবানন্দ। তাঁর অভিযোগ, বিষপ্রয়োগে মারা হয়েছে নিগমানন্দকে। ১১ মে হরিদ্বার জেলা হাসপাতালের চিফ মেডিক্যাল সুপার পি কে ভাটনগর এবং ওই ক্রাশার সংস্থা, হিমালয়ান স্টোন ক্রাশার-এর মালিক গণেশ কুমারের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করেন তিনি। শিবানন্দের অভিযোগ, স্বামী নিগমানন্দকে হরিদ্বার জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩০ এপ্রিল নার্স তাঁকে একটি ইঞ্জেকশন দেন। তার পরই কোমায় চলে যান তিনি। নিয়ে যাওয়া হয় হিমালয়ান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। নিগমানন্দের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অন্য কথা বলছে। দেরাদুনের চিফ মেডিক্যাল অফিসার আর কে পন্থ জানান, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ সেপ্টিসেমিয়া ও ‘ডিজেনারেটিভ ব্রেন ডিজঅর্ডার’। উত্তরাখণ্ড সরকার রাতে জানিয়েছে, নিগমানন্দের মৃত্যুর কারণ জানতে তদন্ত করবে সিআইডি।
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। কিন্তু এ সবে আসল অভিযোগগুলোই হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা। গঙ্গার বিপদ কতটা কমবে, তা নিয়ে চিন্তা রয়েই যাচ্ছে। সুভাষ দত্ত যেমন বলেন, “এই মৃত্যু গঙ্গার মরণযাত্রার অশুভ সূচনা। এটা তারই ইঙ্গিত।”
সত্যিই কি তা-ই? |
|
|
 |
|
|