‘অনুপস্থিতির রাজনীতি’ দিয়েই
প্রতিবাদ বুদ্ধর, অস্বস্তিতে কারাট
পস্থিতির চেয়ে অনুপস্থিতি অনেক সময় বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে!
ঠিক সেই কাণ্ডটাই হল এ বার হায়দরাবাদে সিপিএমের পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে।
বৈঠকের ভিতর, এমনকী রবিবার সাংবাদিক বৈঠকেও বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতি নিয়ে নানা প্রশ্নে বিড়ম্বিত হয়েছেন দলের সবর্ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। বারবার তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, এই অনুপস্থিতির পিছনে কোনও রহস্য নেই। আজকাল বুদ্ধবাবু তো বলতে গেলে কলকাতার বাইরে যান-ই না। শরীর ভাল নেই।
কিন্তু বৈঠক শেষে যে যার ঘরে ফিরে যাওয়ার সময়ে দলের ভিতর এই বার্তাই ‘রটি গেল ক্রমে’ যে, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে না থেকে আসলে কারাটের নেতৃত্বের প্রতি সুকৌশলে অনাস্থা প্রকাশ করলেন পশ্চিমবঙ্গে দলের কাণ্ডারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের ভাষায়, “একে বলা যেতে পারে অনুপস্থিতির রাজনীতি।”
শুধু সিপিএম নয়, কম-বেশি সব দলেই এই অনুপস্থিতির রাজনীতি রয়েছে। শরদ পওয়ার যখন কংগ্রেসে, তখন তিনি প্রায়ই দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বয়কট করতেন। প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ না-করে এই পথে অনাস্থা প্রকাশের রেওয়াজ বিজেপি-তেও ছিল। হিমাচলপ্রদেশে বিজেপি-র জাতীয় কর্মসমিতির যে বৈঠকে রাম মন্দির আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেখানে সহমত ব্যক্ত করেননি অটলবিহারী বাজপেয়ী। তখন লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বে দল চলছে। ‘ক্ষুব্ধ’ বাজপেয়ী প্রায়শই দলীয় বৈঠকে অনুপস্থিত থাকতেন। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ যখন দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তখন জ্যোতি বসু মাঝেমাঝে তাঁর ডাকা বৈঠকে অনুপস্থিত থাকতেন। তবে বুদ্ধবাবুর পলিটব্যুরো বৈঠকে না থাকার রেকর্ড সম্ভবত অন্য সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দলের মধ্যে বিরোধিতা করেছিলেন বুদ্ধবাবু। তার পর লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত একের পর এক পলিটব্যুরো বৈঠকে গরহাজির থেকেছেন তিনি।
এই অনুপস্থিতির রাজনীতি আদৌও পছন্দ করছেন না কারাট। তিনি বুঝতে পারছেন, এর ফলে দলের কর্মীদের কাছে তাঁর নিজের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ অসুস্থতার কারণ দেখানোয় সরাসরি বুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগের তর্জনীও তুলতে পারছেন না তিনি। অন্য কোনও পথেও কারাটকে আক্রমণের সুযোগ দেননি বুদ্ধবাবু। এ বার ভোটের আগে কেরলের একটি সংবাদপত্রে কারাটের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বুদ্ধবাবু বলেন, “এ সব সংবাদমাধ্যমের গুজব এবং প্রচার। প্রকাশের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর।” সিপিএম সূত্র বলছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল বললেও মতাদর্শগত মতপার্থক্য নিয়ে কিন্তু বুদ্ধবাবু কিছু বলেননি।
বুদ্ধবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নানা কাজে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। কিন্তু অভিজ্ঞ এই নেতা জানেন, কমিউনিস্ট পার্টির শৃঙ্খলা এমনই যে, দলের ভিতরে প্রকাশ্যে মুখ খুলে কোনও লাভ হয় না, উল্টে রেজ্জাক মোল্লার মতো অবস্থা হয়। বুদ্ধবাবু এখনও মনে করেন শিল্পায়নের প্রক্রিয়া সঠিক ছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া শুরু করতে না-করতেই দলের কিছু নেতা
যে ভাবে প্রকাশ্যে সরকারের বিরোধিতা শুরু করেছিলেন এবং যে ভাবে খোদ ভূমিমন্ত্রী জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা শুরু করেছিলেন, তা বিরোধী দলের হাতে আরও অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। এ বারের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ভুলের কথা স্বীকার করা হয়েছে। সাংবাদিক বৈঠকেও কারাট এ বিষয়ে সবিস্তার বলেছেন। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর কারাট এর চেয়েও আক্রমণাত্মক ভাষায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বকে আক্রমণ করেছিলেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে ভুলের কথা নির্বাচনী প্রচারের সময়ই দল স্বীকার করেছিল। বুদ্ধবাবু নিজেই বলেছিলেন, নন্দীগ্রামে গুলি চালানো ঠিক হয়নি। পলিটব্যুরোর আর এক সদস্য, তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বলেছেন, গুলি চালানোর নির্দেশ বুদ্ধবাবু দেননি। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও বলেছেন, সে দিন নন্দীগ্রামে কেন গুলি চলেছিল, কী ভাবে চলেছিল সেটা রহস্য। এর পিছনে কী সত্য রয়েছে তা এক দিন উদ্ঘাটিত হবে। তবে সিপিএমের সব নেতাই এখন কার্যত স্বীকার করছেন যে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে চূড়ান্ত প্রশাসনিক অযোগ্যতার প্রকাশ ঘটেছিল। তার জেরে সিপিএম-বিরোধী অসন্তোষ রাজ্যে যে পরিবর্তনের হাওয়া তুলেছিল, সে কথা শুধু কারাট নন, বুদ্ধবাবুও স্বীকার করেছেন। বিমানবাবু মেনে নিয়েছেন, সেই ঝড় কতটা তীব্র, দল তা বুঝতে পারেনি।
কিন্তু দলের মধ্যে বুদ্ধ-অনুগামীরা মনে করেন, শুধু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কারণে এই বিপর্যয় নয়। সিপিএমের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ শুরু হয়েছিল অনেক দিন আগে থেকেই। তাঁদের মতে, জ্যোতি বসুর সময় থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে প্রবল দলতন্ত্রের কুপ্রভাব যে প্রশাসনে পড়েছিল, সে কথাও স্বীকার করতে হবে। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, কৃষি থেকে শিল্প প্রতিটি ক্ষেত্রে দলতন্ত্র জেলায় জেলায় এমন ভাবে ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ শুরু করেছিল, যে প্রশাসন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। বুদ্ধবাবু চেষ্টা করেও দলতন্ত্রের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন। ফলে এই বিপর্যয়ের সামগ্রিক দায় বুদ্ধবাবুর ঘাড়ে চাপানো উচিত হবে না।
কারাট রাজ্য নেতৃত্বের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে বুদ্ধবাবু এবং বিমানবাবুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অনেকেরই প্রশ্ন, কারাটের নেতৃত্বে কোন রাজ্যে সিপিএমের কতটা শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে? সেই অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়াতে কারাট পার্টি কংগ্রেস পিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। তবে কলকাতার বদলে কেরলে পার্টি কংগ্রেস করার সিদ্ধান্তে কারাট কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। কারণ, কলকাতায় পার্টি কংগ্রেস হলে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার নেতারা তাঁকে যে আক্রমণ করে বেফাঁস মন্তব্য করতে পারেন, সেই আভাস কারাট পেয়েছিলেন। তাই ভরকেন্দ্র কলকাতা থেকে সরিয়ে দক্ষিণে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। কেরলে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন থাকবেন।
এখন ঘটনা হল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, শিল্পায়ন নিয়ে দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচির কিন্তু কোনও আনুষ্ঠনিক পরিবর্তন হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টিতে সাংবাদিক বৈঠকে কে কী বলছেন তার চেয়েও বড় কথা হল, পলিটব্যুরো বৈঠকে লিখিত প্রস্তাব কী নেওয়া হল। সিপিএম নেতারা সুভাষ বসু সম্পর্কে মূল্যায়ন ভুল ছিল বললেও দলের গৃহীত লাইনের কোনও পরিবর্তন এখনও করা হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ না দেওয়াকে জ্যোতি বসু ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বললেও পলিটব্যুরোর গৃহীত সিদ্ধান্ত কিন্তু বদলায়নি।
এক মাসও হয়নি দল রাজ্যে বিরোধী আসনে বসেছে। বিরোধী আসনে থেকেও অদূর ভবিষ্যতে শিল্প গড়ার দাবিতে দলকে সরব হতে হবে বলে মনে করেন বুদ্ধ-নিরুপম। বিধান রায়ের আমলে বিরোধী নেতা জ্যোতিবাবু শিল্পায়নের দাবিতে লাগাতার সরব ছিলেন। মমতা সরকারের কার্যকলাপ আরও কিছু দিন দেখে নিয়ে তার পর কোন পথে চলা হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চায় সিপিএম। কারাটের সমালোচনা সত্ত্বেও সেটা শিল্পায়নের পথই হবে বলে বুদ্ধ-শিবিরের বিশ্বাস।
আপাতত বুদ্ধবাবুর অনুপস্থিতির রাজনীতি বন্ধে কারাটের চেষ্টা সফল হয় কি না, সেটাই দেখার।
First Page Desh Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.