|
|
|
|
পুনর্মিলন এখনই নয়, বলছে দুই কমিউনিস্ট পার্টি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
ধারাবাহিক নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে সিপিএম ও সিপিআইয়ের পুনর্মিলনের দাবি যে নতুন করে উঠেছে, তা দুই দলই মানছে। কিন্তু বাস্তবে তা এখনই সম্ভব নয় বলে মনে করছেন দু’দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর এক ধাক্কায় সংসদে বামেদের শক্তি কমে এসেছিল। এ বার পশ্চিমবঙ্গ-কেরলে একই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে যখন বামেদের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে, তখন বাম সমর্থকরা চাইছেন, দুই দলের নেতারা ফের পুনর্মিলনের কথা ভেবে দেখুন। সেই বার্তা পেয়েই সীতারাম ইয়েচুরি ও ডি রাজার মতো নেতারা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য ইয়েচুরি বলেছেন, “আমাদের শুভানুধ্যায়ীরা চাইছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিপিএম ও সিপিআই মিশে যাক।” আর সিপিআইয়ের নেতা ডি রাজার বক্তব্য, “পুনর্মিলনের একটা আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। দু’দলে কর্মসূচি ছাড়া আর কোনও পার্থক্য নেই। জাতীয় স্তরে আমরা এক সঙ্গেই কাজ করছি।”
কিন্তু বাস্তবে এই পুনর্মিলন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে দুই দলেই ভিন্নমত রয়েছে। সিপিএম-সিপিআইয়ের অনেক নেতাই মনে করেন, ঐতিহাসিক কারণের সঙ্গে এখনও অনেক আদর্শগত বিরোধ রয়ে গিয়েছে। এমনকী পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী বিপর্যয়ের ফলাফল ও পরবর্তী পদক্ষেপও দু’দল দু’ভাবে বিশ্লেষণ করেছে। সিপিএম যেখানে রাজ্যে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতার কথা বলছে, সেখানে সিপিআই আঙুল তুলেছে সিপিএমের ‘ভুল নীতি ও ঔদ্ধত্যের’ দিকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বামেদের ‘নিজেদের বদলাতে হবে’ বলে রায় দিয়েছেন সিপিআই-প্রধান এ বি বর্ধন। কিন্তু সিপিএম বলছে, বুর্জোয়া শক্তির উদ্দেশ্যই হচ্ছে বামেদের ‘সংশোধনের পথে নিয়ে যাওয়া’। তা হতে দেওয়া যাবে না। এ ছাড়াও নতুন রাজ্য গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে এখনও দুই দল দুই মেরুতে রয়েছে।
সিপিআই ভেঙেই ১৯৬৪ সালে সিপিএমের জন্ম। রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ণয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিনের সঙ্গে সম্পর্ক, ইত্যাদি নিয়ে সিপিআইয়ের তৎকালীন কাণ্ডারী শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের সঙ্গে বি টি রণদিভেদের বিরোধ তৈরি হয়। দল ভেঙে বেরিয়ে এসে ‘চিন-পন্থী’ রণদিভেরা সিপিএম তৈরি করেন এবং ‘জণগণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর কথা বলেন। উল্টো দিকে ‘সোভিয়েত-পন্থী’ ডাঙ্গেরা ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর কথা বলে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতার পথ নেন। পুনর্মিলনপন্থীরা বলছেন, সেভিয়েত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় চিন-সোভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ঝগড়া আর নেই। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও আর প্রাসঙ্গিক নয়। ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’ বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে সিপিআইয়ের পাশাপাশি সিপিএম-ও ২০০৪ সালে কংগ্রেস-সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে।
কিন্তু পুনর্মিলন যাঁরা চাইছেন, তাঁদের মধ্যেই এর প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইয়েচুরির বক্তব্য, “দু’টি দলকে মিশে যেতে হলে, তা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। একটি প্রক্রিয়া হল, বিভিন্ন গণ সংগঠনগুলিকে একত্র করা এবং নিচু স্তরে যৌথ কর্মসূচি নেওয়া, যা ধাপে ধাপে উপরের স্তরে উঠে আসবে। দুই দল এখন গণসংগঠন স্তরে এক সঙ্গেই কাজ করছে।” অন্য দিকে রাজার যুক্তি, “আগে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি ও আলোচনা প্রয়োজন। শীর্ষ স্তরে ঐক্য না হলে, নীচের স্তরে ঐক্য সম্ভব নয়। এর আগে কৃষক সভা ও ট্রেড ইউনিয়নের কিছু শাখা মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও সাফল্য মেলেনি।”
সিপিএমের এস আর পিল্লাই বা সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্তের মতো নেতারা আবার দুই দলের একীকরণের বিরোধী। পিল্লাই আগেই জানিয়েছেন, এখনও দুই দলের মধ্যে মতাদর্শগত, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। একীকরণ করতে হলে তা আগে মেটাতে হবে। গুরুদাসবাবুরও বক্তব্য, “পুনর্মিলনের জন্য আদর্শেরও মিলন প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে ব্যবধান রয়ে গিয়েছে।” দুই দলের সূত্রেই বলা হচ্ছে, ইয়েচুরি বা রাজা যা বলেছেন, তা তাঁদের ব্যক্তিগত মত। সিপিএমের সদ্যসমাপ্ত পলিটব্যুরো-কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। সিপিআইয়ের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকেও এ প্রসঙ্গ ওঠেনি।
ইতিহাস বলছে, নয়ের দশকের শুরুতে এক বার পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সিপিএম-সিপিআইয়ে। তখন দুই দলের কাণ্ডারী ছিলেন যথাক্রমে হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ ও ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। সে সময় রাজ্য স্তরে সমন্বয় কমিটি গড়ে তোলার জন্য দুই দলেই নির্দেশিকা জারি হয়েছিল। কিন্তু তার পরে আর বিষয়টি এগোয়নি। ২০০০ সালে সিপিএম কর্মসূচিতে কিছু বদল আনার পরে সিপিআই-প্রধান এ বি বর্ধন বলেছিলেন, এ বার পুনর্মিলন সম্ভব। কিন্তু সিপিএম তা খারিজ করে দেয়। তবে দুই দলের নেতারাই মানছেন, সিপিএম-সিপিআই একত্রিত হলে তিন রাজ্যের বাইরেও বামেরা শিকড় ছড়াতে পারবে। কিন্তু দুই দল মিশে গেলে শীর্ষ পদের গদি নিয়ে যে ঠোকাঠুকি লাগবে, তা-ও মানছেন তাঁরা। |
|
|
 |
|
|